তিউনিসিয়ার নোবেল, সংলাপ ও গণতন্ত্র by মিজানুর রহমান খান
নোবেল বিজয়ী ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টলেটের নেতারা |
সংলাপের
জন্য নোবেল; তা–ও আবার কোনো ব্যক্তিকে নয়, বিবদমান রাজনৈতিক দল, যারা
সারাক্ষণ বিবাদ ও হানাহানিতে লিপ্ত, তাদের আলোচনার টেবিলে বসাতে সফল হওয়ার
কারণে নাগরিক সমাজের চারটি সংগঠনকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হলো।
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে এমন ঘটনা সম্ভবত এর আগে ঘটেনি। শুরুতেই দুই দিক
থেকে ভূমধ্যসাগর এবং দুপাশে আলজেরিয়া ও লিবিয়া বেষ্টিত তিউনিসিয়ার পেছনের
একটু বৃত্তান্ত টানতে চাই। দেশটির ৯৯ শতাংশ সুন্নি মুসলিম, আয়তনে
বাংলাদেশের সমান, কিন্তু লোকসংখ্যা মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ। ১৭০৫ সালে শুরু
হওয়া রাজবংশীয় শাসনের মধ্যেই ফ্রান্স ১৮৮১ সালে দেশটিকে উপনিবেশ বানাল।
গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার দাবিতে জনগণ ধীরে ধীরে উচ্চকিত হলো। প্রধান রাজনৈতিক
সংগঠনের প্রধান নেতা হাবিব বুরগিবা জনগণ, বিশেষ করে শ্রমিকদের চাপে
স্বাধীনতার দাবি তুললেন। বিনা রক্তপাতে দেশটি ১৯৫৬ সালে স্বাধীন হলো।
হাবিব ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ উদার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। দেশের মঙ্গল ও উন্নয়নে তাঁর নিষ্ঠা ছিল, কিন্তু গণতন্ত্রে বিশ্বাস ছিল না। তাঁর নেতৃত্বেই রাজতন্ত্রের অপসারণ ঘটল। ১৯৫৭ সালের নতুন সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্র লেখাও হলো। ৮৪ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে এক রক্তপাতহীন বেসামরিক অভ্যুত্থানে তিনি অপসারিত হওয়ার আগে আরব বিশ্বে দেশটিকে তিনি অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধি দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু সবকিছুই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতা ও উন্নয়নকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। ইসলামি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি গোড়া থেকেই কঠোর ছিলেন। তাঁর আগ্রহের কারণেই তিউনিসিয়ার নারীরা অবশিষ্ট আরব বিশ্ব থেকে অগ্রসর।
তিউনিসিয়ার শিক্ষার হার ৮০ শতাংশের বেশি। আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিলাম, তবে আমাদের লোকসংখ্যার খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ ইংরেজি চর্চা করে। আর তিউনিসিয়ার নারীদের ৭২ শতাংশ মাতৃভাষা আরবির সঙ্গে ফরাসিও রপ্ত করেছে। সুতরাং, দেশটির সংস্কৃতিও যে একান্তভাবে আরবি ভাবধারার নয়, সেখানে যে ফ্রান্সের সংস্কৃতির বিরাট প্রভাব আছে, সেটা অনুমেয়। মাত্র ১ কোটি মানুষ, যার ৮০ শতাংশ শিক্ষিত, তারা কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পরে মাত্র দুজন নেতা এবং একদলীয় শাসনের অধীনে ৫৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। কোনো সামরিক অভ্যুত্থান তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করেনি, তবে বাইরের হস্তক্ষেপ অবশ্যই ছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে আমরা চতুর্থ সংশোধনী করলাম। আর পঁচাত্তরের মার্চে হাবিব বুরগিবা সংবিধান সংশোধন করে নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন। আশির দশকের শেষ দিকে আমরা যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন করছি, তখন প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট হাবিব বুরগিবা কট্টর ইসলামি মৌলবাদীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।
