আমার কন্যা যেন থাকে নির্ভয়ে by উম্মে মুসলিমা

একজন মা বলছিলেন, কিছুদিন হলো তাঁর নয় বছরের ছোট্ট মেয়েটি বাড়িতে পুরুষ অতিথি এলে একটা ঘরে গিয়ে আলমারির আড়ালে লুকিয়ে থাকে। মেয়েটির আপন মামা একদিন তাকে কোলে তুলতে গেলে সে আঁচড়িয়ে, কামড়িয়ে, চিৎকার করে তাঁর কোল থেকে নেমে যায়। এমনকি তার বাবার কাছেও ঘেঁষে না। স্কুলেও যেতে চাইছে না। মেয়েকে বকাবকি-মারধর করা হচ্ছে। ‘কেন এমন করছ?’ জিজ্ঞাসা করলে মেয়ে মুখ বুজে থাকে। তিনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
মেয়েটির হলো কী? শেষ পর্যন্ত তাঁরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। প্রথম দিন কোনো প্রশ্নের উত্তর দিল না সে। গোঁ ধরে বসে রইল। মনোবিদ তাঁর নানা ধরনের কৌশল খাটিয়ে পাঁচ দিনের দিন সমর্থ হলেন বিষয়টি উদ্‌ঘাটনের। বন্ধুর জন্মদিনে গিয়েছিল ও। মায়েরা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের মধ্যে গল্প করায়। ওদিকে বন্ধুর এক আত্মীয় মেয়েটিকে হাতে চকলেটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে আড়ালে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে মেয়েটির সঙ্গে লোকটি যেসব আচরণ করে, মেয়েটির কাছে তা ছিল ভয়ংকর। সে ছুটে বেরিয়ে তার মায়ের কাছে গিয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা বলেছিল। মা অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা গ্রাহ্য করেননি। কিন্তু মেয়েকে বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করতেও তিনি বাধ্য করতে পারেননি। তারপর থেকেই মেয়ের এ রকম উল্টোপাল্টা আচরণ।
আমাদের নারীরাই শুধু নন, শিশুকন্যারাও ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। নারীরা তবু কেউ প্রতিবাদ করেন বা ঘুরে দাঁড়ান, কিন্তু কন্যাশিশুদের শেখানো হয় ‘খবরদার! এসব কথা কাউকে বলবে না।’ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অমিত রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, শুধু মেয়েশিশুই নয়, একই সঙ্গে ছেলেশিশুরাও যৌন হয়রানির শিকার হয়। তবে তা মেয়েশিশুদের তুলনায় কম। কিন্তু সব শিশুকেই অভিভাবকেরা শিখিয়ে দেবেন, কেউ, তা তিনি ভাই, মামা, চাচা, ফুফা, খালু, দাদা, নানা, শিক্ষক বা চেনা-অচেনা যে-ই হোক না কেন, কথায়-কাজে কোনো অসংগত আচরণ করলেই যেন মা-বাবা, অভিভাবককে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। আবার এমন অনেক মা-ও আছেন, যাঁরা ভালোমনে পরিচিত-অপরিচিত পুরুষের কোলে মেয়েটিকে বসিয়ে দেন। এসব আদিখ্যেতা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, কার বিকৃতি কখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তা তারা নিজেরাও জানে না। কারও ছেলেসন্তান ও মেয়েসন্তান দুটোই থাকলে ছেলেকে মেয়েদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতে শেখাতে হবে। যাতে যেকোনো মেয়ে তাদের সামনে আক্রান্ত হলে ছেলেরা রক্ষায় এগিয়ে আসতে পারে। অভিভাবকদের শিশুকে এটাও শিখিয়ে দিতে হবে, যদি কেউ চকলেট, খেলনা বা কোনো উপহারের লোভ দেখিয়ে তাকে আড়ালে নিতে চায়, তাহলে তারা যেন কিছুতেই সেসব নিতে রাজি না হয় বা সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে আসে। প্রয়োজনে চিৎকার বা চড়–থাপড়ও বসিয়ে দিতে পারে। কারণ, যৌন নিপীড়কেরাও জানে, তাদের বিকৃতির শিকার শিশুরা পারিবারিকভাবেই প্রশিক্ষিত যে এসব কথা চেপে যাওয়াই বুদ্ধিমানের লক্ষণ।
