শিক্ষক থেকে ৫০০ কোটি টাকার মালিক হেনরী by সুজন সরকার

সিরাজগঞ্জের আলোচিত নাম ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী। ছিলেন গৃহবধূ, সংগীত শিল্পী ও স্কুল শিক্ষিকা। পরবর্তীতে হন রাজনৈতিক নেত্রী। সেখান থেকে সংসদ নির্বাচনে নৌকার টিকিট পেয়েও ভোটে পরাজিত হন। এরপর সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ পেয়ে   যান। পদ পেয়ে বনে যান প্রভাবশালী নেত্রী। এই পদটি যেন আলাদীনের চেরাগের মতো ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয় তার। এখান থেকেই তার উত্থান শুরু। হয়ে যান অঢেল সম্পদের মালিক। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে দলীয় পদ-পদবির পাশাপাশি বাড়তে থাকে তার সম্পদের পরিধিও কথিত আছে, টাকার জোরেই ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদর আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন তিনি। শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও কোটি কোটি টাকা খরচ করে হয়ে যান এমপি। এমপি হয়েই জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। নিজে সংসদ সদস্য হওয়ার ৩ মাসের মধ্যে ১৬ কোটি টাকা খরচ করে স্বামী শামীম তালুকদারকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বানিয়ে আনেন। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ঋণপ্রদান ও মওকুফ, চাকরি বাণিজ্য, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বদলিসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে কোটিপতি বনে যান স্থানীয় সবুজ কানন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক হেনরী। শুধু নিজ জেলা সিরাজগঞ্জ নয়, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, পটুয়াখালী ও ঢাকায় তার অঢেল সম্পদ। দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ১৬ বছরে ৫০০ কোটিরও বেশি টাকার সম্পদের মালিক হেনরী। অথচ ২০০৮ সালে মাত্র সাড়ে ৬ লাখ টাকার সম্পদের মালিক ছিলেন তিনি। সরকারি হিসেবেই তার সম্পদ বেড়েছে ৮৮৪গুণ, বেসরকারি হিসেবে যা ২১শ’ গুণেরও বেশি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হেনরীর নির্বাচনী হলফনামা থেকে জানা যায়, গত ১৬ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ৮৮৪গুণ। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা। শিক্ষকতা ও কৃষি থেকে আয় ছিল ১ লাখ ২২ হাজার টাকা। বার্ষিক খরচ দেখানো হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা। আয়কর নথির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত ১৪ বছরে তার সম্পদ ৮৮৪ গুণ বেড়ে হয়েছে ৫১ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।
সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের সদানন্দপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক আব্দুল হামিদ মিঞার মেয়ে ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী। রাজনীতিবিদ ভাষা সৈনিক সাবেক গভর্নর মোতাহার হোসেন তালুকদারের ছেলে শামীম তালুকদার লাবুর সঙ্গে বিয়ের পর সবুজ কানন স্কুল এন্ড কলেজে সংগীত শিক্ষকের চাকরি নেন। পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।

রাজনৈতিক পরিবারের পুত্রবধূ হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান হেনরী।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করার পর ড. হেনরীকে করা হয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। সোনালী ব্যাংকের আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরীর নামও ছিল। কারাগারে থাকা হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে তার কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের কথা বলেন। পরে দুদক তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ৩ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিলেও অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশেষে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওই অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান হেনরীসহ পরিচালকরা।

হেনরীর আয়কর নথিতে ২০১৯ সালের ৩০শে জুন নিট সম্পদ দেখানো হয় ১১ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে জমির দাম হিসেবে ২ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার কালো টাকা সাদা করা হয়। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত নিট সম্পদ দেখানো হয় ৪৭ কোটি ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকার। এর মধ্যে তিনি ৩২ কোটি ৫০ লাখ কালো টাকা সাদা করেন। ২০২১ সালের ৩০শে জুন আয়কর নথিতে নিট সম্পদ উল্লেখ করা হয় ৪৭ কোটি ৭১ লাখ ৮৮ হাজার টাকার। ২০২২ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত আয়কর নথিতে আবার ১ কোটি ৩০ লাখ কালো টাকা সাদা করা হয়। নিট সম্পদ দেখানো হয় ৫১ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকার।

সিরাজগঞ্জ ও গাজীপুরে হেনরীর নামে সাইনবোর্ড দেয়া স্থাবর অনেক সম্পদ আছে। সিরাজগঞ্জের গজারিয়ায় রিসোর্ট কিছুক্ষণ, নলিছাপাড়ায় জান্নাত আরা হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ এবং হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স টেকনোলজি, মুজিব সড়কে রাস মেডিকেয়ার নামে ক্লিনিক, গজারিয়ায় হেনরী ভুবন নামে বৃদ্ধাশ্রম, গজারিয়ায় মোতাহার হোসেন তালুকদার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ গড়ে তোলা হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ (সদর-কামারখন্দ) আসন থেকে এমপি হয়ে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। সদর আসনের সাবেক এমপি হাবিবে মিল্লাত মুন্নার অনুসারীদের কোণঠাসা করতে দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর চালান স্টিমরোলার। সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে জেলার রাজনীতি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন।

উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জ শহরের যুবদল ও ছাত্রদলের ৩ নেতাকর্মীকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার পর থেকে তারা পলাতক ছিলেন। পরে তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা শাখার সহযোগিতায় র‌্যাব-১২ ও র‌্যাব-৯ যৌথ অভিযানিক দল মৌলভীবাজারের সোনাপুর এলাকার দেলোয়ার হোসেন বাচ্চুর বাসায় অভিযান চালিয়ে এজাহারনামীয় পলাতক আসামি ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী ও তার স্বামী লাবু তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করে। বর্তমানে তারা ৭ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। ৯ই অক্টোবর রিমান্ড শেষ হবে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.