কট্টর মৌলবাদীদের শাস্তি দেওয়া নিয়ে দলে মতভেদ ছিল না। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া নিয়ে বিরোধ দেখা দিল। প্রতিবেশী এবং বিদেশি মিত্ররাও অতি চরমপন্থা পছন্দ করলেন না। অনেকের মতে, ইসলামি মৌলবাদীদের ফাঁসিতে লটকানোর পরিকল্পনা করাই প্রেসিডেন্ট হাবিবের জন্য কাল হয়েছে। সমুদ্রপথে নিকট প্রতিবেশী ইতালি দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা কলকাঠি নাড়তে সক্ষম। ইতালির সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মার্টিনি ১৯৯৯ সালে তাঁদের একটি সংসদীয় কমিটিকে বলেছিলেন, হাবিবকে সরিয়ে দিতে তাঁরাই কলকাঠি নেড়েছিলেন। হঠাৎ করেই চিকিৎসকেরা মত দেন, হাবিব দায়িত্ব পালনে অসমর্থ। ওই দিনই সেই অজুহাতে জাইন আল আবেদিন বেন আলী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। এই বেন আলীও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, জঙ্গি দমনে বদ্ধপরিকর। তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট হাবিবের মতো তিনিও দেশ ভালোবাসেন, জনগণকে ভালোবাসেন। আর ক্ষমতা ভালোবাসেন।
তবে ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা নিয়েই আলী কতগুলো ‘যুগান্তকারী’ পদক্ষেপ নেন। যেমন আজীবন প্রেসিডেন্ট তিনি থাকবেন না, সে কথা বোঝাতে তিনি বিধান করলেন যে এক ব্যক্তি তিন মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট হবেন না, আর একাদিক্রমে দুবারের বেশি অবশ্যই নয়। অবশ্য এটা ছিল বুজরুকি। কিছুকাল পরেই আমাদের আবদুস সাত্তারের মতো সংবিধান সংশোধন করে (অবসরপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে লাভজনক পদে আসীন হতে পারতেন না, তাই ষষ্ঠ সংশোধনী এনে তাঁকে যোগ্য করা হয়) নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে যোগ্য করেছিলেন।
সংবিধানে আজীবন প্রেসিডেন্ট-ঘোষিত ব্যক্তিও ভোটে দাঁড়াতেন। সর্বদা ভোট পেতেন আমাদের সামরিক পর্বের কায়দায় ৯৯ শতাংশের বেশি। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, এ রকম একটি প্রহসনের জন্য হলেও ভোটের বাক্স পাততে হতো। অর্থাৎ, শাসকেরা জনগণের কাছে প্রতীকী হলেও হাত পাতবেন। তিউনিসিয়ার সদাশয় স্বৈরশাসকেরা এই হাত পাতা মুছে দেননি।
হাবিবের তিন দশকের শাসনে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম বিরোধী দলের কোনো খবর ছাপেনি। সেখানে বেন আলী এসেই পরিবর্তন আনলেন। প্রথমবারের মতো বিরোধী দলের খবর ছাপা হলো। বাক্স্বাধীনতার ব্যাপ্তি অনেকটাই তিনি প্রসারিত করলেন। এমনকি নিজের মূল দলটিকেও বিলুপ্ত করলেন। নতুন নামকরণ করলেন ডেমোক্রেটিক কনস্টিটিউশনাল র্যালি। গণতন্ত্র তিনি দেবেন না, সাংবিধানিক শাসনেও আসলে তাঁর আস্থা নেই। ওসব তাঁর ধাতে সয় না। কিন্তু আমজনতাকে তো বোকা বানাতে হবে। তাই দলের নামে গণতন্ত্র ও সংবিধান দুটিই রাখলেন। এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও।
তবে মানুষ না ঘুমিয়ে ঘুমের ভান করেছিল। তিউনিসিয়া বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র, যারা নিউ মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে শৃঙ্খল ভেঙেছে। আমরা কেউ কেউ ভাবি, মিডিয়ার স্বাধীনতা যদি না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের হার হবে। মানুষ হেরে যাবে। হয়তো একটু সরলীকরণ হবে, কিন্তু এটাও দেখার বিষয় যে মিডিয়ার স্বাধীনতা না থাকলেও জনগণকে দাবিয়ে রাখা যায় না। তিউনিসিয়ার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ শিক্ষিত ছিলেন বলেই হয়তো তাঁরা প্রায় রাতারাতি সামাজিক মিডিয়ার ওপর ভর করে বিপ্লব করেছেন। অনেকেই যার নামকরণ করেছেন জেসমিন রেভল্যুশন। এই জেসমিনের সুবাস কি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে?
