না থাকা সদিচ্ছার ওপর আস্থা

আমাদের দেশটিতে অশান্ত অবস্থা বিরাজ করছে মোটামুটি দীর্ঘ সময়। সম্প্রতি এটি ধারণ করেছে প্রকট আকৃতি। প্রায় লাগাতার অবরোধ ও হরতাল জনজীবনকে অচল করে দিয়েছে। এসব কর্মসূচিতে প্রাণঘাতী পেট্রলবোমা ছোড়া হচ্ছে চলমান যানবাহনের ওপর। অগ্নিদগ্ধ হয়ে হতাহত হচ্ছেন অনেকে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাস, ট্রাক, ট্রেন—এমনকি নদীতে নোঙর করা লঞ্চেও। রেললাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে। ঘটছে ট্রেন দুর্ঘটনা। হতাহত হচ্ছেন অসহায় যাত্রীরা। বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এমনকি হরতাল-অবরোধ অমান্য করেনি, এমন থেমে থাকা গাড়িতে ঘুমিয়ে থাকা হেলপারও মারা গেছেন অগ্নিদগ্ধ হয়ে। প্রশ্ন আসবে এর দায় কার? কেন এ পরিস্থিতির উদ্ভব হলো, তাও আলোচনার দাবি রাখে। তবে তার আগে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করা আবশ্যক। মানুষের যানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের। এ ক্ষেত্রে সরকার তা করতে সক্ষম হচ্ছে না। গোটা যোগাযোগব্যবস্থা কার্যত স্তব্ধ। এতে অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বেশুমার। উৎপাদিত পণ্য কোথাও পচে যাচ্ছে। কোথাও বা সে পণ্য অগ্নিমূল্যে সংগ্রহ করতে হচ্ছে ভোক্তাকে।
মহাসড়কসহ দেশের কতিপয় স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ নেই। এদের সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদেরও নিরাপত্তাহীন দেখা যায়। খোদ রাজধানীতেও তারা আক্রান্ত ও তাদের গাড়ি অগ্নিদগ্ধ হয়। তাই তাদের সহায়তায় সামরিক বাহিনী নিয়োগ সময়ের দাবি। একটি দেশ দিনের পর দিন এভাবে অবরুদ্ধ থাকতে পারে না। এ জাতীয় নাশকতামূলক কাজের জন্য মামলা হচ্ছে। তবে সেসব মামলায় গ্রেপ্তার হচ্ছেন বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এতে পরিস্থিতির অবনতিই ঘটছে। বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও ফিল্ম আছে। গণমাধ্যমও সহায়তা করতে পারে তাদের সংগ্রহ থেকে। প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়াই যথোচিত হবে। তবে বিষয়টিতে বিরোধী দলের নেতাদের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। কর্মসূচি চলাকালে এ ধরনের নাশকতামূলক কাজের দায় তাঁদের ওপর আসে। আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো নিশ্চয়ই তাঁরাও সমর্থন করেন না। সুতরাং, তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আবশ্যক। তদুপরি দেখার রয়েছে এর সুযোগ নিয়ে অন্য কেউ কিছু কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছে কি না। আন্দোলনকারীরা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সততার সঙ্গে বিষয়টি দেখলে এমনটি হওয়ার সুযোগ থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে সৃষ্টি হলো? সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনে। বিরোধী দল সূচনা থেকেই এর বিরোধিতা করেছিল। অবশ্য তা মাঠে-ময়দানে।
এ সংশোধনী বিল সংসদে আলোচনা ও পাস হওয়ার সময় তারা সংসদে যোগ দেয়নি, করেনি সক্রিয় বিধিগত বিরোধিতা। তারা পূর্বতন পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যেই সীমিত রাখে নিজেদের কার্যক্রম। আর সে কর্মসূচি ছিল মূলত হরতাল ও অবরোধ-জাতীয়। তবে সভা-সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচিও তারা নিয়েছিল সময়ে সময়ে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও তাদের সেসব সভা, সমাবেশ ও মিছিল প্রায় ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। উল্লেখ করা আবশ্যক যে বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পণ্ড করার ঐতিহ্য নতুনভাবে সৃষ্টি হয়নি। আগের সরকারগুলোও তাই করত। আর নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি যখন কোনো দল আয়োজন করতে পারে না, তখন দলের অভ্যন্তরে চরমপন্থীদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। আসে হরতাল ও অবরোধ জাতীয় ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি। আগেও এসেছে। এখনো চলছে। কিন্তু এ ধরনের কর্মসূচি দেশের জন্য বরাবরই অমঙ্গল বয়ে এনেছে। ক্ষেত্রবিশেষে সাময়িক প্রতিকার মিললেও অগ্রহণযোগ্য নজির রেখে গেছে। সরকারের মেয়াদের শেষ সময়। নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে। স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রকটভাবে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে। এমনটা ঘটবে, এটা রাজনৈতিক নেতারা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন। আর তাঁদের অজানা ছিল না, এতে অনেক উলুখাগড়ার প্রাণ যাবে। দেশটির বিকাশমান অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি আর এর ফলে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর ভোগান্তির কথাও তাঁদের চিন্তা-চেতনায় ছিল না এবং নেই। তবে আছে বক্তব্যে। উভয় পক্ষই বলছে তাদের অবস্থান জাতির কল্যাণের জন্য।
