ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যেভাবে আয়রন ডোমকে ফাঁকি দিয়েছিল

গত ১ অক্টোবর দখলদার ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। তেল আবিবসহ ইসরায়েলের অন্যান্য শহরের সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে ইরান ১৮১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বহুল আলোচিত ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমকে ফাঁকি দেয় এবং বেশিরভাগই সফলভাবে আঘাত হানে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে।

ইরানের এই হামলাকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কৌশল ও নিয়ম-কানুনে বড় ধরনের পরিবর্তন বলে অভিহিত করেছেন ‘নেগাহ’ নিউ স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক ও সম্পাদক মোহাম্মাদ আলি সানুবেরি। আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করাকে ইরানের জন্য বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন তিনি।

সম্প্রতি গনমাধ্যমে এ সম্পর্কে তার লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম : ‘কীভাবে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দখলদার ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিগুলো ধ্বংস হলো ও তেল আবিবেব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হয়ে গেল?’

নিবন্ধে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক লিখেছেন, ‘ট্রু প্রমিজ-২ নামের ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র অভিযান আধুনিক সামরিক কৌশলের একটি ভাগ্য নির্ধারণী মুহূর্ত এবং ইরান ও ইহুদিবাদী দখলদারদের মধ্যে চলমান সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।’ পার্সটুডে জানিয়েছে, ইরান কীভাবে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও ভাবমূর্তি মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে তার কয়েকটি দিক বিশ্লেষণ করেছেন সানুবেরি-

ইসরায়েলের মূল স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ

ট্রু প্রমিজ-২ অভিযানে ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলো ব্যাপকভাবে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়। ফলে ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো পর্যন্ত এই অভিযানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ইহুদিবাদী দৈনিক মাআরিভ জানিয়েছে, যেসব ইসরায়েলি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ছিল নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত ‘নেভাতিম’ বিমান ঘাঁটি এবং রাজধানী তেল আবিবের নিকটবর্তী ‘তেল নুফ’ ও ‘হাতজেরিম’ সামরিক ঘাঁটি। এ ছাড়া ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিবে অবস্থিত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদরদপ্তরেও আঘাত হানে।

ইরানের সমন্বিত হামলা

ট্রু প্রমিজ-২ অভিযান ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাকে ধ্বংস করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এটি ছিল ইরানের পক্ষ থেকে চালানো একটি জটিল ও উচ্চমাত্রার অত্যাধুনিক হাইব্রিড যুদ্ধ যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, সাইবার হামলা ও মনস্তাত্ত্বিক অভিযানের সমন্বয় ঘটানো হয়েছিল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা অবকাঠামোতে সাইবার হামলা

ট্রু প্রমিজ-২ অভিযানের আগে ও অভিযান চলাকালে ইরানি হ্যাকাররা ইসরায়েলের আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দিয়েছিল। এ সময় আয়রন ডোম তৈরিতে সহায়তাকারী পশ্চিমা কোম্পানি ফায়ার আই’র বিরুদ্ধেও সাইবার হামলা চালানো হয়, যার ফলে আয়রন ডোমের ব্যর্থতা তীব্রতর হয়। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এভাবে অকার্যকর করে দেয়ার ফলেই ৯০ শতাংশ ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পেরেছে।

ইহুদিবাদীদের বিরুদ্ধে ইরানের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা

ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শেষ হওয়ার আগেই ইরানি হ্যাকাররা ইসরায়েলি নাগরিকদের টেলিফোনে এসএমএস পাঠানোর সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হন। তারা ইহুদিবাদীদের মোবাইল ফোনে এমন এসএমএস প্রেরণ করতে সক্ষম হন যাতে লেখা ছিল ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শেষ হয়ে গেছে। এর ফলে তারা হামলা শেষ হওয়ার আগেই তাদের ভূগর্ভস্থ আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ছেড়ে বেরিয়ে আসে। মনস্তুত্বিক যুদ্ধের এই কৌশল গ্রহণের ফলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পরবর্তী পরিস্থিতিনিয়ন্ত্রণে আনতে ইহুদিবাদী নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বেশ বেগ পেতে হয়।

প্রতিরোধ ফ্রন্ট ও ইরান একযোগে সমন্বিত অভিযান চালায়

ইরান যখন তেল আবিবের আশপাশে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তখন ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস তেল আবিবের একটি রেল স্টেশনে স্থল অভিযান চালায়। প্রতিরোধ ফ্রন্টের মধ্যে যে উচ্চমাত্রার যোগাযোগ ও কৌশল প্রণয়নের ম্যাকানিজম রয়েছে তা এই ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। এতে বোঝা গেছে, আধুনিক যুদ্ধ এখন আর একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই বরং বিমান ও স্থল বাহিনীর পাশাপাশি ইলেকট্রনিক টিমের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৌশলগত লক্ষ্যগুলো হাসিলের লক্ষ্যে এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়।

ইরানের হাইপারসনিক মিসাইল। ছবি : সংগৃহীত
ইরানের হাইপারসনিক মিসাইল। ছবি : সংগৃহীত



No comments

Powered by Blogger.