সুস্থ অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে অসুস্থ রাজনীতি
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। ব্যবসায়ী নেতা ও এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালে, কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি কর্মজীবন শুরু করেন বহুজাতিক কোম্পানিতে। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এপেক্স গ্রুপ। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এই সভাপতি বর্তমানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো: বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের দায় ব্যবসায়ীরা এড়াতে পারেন না। কেননা, তাঁরাই তো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: হ্যাঁ, ব্যবসায়ীদের এই দায় তো নিতেই হবে। যেমন, সরকারই ঠিক করে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কে হবেন। আমরাও সেটি মেনে নিচ্ছি। প্রথম আলোর রিপোর্ট সঠিক। কিন্তু এই প্রবণতা দেড়-দুই দশকের। তার আগে কখনো এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কে হবেন, তা নিয়ে সরকারপ্রধান মাথা ঘামাতেন না। কোনো সভ্য দেশেই এটি হয় না। দেখুন, সরকারপ্রধান যদি ঠিক করে দেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কে হবেন, তাহলে তো সেই সভাপতির পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা কী করবেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ব্যবসায়ীরা এখন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন। তাঁদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমি মনে করি, ব্যবসায়ীদের এই রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যবসায়ীদের একাংশ সরকার-সমর্থক; অন্য অংশ সরকারবিরোধী। এ অবস্থায় ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি নেওয়া কঠিন। আমরা এখন চাই একটি সমঝোতা হোক। যে ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাকে তো দেশ চালাতে হবে। এভাবে চললে তো শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যবসায়ীদের ঋণের পরিমাণ এত বেড়ে যাবে যে তা শোধ করা কঠিন হবে। বিদেশে পণ্য রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এমনকি দেশে বাজারজাত পণ্যও বিক্রি হচ্ছে না। ছোট দোকানদার, ফুটপাতের হকার—সবাই প্রায় বেকার হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-ধর্মঘট আগেও ছিল। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতি গত ৩০ বছরেও দেখা দেয়নি। আগের হরতাল-ধর্মঘট সত্ত্বেও বন্দর থেকে মাল খালাস হয়ে ঢাকায় চলে আসত। আবার ঢাকা থেকে রপ্তানিপণ্য চট্টগ্রামে যেতে সমস্যা হতো না। অর্থাৎ পণ্য সরবরাহব্যবস্থাটি মোটামুটি সচল ছিল। এবারের লাগাতার অবরোধের কারণে সরবরাহব্যবস্থাটি একেবারে ভেঙে পড়েছে। ফলে আমরা ক্রেতা হারাচ্ছি। বাইরের কাঁচামাল না এলে কারখানা চালু রাখাও সম্ভব হবে না।
প্রথম আলো: ব্যবসায়ীদের সরাসরি রাজনীতিতে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা কি ঠিক?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: এটা আমি পুরোপুরি অপছন্দ করি। টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনার সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত। কোনো কোনো ব্যবসায়ী নিজের অন্যায় কাজ আড়াল করার জন্য সাংসদ হতে চান। তাঁরা ভাবেন, সাংসদ-মন্ত্রী হলে কেউ গায়ে হাত দিতে পারবে না। বর্তমান সংসদের অধিকাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসা ঠিক নয়।
প্রথম আলো: বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী ফোরামে কি কোনো আলোচনা হয় না?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: অনেক সময় আলোচনা হয়, প্রস্তাবও নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায় না। আমাদের অনেক কিছু সংস্কার করার দরকার ছিল, যা হয়নি। নিজেদের মধ্যে ঐক্য না থাকলে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।
প্রথম আলো: কোনো কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল ও জোট ভাঙারও অভিযোগ আছে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: একজন ব্যবসায়ী কেন এই কাজ করবেন? পৃথিবীর সব দেশেই ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দেন। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে এসব চাঁদা দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা নেই। ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিলে তা রসিদ নিয়ে দেওয়া উচিত। এখানে সমস্যা হলো, এক দলকে চাঁদা দিলে অন্য দল বিরূপ চোখে দেখে।
প্রথম আলো: রাজনীতি যখন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন আপনারা চাঁদা দেওয়া বন্ধ করছেন না কেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: আমরা যখন বৈঠক করি, তখন সবাই বলেন, আমরা চাঁদা দেব না। তারপর দেখা যায়, গোপনে কোনো দলকে চাঁদা দিয়ে আসেন। এই চাঁদা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, ওই দল ক্ষমতায় গেলে কিছু টেন্ডার বা লাইসেন্স বাগিয়ে নেওয়া।
প্রথম আলো: এই সংঘাতের শেষ কোথায়?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী পাকিস্তান আমলে আমরা রাজনৈতিক সংঘাত দেখেছি। তখন আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তানিরা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও সেই সংঘাত-সংঘর্ষ চলছে। একসঙ্গে ১০-১৫ বছর কখনো শান্তিতে থাকতে পারিনি। এটা হয়তো আমাদের জাতিগত সমস্যা। না হলে এ রকমটি হবে কেন?
