বাহাত্তরের নথিপত্র গায়েব
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় দেড় শ বছর আগে আক্ষেপ করেছিলেন, ‘বাঙালির ইতিহাস নাই।’ আজও সে কথা সত্য। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্যপ্রমাণসমৃদ্ধ ইতিহাস এ পর্যন্ত রচিত হয়নি। যেসব দলিল, স্মারক ও উপাদান দিয়ে সেই ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হতে পারত, সেসবও খুইয়ে ফেলা হয়েছে। তারই প্রমাণ বাহাত্তর সালে সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত অজস্র নথিপত্র হারিয়ে ফেলার ঘটনা। প্রতীয়মান হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় স্মৃতিহীনতাতেই অভ্যস্ত আমরা, স্মৃতি রক্ষায় নয়।
রাষ্ট্রীয় নথিপত্রগুলো সংরক্ষণের অভাবে বিনষ্ট, বিস্মৃত ও বিপন্ন হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সেই সব মূল্যবান নথিপত্র হারিয়ে যাওয়া জাতির অপূরণীয় ক্ষতি। এসব সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের—সংসদ সচিবালয়ে নেই, জাতীয় মহাফেজখানায় নেই, আইন মন্ত্রণালয়েও নেই। দেখা যাবে, এখন সবাই অভ্যাসমতো একে অন্যকে দোষারোপ করেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে।
স্বাধীনতার পরপরই শুরু হয়ে গিয়েছিল সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া। অনেক বৈঠক হয়, আসে অজস্র মতামত, নেওয়া হয় মৌলিক অনেক সিদ্ধান্ত। এতে জড়িত হন রাজনীতিবিদ, আইনবিশারদ, জনপ্রতিনিধি, লেখক-শিল্পীসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষ। সেই মহান কর্মযজ্ঞের স্মৃতি ও প্রমাণ বহন করেছিল কাগজের অজস্র পৃষ্ঠা। এসব নথিপত্র ছাড়া পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় আইন ও সংবিধানের বিবর্তনের ধারাকেও উপলব্ধি করা। এ জন্যই বাহাত্তর সালের সেই সব মহামূল্যবান দলিল সংরক্ষণ খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু সব সম্ভবের দেশে এগুলো কারও ঔদাসীন্যে নষ্ট হয়েছে অথবা কেউ কেউ তা সের দরে বিক্রি করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক দলিলপত্র নিখোঁজ রয়েছে। লাপাত্তা হয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধ-সম্পর্কিত অনেক দলিলপত্র। এমনকি স্বাধীনতার মূল ঘোষণার হাতে লেখা কপিটিও নিরুদ্দেশ রয়েছে। অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে এবং এখনো হারাচ্ছে।
জাতীয়ভাবে দলিল সংরক্ষণের কোনো নীতি এ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। এমন আইন নেই, যার দ্বারা নথিপত্রে বিধৃত ইতিহাস সংরক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব। সংরক্ষণ ও ইতিহাসনিষ্ঠার বদলে আমরা বরং ভুলে যেতে, ভুলিয়ে দিতে এবং প্রমাণ নষ্ট করতেই পারদর্শী। এই মানসিকতারও পরিবর্তন প্রয়োজন।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক হেগেল বলেছিলেন, প্রাচ্যের ইতিহাস নেই, তারা ইতিহাসের উপাদান মাত্র। এর জবাবেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালির নিজস্ব জাতীয় ইতিহাস রচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠেছিল, ‘কে লিখিবে?’ তিনি উত্তর করেছিলেন, ‘তুমি লিখিবে আমি লিখিব সে লিখিবে।’ তাঁর এই লেখার প্রায় শতবর্ষ পরে জানা যাচ্ছে, ‘আমি, তুমি, সে’ মিলে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের উপাদানগুলো আমরা সংরক্ষণ করতে পারিনি। বরং ‘আমি, তুমি, সে’ মিলে আমরা সেই সুযোগ নষ্ট করছি। এর চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?
এভাবে রাষ্ট্রের দালিলিক প্রমাণাদি খুইয়ে ফেলার মতো কাজ যারা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে হারানো সম্পদ খুঁজে বের করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হোক। ইতিহাসের মৌলিক উপাদান ও তথ্যপ্রমাণ সংরক্ষণে যত্নশীল হওয়ার কোনো বিকল্প আছে কি?
জাতীয় মহাফেজখানাকে আধুনিক ও ইতিহাসবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে, বানাতে হবে আইন। নইলে বঙ্কিমের সেই আক্ষেপই আরও শতবর্ষজুড়ে প্রতিধ্বনিত হবে যে ‘বাঙালির ইতিহাস নাই।’
রাষ্ট্রীয় নথিপত্রগুলো সংরক্ষণের অভাবে বিনষ্ট, বিস্মৃত ও বিপন্ন হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সেই সব মূল্যবান নথিপত্র হারিয়ে যাওয়া জাতির অপূরণীয় ক্ষতি। এসব সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের—সংসদ সচিবালয়ে নেই, জাতীয় মহাফেজখানায় নেই, আইন মন্ত্রণালয়েও নেই। দেখা যাবে, এখন সবাই অভ্যাসমতো একে অন্যকে দোষারোপ করেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করবে।
স্বাধীনতার পরপরই শুরু হয়ে গিয়েছিল সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া। অনেক বৈঠক হয়, আসে অজস্র মতামত, নেওয়া হয় মৌলিক অনেক সিদ্ধান্ত। এতে জড়িত হন রাজনীতিবিদ, আইনবিশারদ, জনপ্রতিনিধি, লেখক-শিল্পীসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষ। সেই মহান কর্মযজ্ঞের স্মৃতি ও প্রমাণ বহন করেছিল কাগজের অজস্র পৃষ্ঠা। এসব নথিপত্র ছাড়া পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় আইন ও সংবিধানের বিবর্তনের ধারাকেও উপলব্ধি করা। এ জন্যই বাহাত্তর সালের সেই সব মহামূল্যবান দলিল সংরক্ষণ খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু সব সম্ভবের দেশে এগুলো কারও ঔদাসীন্যে নষ্ট হয়েছে অথবা কেউ কেউ তা সের দরে বিক্রি করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক দলিলপত্র নিখোঁজ রয়েছে। লাপাত্তা হয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধ-সম্পর্কিত অনেক দলিলপত্র। এমনকি স্বাধীনতার মূল ঘোষণার হাতে লেখা কপিটিও নিরুদ্দেশ রয়েছে। অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে এবং এখনো হারাচ্ছে।
জাতীয়ভাবে দলিল সংরক্ষণের কোনো নীতি এ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। এমন আইন নেই, যার দ্বারা নথিপত্রে বিধৃত ইতিহাস সংরক্ষণ নিশ্চিত করা সম্ভব। সংরক্ষণ ও ইতিহাসনিষ্ঠার বদলে আমরা বরং ভুলে যেতে, ভুলিয়ে দিতে এবং প্রমাণ নষ্ট করতেই পারদর্শী। এই মানসিকতারও পরিবর্তন প্রয়োজন।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক হেগেল বলেছিলেন, প্রাচ্যের ইতিহাস নেই, তারা ইতিহাসের উপাদান মাত্র। এর জবাবেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালির নিজস্ব জাতীয় ইতিহাস রচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠেছিল, ‘কে লিখিবে?’ তিনি উত্তর করেছিলেন, ‘তুমি লিখিবে আমি লিখিব সে লিখিবে।’ তাঁর এই লেখার প্রায় শতবর্ষ পরে জানা যাচ্ছে, ‘আমি, তুমি, সে’ মিলে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের উপাদানগুলো আমরা সংরক্ষণ করতে পারিনি। বরং ‘আমি, তুমি, সে’ মিলে আমরা সেই সুযোগ নষ্ট করছি। এর চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?
এভাবে রাষ্ট্রের দালিলিক প্রমাণাদি খুইয়ে ফেলার মতো কাজ যারা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে হারানো সম্পদ খুঁজে বের করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হোক। ইতিহাসের মৌলিক উপাদান ও তথ্যপ্রমাণ সংরক্ষণে যত্নশীল হওয়ার কোনো বিকল্প আছে কি?
জাতীয় মহাফেজখানাকে আধুনিক ও ইতিহাসবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে, বানাতে হবে আইন। নইলে বঙ্কিমের সেই আক্ষেপই আরও শতবর্ষজুড়ে প্রতিধ্বনিত হবে যে ‘বাঙালির ইতিহাস নাই।’
No comments