সেটা ২০১১ সাল। আরব বসন্তের ধারায় বিপ্লব হলো। বেন আলী তাঁর ২২ বছরের শাসনের যবনিকা টেনে সরকার ভেঙে দেন। বিদেশে পালিয়ে যান। তবে এটাই দেখার যে বেন আলী যদি নির্বাচন ও গণতন্ত্রের চর্চা করতেন, তাহলে হয়তো বিপ্লবের পরের, অর্থাৎ দেশটির ইতিহাসের প্রথম অবাধ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনটিতেই ‘মৌলবাদীরা’ অত ভালো করতেন না। কিন্তু তা-ই হলো। অবশ্য সে জন্য আক্ষেপ না করে দেখতে হবে যে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কোয়ালিশন সরকার হয়েছে। বাংলাদেশে যেভাবে সামরিক শাসনের কারণে সংলাপ ও তার পরিবেশ গঠনের প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেভাবে প্রলম্বিত স্বৈরশাসনের কারণে তিউনিসিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে সংলাপের ঘাটতি দেখা গেছে।
তবে দেখার বিষয় হলো, স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী দল যা পারেনি, সেই ব্যর্থতা পূরণ করেছেন শ্রমিকেরা। তাঁরা পাশে পেয়েছেন মালিকপক্ষ বা এমপ্লয়ার্সদের সংগঠন এবং মানবাধিকারবাদীদের। পাঁচ দশক পরে কী আশ্চর্য, তাঁরাই বিবদমান দলগুলোকে একত্র করেছেন। অবস্থা কিছুটা হলেও এরশাদ আমলের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স্কপের ভূমিকার সঙ্গে তুলনীয়। শ্রমিক, নিয়োগকারী, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের চারটি সংগঠনের একটি মোর্চা আগে নিজেরা বুঝেছে, সবার ওপরে দেশ। তাই আগে নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ির ব্যাপারে আপস করেছে, তারপর মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকা বড় দলগুলোর কাছে গেছে। আমাদের বিভক্ত নাগরিক সমাজকেও একদিন এই পথে যেতে হবে।
তিউনিসিয়া আপসের রাজনীতির কারণে অবাধ নির্বাচনের পরেও মেয়াদ পূর্ণ করার আগে সংসদ ভেঙেছে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে। গত বছর তারা একটি সর্বসম্মত সংবিধান করেছে। তার মূলমন্ত্র বিকেন্দ্রীকরণ। তারা দেখেছে, একদলীয় শাসন আসলে দ্রুত এক ব্যক্তির শাসনে পরিণত হয়। আসলে রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র বা স্বৈরশাসন থেকে বেরোতে হলে কঠিনভাবে ক্ষমতার পৃথক্করণই হচ্ছে একমাত্র পথ।
সম্প্রতি নেপালও তা-ই করেছে। তিউনিসিয়ার মডেল ওয়েস্টমিনস্টার হলেও তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে একটা পাঠ নিয়েছে। নির্বাহী ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ও সরকারের হাতে রেখেছে, আমাদের দেশের মতো এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে নয়। এমনকি মন্ত্রীদের মর্যাদা যাতে বজায় থাকে, তারও রক্ষাকবচ করেছে। যেমন বলেছে, রেগুলেটরি ডিক্রি জারি করতে হলে তাতে মন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর থাকতে হবে। বিচারক নিয়োগ ও অপসারণে চার ধরনের পৃথক জুডিশিয়াল কাউন্সিল দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করেছে। যাঁরা সংস্কার চান, তাঁদের জন্য এটা একটা অনুসরণীয় মডেল।
নাগরিক সমাজকে দেওয়া প্রথম নোবেল পুরস্কারটি বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও রাজনীতিকদের চোখ খুলে দিক। আমরা তিউনিসীয় নাগরিক সংগঠন চতুষ্টয়ের সঙ্গে একমত যে এটা অবশিষ্ট বিশ্বের কাছে এই খবর রটাল, সংলাপ যেকোনো সমস্যার সুরাহা দিতে পারে। কিন্তু হিংসা কাউকে কোথাও পৌঁছে দেবে না।