প্রথম আলো: সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: উত্তরণের পথ হলো, নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে সবাইকে শান্তির পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। দলের চেয়ে দেশের ও মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একটি অসুস্থ রাজনীতি সুস্থ অর্থনীতিকে কীভাবে অসুস্থ করে, বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। গত পাঁচ বছরে আমাদের যথেষ্ট অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেড়েছে। কিন্তু অসুস্থ রাজনীতির জন্য সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এত খারাপ অবস্থা কখনো আসেনি। আমরা ১৮ দল বা ১৪ দল বুঝি না। আমাদের একটাই চাওয়া যে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক। সেটি করতে না পারলে আওয়ামীপন্থী, বিএনপিপন্থী কোনো ব্যবসায়ীই থাকবেন না। রাজনীতিতে দল ও মতের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হতে পারে না।
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার কাছে ব্যবসায়ীরা স্মারকলিপি দিয়েছেন। কোনো ফল পেয়েছেন কি?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দেখা হলেও বিরোধী দলের নেতার দেখা তাঁরা পাননি। তিনি সে সময়ে অফিসে না থাকলেও পরে ব্যবসায়ীদের ডাকতে পারতেন। সেটি হয়নি। বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা চালিয়েও সফল হননি।
প্রথম আলো: আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে। এবারের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: কঠিন প্রশ্ন। আমি মনে করি, সমঝোতার জন্য দুই নেত্রীকে বসতে হবে। দ্বিতীয় কোনো নেতা বসলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। তাঁরা একসঙ্গে না বসলে, সংলাপ না করলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, কেউ বলতে পারে না। দুজনকে বসে ঠিক করতে হবে, কে কতটুকু ছাড় দেবেন। শান্তির জন্য সবাইকে ছাড় দিতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় এসে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডি ক্লার্ককে ভাইস প্রেসিডেন্ট করেছিলেন দেশের ও জনগণের স্বার্থে। আমাদের দুই নেত্রীকেও দেশের স্বার্থে ছাড় দিতে হবে। তাঁরা একগুঁয়েমি দেখালে অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
প্রথম আলো: ব্যবসায়ীরা দুই নেত্রীকে বসানোর ব্যাপারে কিছু করতে পারেন কি না?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: আমার মনে হয় না, ব্যবসায়ীদের সেই শক্তি আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা নীরব জনতা। তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও কিছু করার নেই। আওয়ামী ও বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীরাই সব নিয়ন্ত্রণ করেন।
প্রথম আলো: সরকার ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় আর বিরোধী দল বলছে, তফসিল পরিবর্তন করতে হবে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল না এলে এর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। কোনো নির্বাচনে ২০ শতাংশের নিচে ভোটার উপস্থিত হলে সেটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ভোটাররা কেন্দ্রে না গেলে উপস্থিতি বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: নির্বাচনের পরে কী হবে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: যাঁরা নির্বাচন বর্জন করবেন, তাঁরাও নিশ্চয়ই বসে থাকবেন না। আরও হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দেবেন। তাতে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য বলে কিছু থাকবে না। আমরা পথে বসে যাব।
প্রথম আলো: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে, তাহলে তারা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, যা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জরুরি। তারা জানে, এলাকায় কারা সন্ত্রাসী, কারা সমাজবিরোধী। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকলে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যান এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