অথচ সে জাতি যাদের সমন্বয়ে গঠিত, সে মানুষগুলো আজ হাহাকার করে অসহায় অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। যে বিষয়ে উভয় পক্ষের সরাসরি বিপরীতমুখী অবস্থান, তা অবশ্যই রাজনৈতিক। তাদের কার্যক্রমে আজ গোটা সমাজজীবন বিপর্যস্ত। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে চাইছে না। এমনি অবস্থায় ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে সচেষ্ট রয়েছে আরও কয়েকটি পক্ষ। পরিস্থিতির অবনতিতে অবদান রাখছে অন্য কিছু বিষয়। এর একটি একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা। ২০১৩-এর সূচনা থেকেই এ বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে চলছে। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও বিজিবি মোকাবিলা করছে পরিস্থিতি। অপর বিষয়টি হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্পে, ক্ষেত্রবিশেষে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। এগুলোর সঙ্গে মূল সমস্যাটির সম্পর্ক না থাকার কথা। কিন্তু কার্যত তা হচ্ছে না। আর প্রধান যে সমস্যাটি, তার সমাধানও করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। অন্য কোনোভাবে এর কোনো সমাধানের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না। স্থায়িত্ব পাবে না এ ধরনের কোনো সমাধান। যেমন আসন্ন সংসদ নির্বাচনটিতে নাটকীয় কিছু না ঘটলে দেশের প্রধান বিরোধী দল অংশ নিচ্ছে না। ইতিমধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই জয়লাভ করেছে মহাজোট-সমর্থিত প্রার্থীরা। সরকার গঠনও করবেন তাঁরাই।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা যেভাবে আছে, তা নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলেই উন্নত হবে, এমনটা আশা করা যৌক্তিক নয়। হয়তো বা হরতাল-অবরোধ বা এ-জাতীয় কার্যক্রম চলতেই থাকবে। সে ক্ষেত্রে সরকার কঠোর কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে সাময়িক কিছু সুফল মিললেও তা ধরে রাখা অসম্ভব হবে। আমরা ক্ষমতার জন্য বিবদমান দুটি দলকেই শাসক হিসেবে দেখিছি ও দেখছি। অন্য কোনো রাজনৈতিক দল শিগগির তাদের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, এমন পরিস্থিতি লক্ষণীয় হচ্ছে না। তাই ঘুরেফিরে এরাই আসবে ক্ষমতায়, এমনটাই মনে হয়। তাদের শাসনকালে জনকল্যাণকর কাজ কিছু হলেও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ ও সন্ত্রাসীদের লালনের অপবাদমুক্ত হতে পারেনি দুটি দলের কোনোটিই। সুশাসন শব্দটি তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বৃত্তেই আটকা থাকে। দেশে চলমান মূল সংকটটি রাজনৈতিক। এটা সৃষ্টি করেছেন এবং জিইয়ে রেখেছেন রাজনীতিকেরা। চলমান সংকটে উদ্বিগ্ন দেশবাসী। পাশাপাশি অনেক বন্ধুপ্রতিম দেশও উদ্বিগ্ন। নির্বাচনকালে বরাবরই আমরা এ ধরনের সংকট ডেকে আনি। তখন এসব বন্ধুপ্রতিম দেশ বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে আসে। সচেষ্ট হয় বিবদমান পক্ষগুলোকে একটি সমঝোতায় আনতে। এভাবেই এসেছিলেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান।
আরেকবার কার্টার সেন্টার থেকে এলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। কিন্তু প্রচেষ্টা বিফল। এবারে জাতিসংঘের মহাসচিব স্বয়ং বিষয়টি নিষ্পত্তিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি এ সহিংস সংঘাতে বিচলিত। যোগাযোগ করছেন প্রধান দুই দলের নেতার সঙ্গে। একাধিকবার পাঠিয়েছেন তাঁর বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে। তিনি আর্জেন্টিনার নাগরিক, জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব। পত্রিকান্তরের তথ্য অনুসারে, ডজন ডজন সভা করেছেন অপরিসীম ধৈর্যের সঙ্গে। সফল হয়েছেন দুটি বিবদমান দলকে এক ছাদের নিচে এনে বৈঠকে বসাতে। বৈঠকও তিনবার হয়েছে। তবে সাফল্য কিছুমাত্র লক্ষণীয় হচ্ছে না। প্রধান বিরোধী দল তার লাগাতার কর্মসূচি অব্যাহত রাখছে। সরকারও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ করে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও এ বৈঠকের সফলতা দেশবাসীর ঐকান্তিক কামনা। বন্ধুদেশগুলোও তা-ই চায়। তবে ভরসা করতে ভয় পাচ্ছে অনেকে।
তাদের সদিচ্ছার ওপর আস্থা রেখে তারানকো এবারের মতো চলে গেছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে, তাঁরা কেউ তারানকোর এ সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল হবেন না। তারানকো সজ্জন ব্যক্তি। অন্যের সদিচ্ছার ওপর তাঁর অবিচল আস্থা থাকারই কথা। তিনি বহু দূরদেশ থেকে এসেছেন। উল্লেখ্য, আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ। কিন্তু একটি বিষয়ে দেশটি আমাদের খুব কাছের। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ে লাখ লাখ বাঙালি দর্শক আর্জেন্টিনার সমর্থক বনে যান। এ দেশের আকাশে উড়ে হাজার হাজার আর্জেন্টাইন পতাকা। সে দেশের ফুটবল তারকা দিয়েগো ম্যারাডোনার নাম আজও বাঙালির কাছে কিংবদন্তির নায়কের মতো। তারানকোর নাম, তাঁর সদিচ্ছা আর আন্তরিক প্রচেষ্টার কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখবে জনগণ। তিনি স্মরণীয় ও বরণীয়। কিন্তু আমরা নিজেদের সৃষ্ট দুর্দিনে তাঁকে হয়তো বা ব্যর্থ নমস্কারেই ফেরত পাঠালাম।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.