নির্বাচনসহ যেকোনো সমাধানসূত্রে সবাইকে রাখতে হবে। বেন আলীকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের পতনের পর বেন আলীর পলায়নের পরেও তাঁর দলের তিনজনকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে রাখা হয়। এখন আমরা হয়তো মনে করতে পারি যে ১৯৯১ থেকে শুরু করে তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতে উচিত ছিল জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বা রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের যুক্ত করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা। সেই বিবেচনায় শেখ হাসিনা সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের যে রূপকল্প দিয়েছিলেন, পথের বাধা সারাতে সেটা এখনো একটা ভরসা হয়ে আছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
হাবিব ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ উদার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। দেশের মঙ্গল ও উন্নয়নে তাঁর নিষ্ঠা ছিল, কিন্তু গণতন্ত্রে বিশ্বাস ছিল না। তাঁর নেতৃত্বেই রাজতন্ত্রের অপসারণ ঘটল। ১৯৫৭ সালের নতুন সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্র লেখাও হলো। ৮৪ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে এক রক্তপাতহীন বেসামরিক অভ্যুত্থানে তিনি অপসারিত হওয়ার আগে আরব বিশ্বে দেশটিকে তিনি অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধি দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু সবকিছুই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতা ও উন্নয়নকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। ইসলামি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে তিনি গোড়া থেকেই কঠোর ছিলেন। তাঁর আগ্রহের কারণেই তিউনিসিয়ার নারীরা অবশিষ্ট আরব বিশ্ব থেকে অগ্রসর।
তিউনিসিয়ার শিক্ষার হার ৮০ শতাংশের বেশি। আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিলাম, তবে আমাদের লোকসংখ্যার খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ ইংরেজি চর্চা করে। আর তিউনিসিয়ার নারীদের ৭২ শতাংশ মাতৃভাষা আরবির সঙ্গে ফরাসিও রপ্ত করেছে। সুতরাং, দেশটির সংস্কৃতিও যে একান্তভাবে আরবি ভাবধারার নয়, সেখানে যে ফ্রান্সের সংস্কৃতির বিরাট প্রভাব আছে, সেটা অনুমেয়। মাত্র ১ কোটি মানুষ, যার ৮০ শতাংশ শিক্ষিত, তারা কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পরে মাত্র দুজন নেতা এবং একদলীয় শাসনের অধীনে ৫৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। কোনো সামরিক অভ্যুত্থান তাঁদের ক্ষমতাচ্যুত করেনি, তবে বাইরের হস্তক্ষেপ অবশ্যই ছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে আমরা চতুর্থ সংশোধনী করলাম। আর পঁচাত্তরের মার্চে হাবিব বুরগিবা সংবিধান সংশোধন করে নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন। আশির দশকের শেষ দিকে আমরা যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন করছি, তখন প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট হাবিব বুরগিবা কট্টর ইসলামি মৌলবাদীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।