প্রথম আলো: দলীয় সরকারের অধীনে এটি সম্ভব নয় কেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: এর জন্য নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনের বাজেট সংসদে পাস করতে হবে। তাহলে ১০ লাখ টাকার জন্য তাদের অর্থমন্ত্রীর কাছে ধরনা দিতে হবে না। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদেরই কমিশনে নিতে হবে। জনপ্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু জনপ্রশাসনের দলীয়করণ এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে সেটি আর সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: একতরফা নির্বাচন হয়ে গেলে পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: একতরফা নির্বাচন হলে শান্তি আসবে না। সে কারণে সমঝোতা নির্বাচনের আগেই হতে হবে।
প্রথম আলো: বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির ওপর স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি কী প্রভাব পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: ইতিমধ্যে তৈরি পোশাক খাতের বেশ কিছু অর্ডার বাইরে চলে গেছে। আরও যেত, কিন্তু আমরা যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করি সেই পরিমাণ পণ্য অন্য দেশ এত কম সময়ে করতে পারছে না। আমাদের একটি কারখানায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করেন; যেটি ভারতে বা ভিয়েতনামে দেখা যাবে না। এই অস্থিরতা ও সহিংসতা দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্রেতারাও বিকল্প চিন্তা করবেন। তখন তাঁরা বাংলাদেশের পণ্যের পরিমাণটি ভাগ করে একাধিক দেশ থেকে নিতে চাইবেন। সে ক্ষেত্রে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিটা অনেক বেশি হবে।
প্রথম আলো: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরে যাবেন কি না?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: কয়েক দিন আগে এক কোরিয়ান ব্যবসায়ী আমাকে বললেন, তিনি এখানে ১৮ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তিনি মিয়ানমারে চলে যাওয়ার চিন্তা করছেন। এভাবে অন্যরাও চলে যাবেন। অস্থিরতা থাকলে বিদেশি নতুন বিনিয়োগও আসবে না।
প্রথম আলো: বিজিএমইএসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন সরকারের কাছে সুদ মওকুফসহ নানা দাবি পেশ করেছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপকে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সরকার সবাইকে সেটি দিতে পারবে না। তবে বিজিএমইএ সুদ মওকুফের যে দাবি জানিয়েছে, তা পূরণ করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা জরুরি। বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজে থেকে সুদ মওকুফ করতে পারবে না। ব্যাংকিংব্যবস্থা হলো অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি, একে ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও শিল্পোদ্যোক্তাদের একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হলো পণ্য সরবরাহ। আগে যে ট্রাক আমি ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নিতাম, সেই ট্রাক এক লাখ টাকায়ও পাচ্ছি না। সরকার সংবিধান রক্ষার কথা বলছে, কিন্তু জনগণের জানমাল রক্ষার চিন্তা করছে না। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে পণ্য সরবরাহ সচল রাখা জরুরি। সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকুন, আমাদের আপত্তি নেই; কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তা তাঁকে দিতে হবে।
প্রথম আলো: সরকার যদি ব্যবসায়ীদের কথায় কর্ণপাত না করে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: এর সহজ উত্তর নেই। আবার আমরা চুপচাপ বসে থাকব, তাও হতে পারে না। আমরা সমাবেশের কর্মসূচি নিয়েছি। সরকার ও বিরোধী দলকে বলছি, আপনারা সমঝোতায় আসুন, দেশকে বাঁচান।
প্রথম আলো: ব্যবসায়ীদের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: আমি মনে করি, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। যে সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারা ব্যবসায়ীদের পক্ষে টানতে চেয়েছে; আবার ব্যবসায়ীরাও সরকারের কাছে কিছু পাওয়ার জন্য দলের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন।
প্রথম আলো: ধন্যবাদ।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো: বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের দায় ব্যবসায়ীরা এড়াতে পারেন না। কেননা, তাঁরাই তো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: হ্যাঁ, ব্যবসায়ীদের এই দায় তো নিতেই হবে। যেমন, সরকারই ঠিক করে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কে হবেন। আমরাও সেটি মেনে নিচ্ছি। প্রথম আলোর রিপোর্ট সঠিক। কিন্তু এই প্রবণতা দেড়-দুই দশকের। তার আগে কখনো এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কে হবেন, তা নিয়ে সরকারপ্রধান মাথা ঘামাতেন না। কোনো সভ্য দেশেই এটি হয় না। দেখুন, সরকারপ্রধান যদি ঠিক করে দেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কে হবেন, তাহলে তো সেই সভাপতির পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা কী করবেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ব্যবসায়ীরা এখন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন। তাঁদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমি মনে করি, ব্যবসায়ীদের এই রাজনৈতিক বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যবসায়ীদের একাংশ সরকার-সমর্থক; অন্য অংশ সরকারবিরোধী। এ অবস্থায় ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি নেওয়া কঠিন। আমরা এখন চাই একটি সমঝোতা হোক। যে ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাকে তো দেশ চালাতে হবে। এভাবে চললে তো শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যবসায়ীদের ঋণের পরিমাণ এত বেড়ে যাবে যে তা শোধ করা কঠিন হবে। বিদেশে পণ্য রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। এমনকি দেশে বাজারজাত পণ্যও বিক্রি হচ্ছে না। ছোট দোকানদার, ফুটপাতের হকার—সবাই প্রায় বেকার হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-ধর্মঘট আগেও ছিল। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতি গত ৩০ বছরেও দেখা দেয়নি। আগের হরতাল-ধর্মঘট সত্ত্বেও বন্দর থেকে মাল খালাস হয়ে ঢাকায় চলে আসত। আবার ঢাকা থেকে রপ্তানিপণ্য চট্টগ্রামে যেতে সমস্যা হতো না। অর্থাৎ পণ্য সরবরাহব্যবস্থাটি মোটামুটি সচল ছিল। এবারের লাগাতার অবরোধের কারণে সরবরাহব্যবস্থাটি একেবারে ভেঙে পড়েছে। ফলে আমরা ক্রেতা হারাচ্ছি। বাইরের কাঁচামাল না এলে কারখানা চালু রাখাও সম্ভব হবে না।
প্রথম আলো: ব্যবসায়ীদের সরাসরি রাজনীতিতে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা কি ঠিক?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: এটা আমি পুরোপুরি অপছন্দ করি। টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনার সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত। কোনো কোনো ব্যবসায়ী নিজের অন্যায় কাজ আড়াল করার জন্য সাংসদ হতে চান। তাঁরা ভাবেন, সাংসদ-মন্ত্রী হলে কেউ গায়ে হাত দিতে পারবে না। বর্তমান সংসদের অধিকাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসা ঠিক নয়।
প্রথম আলো: বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী ফোরামে কি কোনো আলোচনা হয় না?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: অনেক সময় আলোচনা হয়, প্রস্তাবও নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায় না। আমাদের অনেক কিছু সংস্কার করার দরকার ছিল, যা হয়নি। নিজেদের মধ্যে ঐক্য না থাকলে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।
প্রথম আলো: কোনো কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল ও জোট ভাঙারও অভিযোগ আছে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: একজন ব্যবসায়ী কেন এই কাজ করবেন? পৃথিবীর সব দেশেই ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দেন। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে এসব চাঁদা দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা নেই। ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিলে তা রসিদ নিয়ে দেওয়া উচিত। এখানে সমস্যা হলো, এক দলকে চাঁদা দিলে অন্য দল বিরূপ চোখে দেখে।
প্রথম আলো: রাজনীতি যখন ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন আপনারা চাঁদা দেওয়া বন্ধ করছেন না কেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: আমরা যখন বৈঠক করি, তখন সবাই বলেন, আমরা চাঁদা দেব না। তারপর দেখা যায়, গোপনে কোনো দলকে চাঁদা দিয়ে আসেন। এই চাঁদা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, ওই দল ক্ষমতায় গেলে কিছু টেন্ডার বা লাইসেন্স বাগিয়ে নেওয়া।
প্রথম আলো: এই সংঘাতের শেষ কোথায়?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী পাকিস্তান আমলে আমরা রাজনৈতিক সংঘাত দেখেছি। তখন আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তানিরা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও সেই সংঘাত-সংঘর্ষ চলছে। একসঙ্গে ১০-১৫ বছর কখনো শান্তিতে থাকতে পারিনি। এটা হয়তো আমাদের জাতিগত সমস্যা। না হলে এ রকমটি হবে কেন?
প্রথম আলো: সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: উত্তরণের পথ হলো, নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে সবাইকে শান্তির পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। দলের চেয়ে দেশের ও মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একটি অসুস্থ রাজনীতি সুস্থ অর্থনীতিকে কীভাবে অসুস্থ করে, বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। গত পাঁচ বছরে আমাদের যথেষ্ট অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেড়েছে। কিন্তু অসুস্থ রাজনীতির জন্য সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এত খারাপ অবস্থা কখনো আসেনি। আমরা ১৮ দল বা ১৪ দল বুঝি না। আমাদের একটাই চাওয়া যে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক। সেটি করতে না পারলে আওয়ামীপন্থী, বিএনপিপন্থী কোনো ব্যবসায়ীই থাকবেন না। রাজনীতিতে দল ও মতের পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হতে পারে না।
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার কাছে ব্যবসায়ীরা স্মারকলিপি দিয়েছেন। কোনো ফল পেয়েছেন কি?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দেখা হলেও বিরোধী দলের নেতার দেখা তাঁরা পাননি। তিনি সে সময়ে অফিসে না থাকলেও পরে ব্যবসায়ীদের ডাকতে পারতেন। সেটি হয়নি। বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা চালিয়েও সফল হননি।
প্রথম আলো: আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে। এবারের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: কঠিন প্রশ্ন। আমি মনে করি, সমঝোতার জন্য দুই নেত্রীকে বসতে হবে। দ্বিতীয় কোনো নেতা বসলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। তাঁরা একসঙ্গে না বসলে, সংলাপ না করলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, কেউ বলতে পারে না। দুজনকে বসে ঠিক করতে হবে, কে কতটুকু ছাড় দেবেন। শান্তির জন্য সবাইকে ছাড় দিতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় এসে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডি ক্লার্ককে ভাইস প্রেসিডেন্ট করেছিলেন দেশের ও জনগণের স্বার্থে। আমাদের দুই নেত্রীকেও দেশের স্বার্থে ছাড় দিতে হবে। তাঁরা একগুঁয়েমি দেখালে অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।
প্রথম আলো: ব্যবসায়ীরা দুই নেত্রীকে বসানোর ব্যাপারে কিছু করতে পারেন কি না?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: আমার মনে হয় না, ব্যবসায়ীদের সেই শক্তি আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের বাইরে যাঁরা আছেন, তাঁরা নীরব জনতা। তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও কিছু করার নেই। আওয়ামী ও বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীরাই সব নিয়ন্ত্রণ করেন।
প্রথম আলো: সরকার ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন করার ব্যাপারে অনড় আর বিরোধী দল বলছে, তফসিল পরিবর্তন করতে হবে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল না এলে এর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। কোনো নির্বাচনে ২০ শতাংশের নিচে ভোটার উপস্থিত হলে সেটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ভোটাররা কেন্দ্রে না গেলে উপস্থিতি বাড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: নির্বাচনের পরে কী হবে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: যাঁরা নির্বাচন বর্জন করবেন, তাঁরাও নিশ্চয়ই বসে থাকবেন না। আরও হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দেবেন। তাতে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য বলে কিছু থাকবে না। আমরা পথে বসে যাব।
প্রথম আলো: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে, তাহলে তারা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, যা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জরুরি। তারা জানে, এলাকায় কারা সন্ত্রাসী, কারা সমাজবিরোধী। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকলে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যান এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
প্রথম আলো: দলীয় সরকারের অধীনে এটি সম্ভব নয় কেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: এর জন্য নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনি সুরক্ষা দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনের বাজেট সংসদে পাস করতে হবে। তাহলে ১০ লাখ টাকার জন্য তাদের অর্থমন্ত্রীর কাছে ধরনা দিতে হবে না। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদেরই কমিশনে নিতে হবে। জনপ্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু জনপ্রশাসনের দলীয়করণ এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে সেটি আর সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: একতরফা নির্বাচন হয়ে গেলে পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: একতরফা নির্বাচন হলে শান্তি আসবে না। সে কারণে সমঝোতা নির্বাচনের আগেই হতে হবে।
প্রথম আলো: বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনীতির ওপর স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি কী প্রভাব পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: ইতিমধ্যে তৈরি পোশাক খাতের বেশ কিছু অর্ডার বাইরে চলে গেছে। আরও যেত, কিন্তু আমরা যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করি সেই পরিমাণ পণ্য অন্য দেশ এত কম সময়ে করতে পারছে না। আমাদের একটি কারখানায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করেন; যেটি ভারতে বা ভিয়েতনামে দেখা যাবে না। এই অস্থিরতা ও সহিংসতা দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্রেতারাও বিকল্প চিন্তা করবেন। তখন তাঁরা বাংলাদেশের পণ্যের পরিমাণটি ভাগ করে একাধিক দেশ থেকে নিতে চাইবেন। সে ক্ষেত্রে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিটা অনেক বেশি হবে।
প্রথম আলো: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরে যাবেন কি না?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: কয়েক দিন আগে এক কোরিয়ান ব্যবসায়ী আমাকে বললেন, তিনি এখানে ১৮ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তিনি মিয়ানমারে চলে যাওয়ার চিন্তা করছেন। এভাবে অন্যরাও চলে যাবেন। অস্থিরতা থাকলে বিদেশি নতুন বিনিয়োগও আসবে না।
প্রথম আলো: বিজিএমইএসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন সরকারের কাছে সুদ মওকুফসহ নানা দাবি পেশ করেছে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপকে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সরকার সবাইকে সেটি দিতে পারবে না। তবে বিজিএমইএ সুদ মওকুফের যে দাবি জানিয়েছে, তা পূরণ করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা জরুরি। বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজে থেকে সুদ মওকুফ করতে পারবে না। ব্যাংকিংব্যবস্থা হলো অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি, একে ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও শিল্পোদ্যোক্তাদের একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হলো পণ্য সরবরাহ। আগে যে ট্রাক আমি ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নিতাম, সেই ট্রাক এক লাখ টাকায়ও পাচ্ছি না। সরকার সংবিধান রক্ষার কথা বলছে, কিন্তু জনগণের জানমাল রক্ষার চিন্তা করছে না। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে পণ্য সরবরাহ সচল রাখা জরুরি। সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকুন, আমাদের আপত্তি নেই; কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের নিরাপত্তা তাঁকে দিতে হবে।
প্রথম আলো: সরকার যদি ব্যবসায়ীদের কথায় কর্ণপাত না করে?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: এর সহজ উত্তর নেই। আবার আমরা চুপচাপ বসে থাকব, তাও হতে পারে না। আমরা সমাবেশের কর্মসূচি নিয়েছি। সরকার ও বিরোধী দলকে বলছি, আপনারা সমঝোতায় আসুন, দেশকে বাঁচান।
প্রথম আলো: ব্যবসায়ীদের দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: আমি মনে করি, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। যে সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারা ব্যবসায়ীদের পক্ষে টানতে চেয়েছে; আবার ব্যবসায়ীরাও সরকারের কাছে কিছু পাওয়ার জন্য দলের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন।
প্রথম আলো: ধন্যবাদ।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments