পতাকার জন্য ভালোবাসা
বিজয় দিবস |
বিজয় দিবসের একটি অনুষ্ঠানে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’ গানটি গাইছে একজন তরুণ। কণ্ঠ ও সুর কোনোটাই সে রকম ভালো নয়। কিন্তু যারা শুনছে, তারা মোহিত হয়েই শুনছে। এরপর আরেকজন গাইল ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানটি। আমি লক্ষ করলাম, আমার পাশে বসা আরেকজন তরুণ গানটি শুনতে শুনতে রুমালে চোখ মুছছে। খুব অস্বাভাবিক কোনো চিত্র নয়, তবু এতটাই অসাধারণ ও এতটাই হূদয়ছোঁয়া যে বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও আমার স্মৃতিতে তা আজও অম্লান। সবচেয়ে বড় কথা, এই অনুষ্ঠানের অংশ হতে পেরে আমি অভিভূত। একদম ভিন্ন একটা পরিবেশে এমন কিছু বাঙালির সঙ্গে সেই বিজয় দিবস পালন করেছিলাম, যাঁরা বাস করছেন পাকিস্তানের করাচিতে। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকেরা কাজ করছেন করাচির বিভিন্ন গার্মেন্টসে, কলকারখানায়।
অনুষ্ঠানে তাঁরা গাইলেন, আবৃত্তি করলেন। অন্য একটি কর্মশালায় অংশ নিতে গিয়েছিলাম লাহোরে। ফেরার পথে করাচিতে আমার এক আত্মীয়ার বাসায় ছিলাম দু-তিন দিন। ফেরার তারিখ ছিল ১৭ ডিসেম্বর। সত্যি কথা বলতে কি, পাকিস্তানে কর্মশালায় অংশ নিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিজেই খানিকটা অস্বস্তির মধ্যে ছিলাম। অস্বস্তি আরও বাড়ল এই ভেবে যে, আমাদের বিজয় দিবস আর আমি এই সময়টায় পাকিস্তানের মাটিতে! কিন্তু পরে মনে হয়েছে, ওই দিনটিতে ওখানে না থাকলে বিজয় দিবসের এই অন্য রকম অভিজ্ঞতাটিও আমার কখনো হতো না। আমার ভাইয়ের ছেলে রেজোয়ান ১৬ ডিসেম্বর সকালে এসে বলল, ‘ফুফু, চলেন আপনাকে বাঙালিদের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাই।’ ও আমাকে নিয়ে গেল একটি এলাকায়, যেখানে অনেকগুলো গার্মেন্টস আর তোয়ালের কারখানা। এখানেই একটি ভবনের নিচতলায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন করাচিতে থাকা বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকেরা। ওখানে যাওয়ার আগে আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে করাচিতে এত বাঙালি অভিবাসী শ্রমিক রয়েছেন। বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে ব্যানার টানিয়ে স্টেজ বানানো, চারদিকে ছোট ছোট কাগজের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে।
খুব সাধারণ আয়োজন কিন্তু অসাধারণ এক অনুভূতি। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, আজকে তো কর্মদিবস। সবাই মিলে অনুষ্ঠানে এলেন কীভাবে? একজন বললেন, ‘আপা, আমাদের পতাকার জন্য এটা আমাদের ভালোবাসা। আমরা প্রতিবছর ২৬ মার্চ আর বিজয় দিবসে ছুটি নিই। অনেকের ছুটি পেতে অসুবিধা হয় কিন্তু তাও আমরা এই দিনগুলোতে একত্র হই, দেশের গান গাই, পরিবারের কথা বলি। এ রকম দু-একটি দিন আছে বলেই আমরা বিদেশে বেঁচে আছি।’ ছুটির দিন হলে তাঁদের পাকিস্তানি সহকর্মীরাও অনুষ্ঠান দেখতে আসতেন বলে জানালেন। গিয়াস মিয়া নামের একজন শ্রমিক বললেন, ‘আপা, আমরা এমন একটা দেশে কাজ করি, যে দেশের আর্মি আমার দেশে গিয়া মানুষ মারছে। সেই কথা কিন্তু আমরা ভুলতে পারি না। যদিও এখানকার মানুষ আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। কিন্তু দেশের কথা মনে হলে সব বাদ দিয়ে ছুটে চলে যেতে চাই।’ সবশেষে আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে গাইতে অনেকেই ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন সেদিন। শামসুদ্দীন হোসেনের কথা শুনে অবাক হলাম।
তিনি জানালেন, তাঁদের পাকিস্তানি সহকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের কথা জানেন। অনেকে সমব্যথীও। মুহাজির যারা, বিশেষ করে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) সঙ্গে যারা জড়িত, তারা মনে করে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা তাদের থাকলে তাদের আন্দোলনও দ্রুত সফল হতো। মুহাজিররা মূলত পাঞ্জাব ও বিহার থেকে আসা উর্দুভাষী অভিবাসী। তাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে বালুচ নেতা গাউস বক্স বিজেঞ্জোর মতো শ্রদ্ধা করে। তাদের কাছ থেকে আমি ইতিহাসের কিছু গল্প শুনলাম। শুধু একটি কাজের জন্য মানুষগুলো একেবারে ভিন্ন একটি পরিবেশে পড়ে আছে। ওদের অনেকেই জানালেন, বিদেশে থাকার কষ্ট তো আছেই, এর ওপর আরও কষ্ট যে তাঁরা পাকিস্তানে থাকেন। আমি সেই দিনটি তাঁদের সঙ্গে কাটিয়ে, একটি অন্য বিজয় দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম। কেন জানি না, প্রতিবারই বিজয় দিবস এলে আমার সেই মানুষগুলোর কথা মনে হয়।
No comments