২০১৪ সালে ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ী সারা বিশ্বে ১০ জনে একজন মেয়েশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার। শারীরিক নির্যাতনের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার অপরাধের মাধ্যমেও যৌন নির্যাতন বেড়েছে। জরিপে আরও বলা হয়, পৃথিবীতে হাজার হাজার মেয়েশিশু পরিবারের পছন্দে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় ‘অনার কিলিং’-এর শিকার। বলা হয়, ভারতে কৈশোর অতিক্রমের আগেই প্রায় ৪২ শতাংশ মেয়ে শারীরিক সহিংসতার মুখোমুখি হয়। শিশুকে পতিতাবৃত্তিতে প্ররোচিত ও পাচার করা বিশ্বে একটি মারাত্মক ভীতিপ্রদ সমস্যা। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, বাল্যবিবাহের ফলে ১৫ থেকে ১৯ বছরের মেয়েশিশুরা তাদের স্বামী কর্তৃক যৌন নির্যাতন ও বিকৃতির শিকার হয়। তাহলে যৌন হয়রানি রোধে দেশে বাল্যবিবাহের যে ধুয়া তোলা হচ্ছে, সেখানে ফল দাঁড়াবে আরও ভয়াবহ।
আমাদের সমাজে মেয়েদের শেখানো হয়, কলঙ্ক হয় মেয়েদের, ছেলেদের নয়। সুতরাং যৌন নির্যাতনের কথা বলে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা বোকামি। এসব জানলে পরবর্তী সময়ে প্রেম, বিয়ে, কর্মক্ষেত্র—সবখানেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। নির্যাতিত মেয়েটির মা-বাবা-ভাইবোন সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হবে। কিন্তু ওই শিশুর কথা কি জানে, যে তার যৌন নিপীড়নের কথা চেপে রাখতে রাখতে একদিন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিল? যে শিশু যৌন হয়রানি এড়াতে আত্মহত্যা করেছিল? যে শিশু প্রতিশোধপরায়ণতায় নিজেই হত্যাকারী হয়ে উঠেছিল? সুতরাং শিশুদের বলতে দিতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে, তাদের বিরূপ পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ করতে হবে। আর যদি কেউ এর শিকার হয়েও পড়ে, তাকে বোঝাতে হবে যে এতে তার কোনো অন্যায় নেই, এটা তার অপরাধ নয়।
১৭ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন সোহায়লা আবদুলালি। তিনি তাঁর কলামে মন্তব্য করেছেন, ‘আমার শরীর আহত হয়েছিল, আমার সম্মান নয়।’ এটা যারা ঘটায়, তারাই ঘৃণ্য অপরাধী। তাদেরই সম্মানহানি হয়। এটাকে প্রতিবাদ ও আইনের মাধ্যমে প্রতিকার করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক নারী ও শিশুকে ১০৯২১—এই ফোন নম্বরটা মনে রাখতে হবে। যখনই যৌন হয়রানির আলামত উপস্থিত হবে, তখন নিজের কাছে ফোন না থাকলেও পাশের জনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ফোন করতে হবে। আশা করি, শিশুকে রক্ষা করতে আমাদের আশপাশের মানুষ সহৃদয়তার পরিচয় দেবেন। একই সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘মেয়েদের নিজেদের দোষে নিজেরা আক্রান্ত হয়’—এই মনোভাব পুরোপুরি ত্যাগ করে ত্বরিত সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করবে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক ও নারী অধিকার-বিষয়ক লেখক।
muslima.umme@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.