কট্টর মৌলবাদীদের শাস্তি দেওয়া নিয়ে দলে মতভেদ ছিল না। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া নিয়ে বিরোধ দেখা দিল। প্রতিবেশী এবং বিদেশি মিত্ররাও অতি চরমপন্থা পছন্দ করলেন না। অনেকের মতে, ইসলামি মৌলবাদীদের ফাঁসিতে লটকানোর পরিকল্পনা করাই প্রেসিডেন্ট হাবিবের জন্য কাল হয়েছে। সমুদ্রপথে নিকট প্রতিবেশী ইতালি দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা কলকাঠি নাড়তে সক্ষম। ইতালির সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মার্টিনি ১৯৯৯ সালে তাঁদের একটি সংসদীয় কমিটিকে বলেছিলেন, হাবিবকে সরিয়ে দিতে তাঁরাই কলকাঠি নেড়েছিলেন। হঠাৎ করেই চিকিৎসকেরা মত দেন, হাবিব দায়িত্ব পালনে অসমর্থ। ওই দিনই সেই অজুহাতে জাইন আল আবেদিন বেন আলী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। এই বেন আলীও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, জঙ্গি দমনে বদ্ধপরিকর। তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট হাবিবের মতো তিনিও দেশ ভালোবাসেন, জনগণকে ভালোবাসেন। আর ক্ষমতা ভালোবাসেন।
তবে ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা নিয়েই আলী কতগুলো ‘যুগান্তকারী’ পদক্ষেপ নেন। যেমন আজীবন প্রেসিডেন্ট তিনি থাকবেন না, সে কথা বোঝাতে তিনি বিধান করলেন যে এক ব্যক্তি তিন মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট হবেন না, আর একাদিক্রমে দুবারের বেশি অবশ্যই নয়। অবশ্য এটা ছিল বুজরুকি। কিছুকাল পরেই আমাদের আবদুস সাত্তারের মতো সংবিধান সংশোধন করে (অবসরপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে লাভজনক পদে আসীন হতে পারতেন না, তাই ষষ্ঠ সংশোধনী এনে তাঁকে যোগ্য করা হয়) নিজেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে যোগ্য করেছিলেন।
সংবিধানে আজীবন প্রেসিডেন্ট-ঘোষিত ব্যক্তিও ভোটে দাঁড়াতেন। সর্বদা ভোট পেতেন আমাদের সামরিক পর্বের কায়দায় ৯৯ শতাংশের বেশি। কিন্তু দেখার বিষয় হলো, এ রকম একটি প্রহসনের জন্য হলেও ভোটের বাক্স পাততে হতো। অর্থাৎ, শাসকেরা জনগণের কাছে প্রতীকী হলেও হাত পাতবেন। তিউনিসিয়ার সদাশয় স্বৈরশাসকেরা এই হাত পাতা মুছে দেননি।
হাবিবের তিন দশকের শাসনে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম বিরোধী দলের কোনো খবর ছাপেনি। সেখানে বেন আলী এসেই পরিবর্তন আনলেন। প্রথমবারের মতো বিরোধী দলের খবর ছাপা হলো। বাক্স্বাধীনতার ব্যাপ্তি অনেকটাই তিনি প্রসারিত করলেন। এমনকি নিজের মূল দলটিকেও বিলুপ্ত করলেন। নতুন নামকরণ করলেন ডেমোক্রেটিক কনস্টিটিউশনাল র্যালি। গণতন্ত্র তিনি দেবেন না, সাংবিধানিক শাসনেও আসলে তাঁর আস্থা নেই। ওসব তাঁর ধাতে সয় না। কিন্তু আমজনতাকে তো বোকা বানাতে হবে। তাই দলের নামে গণতন্ত্র ও সংবিধান দুটিই রাখলেন। এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও।
তবে মানুষ না ঘুমিয়ে ঘুমের ভান করেছিল। তিউনিসিয়া বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র, যারা নিউ মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে শৃঙ্খল ভেঙেছে। আমরা কেউ কেউ ভাবি, মিডিয়ার স্বাধীনতা যদি না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের হার হবে। মানুষ হেরে যাবে। হয়তো একটু সরলীকরণ হবে, কিন্তু এটাও দেখার বিষয় যে মিডিয়ার স্বাধীনতা না থাকলেও জনগণকে দাবিয়ে রাখা যায় না। তিউনিসিয়ার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ শিক্ষিত ছিলেন বলেই হয়তো তাঁরা প্রায় রাতারাতি সামাজিক মিডিয়ার ওপর ভর করে বিপ্লব করেছেন। অনেকেই যার নামকরণ করেছেন জেসমিন রেভল্যুশন। এই জেসমিনের সুবাস কি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে?
সেটা ২০১১ সাল। আরব বসন্তের ধারায় বিপ্লব হলো। বেন আলী তাঁর ২২ বছরের শাসনের যবনিকা টেনে সরকার ভেঙে দেন। বিদেশে পালিয়ে যান। তবে এটাই দেখার যে বেন আলী যদি নির্বাচন ও গণতন্ত্রের চর্চা করতেন, তাহলে হয়তো বিপ্লবের পরের, অর্থাৎ দেশটির ইতিহাসের প্রথম অবাধ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনটিতেই ‘মৌলবাদীরা’ অত ভালো করতেন না। কিন্তু তা-ই হলো। অবশ্য সে জন্য আক্ষেপ না করে দেখতে হবে যে মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কোয়ালিশন সরকার হয়েছে। বাংলাদেশে যেভাবে সামরিক শাসনের কারণে সংলাপ ও তার পরিবেশ গঠনের প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেভাবে প্রলম্বিত স্বৈরশাসনের কারণে তিউনিসিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে সংলাপের ঘাটতি দেখা গেছে।
তবে দেখার বিষয় হলো, স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী দল যা পারেনি, সেই ব্যর্থতা পূরণ করেছেন শ্রমিকেরা। তাঁরা পাশে পেয়েছেন মালিকপক্ষ বা এমপ্লয়ার্সদের সংগঠন এবং মানবাধিকারবাদীদের। পাঁচ দশক পরে কী আশ্চর্য, তাঁরাই বিবদমান দলগুলোকে একত্র করেছেন। অবস্থা কিছুটা হলেও এরশাদ আমলের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স্কপের ভূমিকার সঙ্গে তুলনীয়। শ্রমিক, নিয়োগকারী, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের চারটি সংগঠনের একটি মোর্চা আগে নিজেরা বুঝেছে, সবার ওপরে দেশ। তাই আগে নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ির ব্যাপারে আপস করেছে, তারপর মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকা বড় দলগুলোর কাছে গেছে। আমাদের বিভক্ত নাগরিক সমাজকেও একদিন এই পথে যেতে হবে।
তিউনিসিয়া আপসের রাজনীতির কারণে অবাধ নির্বাচনের পরেও মেয়াদ পূর্ণ করার আগে সংসদ ভেঙেছে। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছে। গত বছর তারা একটি সর্বসম্মত সংবিধান করেছে। তার মূলমন্ত্র বিকেন্দ্রীকরণ। তারা দেখেছে, একদলীয় শাসন আসলে দ্রুত এক ব্যক্তির শাসনে পরিণত হয়। আসলে রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র বা স্বৈরশাসন থেকে বেরোতে হলে কঠিনভাবে ক্ষমতার পৃথক্করণই হচ্ছে একমাত্র পথ।
সম্প্রতি নেপালও তা-ই করেছে। তিউনিসিয়ার মডেল ওয়েস্টমিনস্টার হলেও তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে একটা পাঠ নিয়েছে। নির্বাহী ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ও সরকারের হাতে রেখেছে, আমাদের দেশের মতো এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে নয়। এমনকি মন্ত্রীদের মর্যাদা যাতে বজায় থাকে, তারও রক্ষাকবচ করেছে। যেমন বলেছে, রেগুলেটরি ডিক্রি জারি করতে হলে তাতে মন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর থাকতে হবে। বিচারক নিয়োগ ও অপসারণে চার ধরনের পৃথক জুডিশিয়াল কাউন্সিল দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করেছে। যাঁরা সংস্কার চান, তাঁদের জন্য এটা একটা অনুসরণীয় মডেল।
নাগরিক সমাজকে দেওয়া প্রথম নোবেল পুরস্কারটি বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও রাজনীতিকদের চোখ খুলে দিক। আমরা তিউনিসীয় নাগরিক সংগঠন চতুষ্টয়ের সঙ্গে একমত যে এটা অবশিষ্ট বিশ্বের কাছে এই খবর রটাল, সংলাপ যেকোনো সমস্যার সুরাহা দিতে পারে। কিন্তু হিংসা কাউকে কোথাও পৌঁছে দেবে না।
নির্বাচনসহ যেকোনো সমাধানসূত্রে সবাইকে রাখতে হবে। বেন আলীকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের পতনের পর বেন আলীর পলায়নের পরেও তাঁর দলের তিনজনকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে রাখা হয়। এখন আমরা হয়তো মনে করতে পারি যে ১৯৯১ থেকে শুরু করে তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতে উচিত ছিল জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বা রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের যুক্ত করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার করা। সেই বিবেচনায় শেখ হাসিনা সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের যে রূপকল্প দিয়েছিলেন, পথের বাধা সারাতে সেটা এখনো একটা ভরসা হয়ে আছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments