সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ' অনুবাদঃ আন্দালিব রাশদী

১৯৭১ সালে সোভিয়েত মহাকাশবিজ্ঞানীরা একটি ছোট গ্রহ আবিষ্কার করেন এবং তার নাম দেন বার্গলজ, ত্রিশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজের নামে।

লেনিনগ্রাদের একটি মহাসড়ক তাঁর নামে, তাঁর জীবনোপাখ্যান নিয়ে রয়েছে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য নাটক অধিশব রহ গব, ইভান ফুলারের রচনা। সাহিত্যকর্মের জন্য প্রদেয় রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মান ও পদক তিনি পেয়েছেন। মে মাসজুড়ে উদ্যাপিত হচ্ছে ওলগার জন্মশতবর্ষ জয়ন্তী। ১৯১০ সালের ১৬ মে তাঁর জন্ম সেন্ট পিটার্সবার্গের শহরতলিতে। তাঁর বাবা একজন চিকিৎসক। সহ-চিকিৎসকদের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করতে না চাওয়ায় তাঁর ওপর নেমে আসে দুঃসহ নির্যাতন।
ওলগার বয়স যখন সাত বছর, তখনই রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। জার শাসনের অবসান ঘটে। কিন্তু যতই দিন যায়, শিল্পীর স্বাধীনতা ততই ক্ষুণ্ন হতে থাকে। ওলগা ও তাঁর ছোট বোন মারিয়া অনুধাবন করতে পারেন তাঁদের শত্রু একদিকে ফ্যাসিস্ট জার্মান, অন্যদিকে নিজ দেশে ফ্যাসিস্ট রাশিয়া।
ওলগার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে, তাঁর বয়স তখন ১৪। ১৯২৫-এ তরুণ লেখকদের একটি সংঘে যোগ দিয়ে বরিস কর্নিলভের প্রেমে পড়েন, ১৯২৬-এ বিয়ে করেন, মেয়ে ইরিনার জন্ম হয়। কিন্তু বরিসের সঙ্গে সংসার টেকেনি। বরিসকে রাষ্ট্রবিরোধী শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁকে না খাইয়ে তিলে তিলে হত্যা করা হয়।
এর আগেই ওলগা নিকোলাই মোলখালভকে বিয়ে করেন। ত্রিশের দশকের শেষভাগটা খুব কষ্টে কাটে তাঁর। সাবেক স্বামী ও লেখক বরিসের মৃত্যু তাঁকে ভীষণ নাড়া দেয়। এদিকে তাঁর নিজের দুই মেয়ে ইরিনা ও মায়ার অকালমৃত্যু ঘটে। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে এ স্বাধীনচেতা কবিকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তিনি গর্ভবতী। সাত মাসের কারাজীবনে প্রতিবারই জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন করা হয় এবং এতে গর্ভস্থ সন্তানেরও মৃত্যু ঘটে। তিনি মৃত সন্তান প্রসব করেন। তত দিনে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ও গদ্য রচনা গণমানুষের হাতে পেঁৗছে যায়। ১৯৪০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। জার্মান বাহিনী টানা ৯০০ দিন সেন্ট পিটার্সবার্গ অবরোধ করে রাখলে দুঃসহ অবরুদ্ধ দিন তাঁরও কাটতে থাকে। সে সময় স্থানীয় রেডিওতে তাঁর কথিকা, কবিতা ও বক্তৃতা সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়। ৯০০ দিনের অবরোধে ১০ লাখ মানুষের অনাহারে মৃত্যু ঘটে।
সেন্ট পিটার্সবার্গই আজকের লেনিনগ্রাদ।
১৯৭৫ সালের ১৩ নভেম্বর ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ মৃত্যুবরণ করেন।
লেনিনগ্রাদ কবিতাগুলো তাঁর স্মরণীয় রচনা। ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁর লেখা খুব পছন্দ করতেন। তাঁর কয়েকটি অনূদিত কবিতা প্রকাশ করে জন্মশতবর্ষে এ কবিকে স্মরণ করছি। কবিতাগুলো রুশ থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন ইয়েভগেনি বোনভার ও ড্যানিয়েল ওয়েইসবোর্ট। ইংরেজি থেকেই বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
প্রতিশ্রুতি
আমি নিঃশেষ হয়ে গেলে আমার শত্রুরা সান্ত্বনা পাবে না
লোক দেখানো অশ্রু ফেলার কোনো কারণ তাদের নেই
যে আংটাতে আমাকে ফাঁস দেওয়া হবে, এখনো গাঁথা হয়নি
লোহা পিটিয়ে আংটা এখনো বানানো হয়নি, লৌহ আকর খনিতে এখনো।
আমার জীবনের তলাহীন জ্বালামুখের ওপর দিয়ে দাঁড়িয়ে যাব
তার ওপর আতঙ্ক আর লোহার শলাকা...
আমি জানি, সব কিছু বেশ মনে পড়ছে... আমি যে যোদ্ধা,
আমার মূল্যও ভয়ঙ্কর রকম বেশি। (১৯৫২)
উত্তর
কিন্তু আমি তোমাদের বলছি
এমন কোনো বছর নেই, যা অকারণে ধরে রেখেছি
এমন কোনো পথ_যার গন্তব্য ঠিক করিনি
এমন কোনো বাণী, যার অর্থ নেই
এমন কোনো পৃথিবী নেই, যা আমি হারিয়েছি
যে উপহার আমি দিয়েছি, ভালোমন্দ না ভেবেই
এমন কোনো ভালোবাসা নেই, ভুল বলবে যাকে,
যা প্রতারণা নয়, যন্ত্রণা নয় হৃদয়ের
এর চিরস্থায়ী স্বচ্ছ আলো বিকীর্ণ হয়
আমার সমস্ত হৃদয়জুড়ে।
এর কখনো কোনো বিলম্ব নেই
নতুন পৃথিবীতে জীবন শুরু করার_
এমনই ছিল সেই প্রাচীন শ্রমঘন দিনগুলোতে
লড়াই ছিল, কোনো গোঙানি কিংবা অন্য কোনো শব্দ নয়। (১৯৬২)
চেষ্টাও করো না যেন
পেছনে তাকাবার চেষ্টাও করো না যেন
এই বিষণ্ন অন্ধকারে, এই বিষণ্ন তুষারে
তোমার পথে পদচিহ্নের ওপর কেউ একজন অপেক্ষায় আছে
তুমি তার চোখে যেসব প্রশ্ন তার জবাব না দিয়ে পারবে না।
আজ আমি পেছন দিকে তাকালাম... তখনই দেখি :
সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, বন্ধু আমার
তুষারের ভেতর থেকে জীবন্ত চোখে
একমাত্র বন্ধু আমার আমার শেষ সময় পর্যন্ত।
আমি জানতাম না ব্যাপারটা এমনই
ভেবেছিলাম আমার আলো অন্য কোনো একটি
কিন্তু ওহ আমার যাতনা, আমার স্বপ্ন, স্বর্গ আমার
আমি তখনই জীবিত, যখন তোমার দৃষ্টির আলোকে!
কেবল তোমার দৃষ্টিই আমার জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে।
কেবল তোমার দৃষ্টির কাছে আমি বিশ্বাসী
আর যারা বেঁচে আছে, তাদের কাছে আমি তার স্ত্রী
বিধবা স্ত্রী তোমার, বেঁচে আছি দু'জনের জন্য। (১৯৪৭)
গানের জন্য
জেগে ওঠো যেমন তুমি চাও
কিন্তু ঘুম থেকে জেগে ওঠো আমার ভেতরে
শীতল, অসাড়, অতল গভীর থেকে।
একটি কথা বলার স্বপ্নও আমি দেখি না
কিন্তু একটি আভাস দিয়ে বুঝিয়ে দাও
তুমি এখনো এই পৃথিবীতেই আছো।
দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়, কেবল একটি ঝলক
যদি কাব্যে না হয়, তাহলে দীর্ঘশ্বাসে
কিংবা শরীরের ক্রন্দনে।
কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস, গোঙান অনুযোগ
তোমার দুর্বোধ্য গান বেঁচে যায়। (১৯৫১)
রজতজয়ন্তী পর্যন্ত নয়
আমাদের বিয়ের রজত কিংবা সুবর্ণজয়ন্তী পর্যন্ত নয়
তোমার সঙ্গে থেকে যেতে চাই বন্ধু আমার
কিন্তু আগে যে আমাদের লৌহজয়ন্তী হয়ে গেছে
ভয়ঙ্কর যুদ্ধের অগি্নশিখার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে
যে ভালোবাসা আমি ধরে আছি, সুবর্ণজয়ন্তীরও বেশি
লৌহের মতো, আমি এখনো প্রেমে পড়ে আছি। (১৯৪৯)
বিচার
আর তখন তোমার অনেক শক্তি_
দেখবে এবং জানবে আবার
কেমন করে তোমার সকল ভালোবাসা
যন্ত্রণা দিতে শুরু করবে।
তোমার বন্ধু কোনো দোষারোপ না করেই
একদা নেকড়ে মানবসন্তান হাজির হবে,
বিনষ্ট করবে সে তোমার সম্মান;
অন্যদের দেখলে তোমার বিকর্ষণ হবে
তারা তোমাকে জাদু করতে শুরু করবে
এবং আদেশ দেবে 'সব কিছু রদ কর'_
তোমার হৃৎপিণ্ড ছোট হয়ে আসবে
আতঙ্ক আর অনুতাপে
আর তখন তোমার ঢের শক্তি_
আবার তাদের জবাব দেবার :
যা কিছু আমার জীবন ছিল, সেখান থেকে
আমি কখনো সরে যাব না।
আর তখন তোমার ঢের শক্তি_
পুরনো স্মৃতি স্মরণ করে
যাদের তুমি ভালোবাসতে, আর একবার
চিৎকার করে বলতে পারো : 'ফিরে এসো!'
আমার বোনের জন্য
আমি পুরনো বাড়িটার স্বপ্ন দেখেছি
যেখানে আমি শৈশবের বছরগুলো কাটিয়েছি
আমার হৃদয় এখনো আগের মতোই
আয়েশ, ভালোবাসা ও উষ্ণতা খুঁজে পায়।
আমি ক্রিসমাসের স্বপ্ন দেখেছি, ক্রিসমাস বৃক্ষ
আমার বোনের সেই সশব্দ হাসি
সকাল থেকে গোলাপি জানালা
ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠে।
আমি জানি, আমাদের পুরনো বাড়ি
মেরামতের অভাবে দুর্দশায় পড়েছে
পাতাঝরা বিষণ্ন শাখাগুলো
অন্ধকার শার্সিতে টোকা দিচ্ছে।
আর পুরনো আসবাবসহ রুমটিতে
একজন বিদ্বেষপরায়ণ বন্দি, আটকে আছেন
আমাদের বাবা সেখানে, নিঃসঙ্গ ও ক্লান্ত
তিনি মনে করেন আমাদের কাছে পরিত্যক্ত তিনি ।
আহ্, আমি দেশের স্বপ্ন দেখছি যেন_
যেখানে আমার সব ভালোবাসা শুষে নিয়েছে?
মারিয়া, আমার বন্ধু, বোন আমা
আমাকে নাম ধরে ডাকো, আমার কাছে এসো,
ডাকো। (১৯৪৯)
প্রত্যাশা
আমি এখনো বিশ্বাস করি আমি জীবনে ফিরে যাব
একদিন, ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে উঠব
আলোকোজ্জ্বল প্রথম প্রহরে, যখন স্বচ্ছ শিশিরের
ফোঁটা সাজায় বৃক্ষের শাখা
ছোট্ট খাল হয়ে যায় সূর্য শিশিরের আধার
মেঘের দ্রুত ওড়াউড়ির প্রতিবিম্ব ঘটায়
আর আমার তরুণ মুখাবয়ব নিয়ে আমি যেন
কোনো বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে আছি, তেমনি চোখ রাখি
জলবিন্দুর ওপর, ভাঙনের অশ্রু প্রবাহিত হবে, সেখানে
সারা বিশ্বই দেখা যাবে, প্রসারিত এবং দূরে।
আমি এখনো বিশ্বাস করি একদিন সকালে
ঝিলিক দেওয়া শৈত্যে, আবার আমার কাছে,
দারিদ্র্যে ফিরে আসবে আবার
আমার নিরানন্দ প্রজ্ঞার কাছে
আনন্দ উৎসব করতে নয়, এবং ফোঁপাতেও নয়...। (১৯৪৯)
(ড্যানিয়েল ওয়েইসবোর্টের ইংরেজি অনুবাদ থেকে অনূদিত।)
===============================
গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি:লেজুড়বৃত্তির অবসান আজ জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার  কৃষি আলোচনা- 'কৃষিজমি রক্ষার দায় সবার' by আফতাব চৌধুরী  শিল্পি- 'আমি যে গান গেয়েছিলেম...কলিম শরাফী' by জাহীদ রেজা নূর  আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন সন্ত্রাস'  সাহিত্যালোচনা- 'মারিও ভার্গাস ইয়োসা'র সাহিত্যে নোবেলের রাজনৈতিক মোড়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'জনগণ ও সেনাবাহিনীর বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতা by নূরুল কবীর  রাজনৈতিক আলোচনা- 'নির্মানবীয় রাজনীতি ও জনসমাজের বিপজ্জনক নীরবতা by নূরুল কবীর  আলোচনা- 'সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী অভিযান by নূরুল কবীর  খাদ্য আলোচনা- 'খাদ্য উৎপাদনের বাধা দূর করাই ক্ষুধার বিরোদ্ধে প্রধান সংগ্রাম' by ফরিদা আক্তার  রাজনৈতিক আলোচনা- ' কোন পথে ক্ষমতা! হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই   আলোচনা- 'শিল্পনীতি-২০১০:সামর্থ্যের অপব্যবহারে পঙ্গ  আলোচনা- যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষাকারী ইসরাইল লবি ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাক by ফরহাদ মাহমুদ  আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব  ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্য
লেখক, ভূমিকা ও অনুবাদঃ আন্দালিব রাশদী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.