সেন্সরশিপের প্রতি গভীর প্রেম by আশীষ নন্দী
প্রায় আড়াই শ বছর আগে স্যামুয়েল জনসন বলেছিলেন, ‘দুরাচারের শেষ আশ্রয় দেশপ্রেম।’ কথাটি একালে ভারতের ক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে খাটে। কাশ্মীরবিষয়ক এক সভায় অরুন্ধতী যে বক্তব্য দিলেন, এর জন্য দেশদ্রোহের অভিযোগ তুলে তাঁর গ্রেপ্তার ও বিচারের যে হুমকি দেওয়া হলো, তা অন্য কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। সেই সভায় সৈয়দ আলী গিলানিও বক্তব্য দিয়েছিলেন। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না, তবে পরে অরুন্ধতী যে হূদয়কাড়া কৈফিয়ত দিয়েছেন, তা পড়েছি। এতে একদিকে যেমন গর্ব বোধ করেছি, অন্যদিকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়েছি। আমি মনোবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পেশাগত নানা সীমাবদ্ধতা আছে। সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে এমন স্পষ্ট ভাষায় ও সাবলীলভাবে আমি বলতে পারতাম না। তিনি যা বলেছেন, তাতে একদিকে যেমন অধিকতর গণতান্ত্রিক ভারতের আকুতি আছে, অন্যদিকে আছে ভারতবাসীর অধিকতর মানবিক ভবিষ্যতের ভাবনা।
দুই বছর আগে আমি একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। তখন টাইমস অব ইন্ডিয়ায় এক কলাম লিখেছিলাম, যার বিষয়বস্তু ২০০২ সালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংঘবদ্ধ আক্রমণের দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক পরিণতি। লেখাটি ছিল গুজরাটের পরিবর্তনশীল মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির ওপর শাণিত আঘাত। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উসকে দেওয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে সমন জারি করা হলো। অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের জন্য আমাকে সুপ্রিম কোর্টে যেতে হলো। পুলিশের সমন বাতিল করাতে হলো। তবে সেই মামলা চলছে তো চলছেই; যদিও অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্টই বলেছেন যে আমার নিবন্ধে আপত্তিকর কিছুই পাওয়া যায়নি। টাইমস অব ইন্ডিয়ার আহমেদাবাদ সংস্করণ সম্পাদক অবশ্য ততটা ভাগ্যবান ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দাখিল করা হলো।
আমি খুব আশ্চর্য হব, যদি অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগকে এর যৌক্তিক পরিণতি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। গিলানির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে শতাধিক রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঝুলছে। তাই আরেকটি মামলায় হয়তো বিশেষ ফারাক হবে না। তবে সরকার হয়তো শেষ অবলম্বন হিসেবে বহু পরীক্ষিত প্রথাগত পথই অনুসরণ করতে পারে এবং আয়কর আইনের মাধ্যমে অবাধ্য বিরোধীদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারে। জনগণ কখনো আয়কর কর্মীদের পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। তখন তো তাঁদের প্রতি ততটাই অবিশ্বাস তৈরি হবে, যতটা রয়েছে ক্রিমিনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) প্রতি।
ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের সামনে ভারতীয়রা নিজেদের হাস্যাস্পদ বানিয়েছে। এই কাণ্ডটি ঘটেছে অরুন্ধতী ও গিলানির সেই সভায় কিছু ব্যক্তির বিক্ষোভ প্রদর্শনের কারণে। সভায় উপস্থিত কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছি, গিলানি একবারও ‘বিচ্ছিন্নতা’ (secession) শব্দটি উচ্চারণ করেননি, এমনকি আজাদির একটি নরমভাবাপন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁর হাজির করা অ্যাজেন্ডা ছিল সব দিক থেকেই সংযত। এটা কি ভারত সরকারের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছানোর পন্থা? এর কতটুকু ঠান্ডা মাথার জনসংযোগ আর কতটুকুই বা কাশ্মীরকে ঘিরে রাজনৈতিক সম্ভাবনার চতুর খেলা?
আমরা কখনোই তা জানব না। কারণ, আমাদের মাঝে যাঁরা আজ রাজনীতিক বলে পরিচিত আর যাঁরা জ্ঞানরোধী বাবু, তাঁরা গণযোগাযোগের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে অক্ষম। মুক্ত সমাজে বাকস্বাধীনতা আর মুক্ত গণমাধ্যমের কী ভূমিকা, তা জানার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত তাঁরা নন। অধিকতর সহমর্মী ও মানবিক সমাজের দাবি জানানোও ইতিমধ্যে বিপজ্জনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, সেই দাবি তোলার অর্থ সমকালীন ভারত ও এর চালকদের গুরুতর সমালোচনা। এমন সমালোচনাকেই এখন জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং বিভক্তি সৃষ্টিকারী বলে অভিহিত করা হচ্ছে। অরুন্ধতীর ক্ষেত্রে অবশ্যই বিজেপি চলমান বিতর্কে গতির সঞ্চার করছে এবং সেন্সরশিপের জন্য যুক্তির বিস্তার করছে। কিন্তু এর সঙ্গে আমি যোগ করব, এই প্রতিযোগিতায় কংগ্রেসও হার মানতে চায় না। বিজেপির চেয়ে কংগ্রেস বেশি জাতীয়তাবাদী—তা দেখানোতেই কংগ্রেসের উৎসাহ বেশি।
গত দুই দশকে ভারতে এক নব্য মধ্যম শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে, যাদের হাতে অর্থ এসেছে কিন্তু মধ্যম শ্রেণীর মূল্যবোধ আসেনি। কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ই তাদের মন জয়ের চেষ্টায় রত। এই নব্য মধ্যম শ্রেণী তাদের অন্তঃসারশূন্য জীবনকে সহিংস, উনিশ শতকের ইউরোপীয় ধাঁচের ‘জাতীয়তাবাদ’-এর মাধ্যমে অর্থপূর্ণ করতে চায়। অন্যের পাশাপাশি নিজেদেরও দেখাতে চায়, যে ব্যবস্থায় তারা উপনীত, সেখানে তাদেরও শরিকানা আছে। তাদের ভয়, জাতীয়তাবাদের এই নোংরা সংস্করণের বৈধতার প্রশ্নে সামান্যতম আঁচড় লাগলে তা তাদের নতুন লব্ধ সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। ‘ভারতমাতা’র মহিমা রক্ষার্থে তারা কাউকে ছাড় দেবে না—ভারতের সর্বশেষ বিরুদ্ধবাদী পর্যন্ত তারা এই লড়াইকে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই তেমন কিছু করতে বাধ্য হয়। চোখের সামনে তারা দেখছে, তাদের ড্রয়িং রুমের ভেতর নিরাপদে ও আরামে উন্মোচিত হয়ে চলেছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, ঠিক যেমন করে টেলিভিশনের পর্দায় উন্মোচিত হয় মুম্বাইয়ের কোনো মারদাঙ্গা সিনেমা।
তাই এই দুর্দিন, এই অসহিষ্ণুতা। এটা শুধু অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধেই নয়, যারাই ভারতের মূল স্রোতের মন ও তার জাতীয়তাবাদের পরোয়া না করার স্পর্ধা দেখিয়ে তাদের আরামের ব্যাঘাত ঘটায় তাদের বিরুদ্ধেও। এমনকি অহিংস পথে লড়াই চালিয়ে যাওয়া গান্ধীবাদীরাও রেহাই পান না। দান্তেওয়াড়ায় হিমাংশু কুমারের আশ্রম কোনো মাওবাদী ধ্বংস করেনি, করেছে পুলিশ। আমি ভাবতাম, মুক্ত সমাজে লেখক-শিল্পীরা সেন্সরশিপের খড়্গের বাইরে থাকবেন। কিন্তু আমরা ভালোভাবেই জানি, তা নয়। তসলিমা নাসরিনকে থামাতে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস এক স্বরে বলল, তিনি ভারতীয় নন। যেন আপনি যদি ভারতে বসবাসকারী অভারতীয় হোন, তাহলে আপনার অধিকারগুলো ভারতের সংবিধান দ্বারা চালিত হবে না!
‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ লেখালেখি ও কর্মকাণ্ডের কথা বলে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের হয়রানির প্রবণতা শুরু হয়েছে অনেক আগে। ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগ জাতীয় স্বার্থ বিষয়ে মতৈক্য ভেঙে পড়ার সময়। ইন্দিরা গান্ধী তখন জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং গুরুতর সেন্সরশিপ ও নজরদারির ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি দাবি করেন, এসবই জাতীয় স্বার্থ, গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। ১৯৭০-এর দশক এবং একবিংশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে পার্থক্য হলো, এখন কোটি কোটি মানুষ নানা ভাবে ভিন্নমত জানাচ্ছে এবং মূল স্রোতের জনমতের সঙ্গে তাদের মতের আমূল পার্থক্যকে স্পষ্ট করতে সরব হচ্ছে। পুরো উপজাতীয় আন্দোলন তার উদাহরণ।
কিছু কিছু সময় আছে, যখন জাতীয় মতৈক্য সম্ভব নয়, কাঙ্ক্ষিতও নয়। তখন সর্বোচ্চ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়া যায়। কাশ্মীরিদের ক্ষেত্রে এ কাজ হয়তো সহজ হবে না। ভারত সরকারের প্রতি তাদের আস্থা এখন শূন্যের কোঠায়। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাশ্মীরিরা ইতিমধ্যে ভারতের বাইরে চলে গেছে। অন্তত দুই প্রজন্মে এই মনোভাবের পরিবর্তন হবে না। এলোপাতাড়ি হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও নিত্যনতুন উপায়ে নৃশংসতা চালানোর ফলে তাদের সমাজও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। মনে প্রচণ্ড চোট নিয়ে তাদের বসবাস করতে হচ্ছে। এ বক্তব্য যদি আপনার কাছে অত্যন্ত রূঢ় মনে হয়, তাহলে কাশ্মীর প্রসঙ্গে মনোরোগ চিকিৎসক শোভনা সোনপারের প্রতিবেদনটি খুঁটিয়ে পড়ে দেখতে পারেন।
আজকের ভারতীয় রাজনীতির সংস্কৃতিতে কী হচ্ছে যে তা এতটা নিষ্ঠুর, আত্মপ্রত্যয়ী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে? আমরা নিজেরা কি এতই নিষ্ঠুর হয়ে গেছি যে চারপাশের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে আমাদের অনুভূতি একেবারে ভোঁতা হয়ে গেছে? ভারতের ঐক্যের ধারণাটাই বা কী, যা ভারতবাসীকে বাধ্য করে পুলিশের নৃশংসতা ও নির্যাতনে সমর্থন দিতে? দেশের পুলিশ, আধা সামরিক ও সামরিক বাহিনীর সামর্থ্য সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সরকারের স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও তারা কেমন করে নির্যাতনবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর ঠেকিয়ে রাখতে পারে? স্বাধীনতার ৬০ বছর পরও আমরা কেমন করে এনকাউন্টারে মৃত্যুকে সমর্থন দিয়ে যেতে পারি? ভারতের দাম্ভিক মধ্যম শ্রেণীর বড় এক অংশকে যদি গণতন্ত্রের দাবির প্রতি পুরোপুরি সংবেদনশীল করা যেত, তাহলে কি এসব অনুশীলন এত দিন টিকতে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারত?
প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রীতিকর নয়। আমরা ভালো করেই জানি, বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায়, গণমাধ্যম ও শিল্পী-সমাজ যদি তাদের কাজটি ঠিকমতো করত, তাহলে আজকের এই অবস্থা হতো না। মধ্যম শ্রেণীর পরিবর্তনশীল চরিত্র সহায়ক হয়নি।
ভারতবাসী তাদের গণতন্ত্র নিয়ে গর্বিত—গণতন্ত্রের ব্যাপারে এখনো মতৈক্য আছে। কিন্তু তারা যে গুরুতর স্ববিরোধের মধ্যে রয়েছে, সে ব্যাপারে সচেতন নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নতুন মধ্যম শ্রেণী সৃষ্টি করেছে, যার বড় এক অংশ গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। গরিব এবং অপেক্ষাকৃত পাকাপোক্ত অবস্থানের মধ্যম শ্রেণী ভাবনাহীন, আত্মসমালোচনাহীন উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বিরোধী মতের প্রতি অসহিষ্ণু রাজনীতিকে নিজের রাজনীতি মনে করে না। সাধারণ ভারতীয়রা অসামান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে বাস করতে অভ্যস্ত। রাজনৈতিক বৈচিত্র্য তাদের নিকট সমস্যা হিসেবে হাজির হয় না। পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসা মধ্যম শ্রেণীর ক্ষেত্রেও তা-ই।
উদাহরণ হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধের প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। প্রবন্ধটিতে উনিশ শতকের মধ্যভাগে মধ্যম শ্রেণী আক্রমণে জর্জরিত হয়েছে। স্কুলে প্রবন্ধটি আমাদের পড়তে হয়েছিল। এক শতকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্যবইতে এ প্রবন্ধ আছে। আজকের দিনে এমন লেখা পাঠ্য করতে গেলে ভারতের অনেক জায়গাতেই রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হবে এবং সেন্সরশিপের দাবি উঠবে।
সম্প্রতি ভারতের তথ্য কমিশনের আয়োজনে এক বক্তৃতায় আমি বলেছিলাম, ভারতে সেন্সরশিপ ও নজরদারির ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। এটি শুধু সরকারের পছন্দনীয় নয়, মধ্যম শ্রেণীর বড় অংশও তাদের অপছন্দের লেখক, শিল্পী, নাট্যকার, পণ্ডিত ও চিন্তকদের কণ্ঠ রোধ করতে চায়। বিশ্বায়িত মধ্যম শ্রেণী হয়ে ওঠার চেষ্টায় তারা নিজেদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস এবং ভাষাও বদলে ফেলতে রাজি, কিন্তু সেন্সরশিপের প্রতি ভালোবাসা নয়। ভাগ্য ভালো যে আমাদের মধ্যে এখনো এমন কিছু মানুষ আছেন (সম্পাদক, রাজনৈতিক কর্মী, এনজিও, আইনজীবী ও বিচারপতি), যাঁদের কাছে বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের কোনো প্রান্তীয় বিবেচ্য কিংবা বুর্জোয়া গুণ নয়, বরং সভ্য সমাজ হিসেবে টিকে থাকার সূত্র।
ভারতের আউটলুক ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আশীষ নন্দী: ভারতীয় রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের সমাজতাত্ত্বিক।
দুই বছর আগে আমি একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। তখন টাইমস অব ইন্ডিয়ায় এক কলাম লিখেছিলাম, যার বিষয়বস্তু ২০০২ সালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংঘবদ্ধ আক্রমণের দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক পরিণতি। লেখাটি ছিল গুজরাটের পরিবর্তনশীল মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির ওপর শাণিত আঘাত। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উসকে দেওয়ার জন্য আমার বিরুদ্ধে সমন জারি করা হলো। অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের জন্য আমাকে সুপ্রিম কোর্টে যেতে হলো। পুলিশের সমন বাতিল করাতে হলো। তবে সেই মামলা চলছে তো চলছেই; যদিও অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্টই বলেছেন যে আমার নিবন্ধে আপত্তিকর কিছুই পাওয়া যায়নি। টাইমস অব ইন্ডিয়ার আহমেদাবাদ সংস্করণ সম্পাদক অবশ্য ততটা ভাগ্যবান ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দাখিল করা হলো।
আমি খুব আশ্চর্য হব, যদি অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগকে এর যৌক্তিক পরিণতি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। গিলানির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে শতাধিক রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঝুলছে। তাই আরেকটি মামলায় হয়তো বিশেষ ফারাক হবে না। তবে সরকার হয়তো শেষ অবলম্বন হিসেবে বহু পরীক্ষিত প্রথাগত পথই অনুসরণ করতে পারে এবং আয়কর আইনের মাধ্যমে অবাধ্য বিরোধীদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে পারে। জনগণ কখনো আয়কর কর্মীদের পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। তখন তো তাঁদের প্রতি ততটাই অবিশ্বাস তৈরি হবে, যতটা রয়েছে ক্রিমিনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) প্রতি।
ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের সামনে ভারতীয়রা নিজেদের হাস্যাস্পদ বানিয়েছে। এই কাণ্ডটি ঘটেছে অরুন্ধতী ও গিলানির সেই সভায় কিছু ব্যক্তির বিক্ষোভ প্রদর্শনের কারণে। সভায় উপস্থিত কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছি, গিলানি একবারও ‘বিচ্ছিন্নতা’ (secession) শব্দটি উচ্চারণ করেননি, এমনকি আজাদির একটি নরমভাবাপন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাঁর হাজির করা অ্যাজেন্ডা ছিল সব দিক থেকেই সংযত। এটা কি ভারত সরকারের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছানোর পন্থা? এর কতটুকু ঠান্ডা মাথার জনসংযোগ আর কতটুকুই বা কাশ্মীরকে ঘিরে রাজনৈতিক সম্ভাবনার চতুর খেলা?
আমরা কখনোই তা জানব না। কারণ, আমাদের মাঝে যাঁরা আজ রাজনীতিক বলে পরিচিত আর যাঁরা জ্ঞানরোধী বাবু, তাঁরা গণযোগাযোগের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে অক্ষম। মুক্ত সমাজে বাকস্বাধীনতা আর মুক্ত গণমাধ্যমের কী ভূমিকা, তা জানার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত তাঁরা নন। অধিকতর সহমর্মী ও মানবিক সমাজের দাবি জানানোও ইতিমধ্যে বিপজ্জনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, সেই দাবি তোলার অর্থ সমকালীন ভারত ও এর চালকদের গুরুতর সমালোচনা। এমন সমালোচনাকেই এখন জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং বিভক্তি সৃষ্টিকারী বলে অভিহিত করা হচ্ছে। অরুন্ধতীর ক্ষেত্রে অবশ্যই বিজেপি চলমান বিতর্কে গতির সঞ্চার করছে এবং সেন্সরশিপের জন্য যুক্তির বিস্তার করছে। কিন্তু এর সঙ্গে আমি যোগ করব, এই প্রতিযোগিতায় কংগ্রেসও হার মানতে চায় না। বিজেপির চেয়ে কংগ্রেস বেশি জাতীয়তাবাদী—তা দেখানোতেই কংগ্রেসের উৎসাহ বেশি।
গত দুই দশকে ভারতে এক নব্য মধ্যম শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে, যাদের হাতে অর্থ এসেছে কিন্তু মধ্যম শ্রেণীর মূল্যবোধ আসেনি। কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ই তাদের মন জয়ের চেষ্টায় রত। এই নব্য মধ্যম শ্রেণী তাদের অন্তঃসারশূন্য জীবনকে সহিংস, উনিশ শতকের ইউরোপীয় ধাঁচের ‘জাতীয়তাবাদ’-এর মাধ্যমে অর্থপূর্ণ করতে চায়। অন্যের পাশাপাশি নিজেদেরও দেখাতে চায়, যে ব্যবস্থায় তারা উপনীত, সেখানে তাদেরও শরিকানা আছে। তাদের ভয়, জাতীয়তাবাদের এই নোংরা সংস্করণের বৈধতার প্রশ্নে সামান্যতম আঁচড় লাগলে তা তাদের নতুন লব্ধ সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। ‘ভারতমাতা’র মহিমা রক্ষার্থে তারা কাউকে ছাড় দেবে না—ভারতের সর্বশেষ বিরুদ্ধবাদী পর্যন্ত তারা এই লড়াইকে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই তেমন কিছু করতে বাধ্য হয়। চোখের সামনে তারা দেখছে, তাদের ড্রয়িং রুমের ভেতর নিরাপদে ও আরামে উন্মোচিত হয়ে চলেছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, ঠিক যেমন করে টেলিভিশনের পর্দায় উন্মোচিত হয় মুম্বাইয়ের কোনো মারদাঙ্গা সিনেমা।
তাই এই দুর্দিন, এই অসহিষ্ণুতা। এটা শুধু অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধেই নয়, যারাই ভারতের মূল স্রোতের মন ও তার জাতীয়তাবাদের পরোয়া না করার স্পর্ধা দেখিয়ে তাদের আরামের ব্যাঘাত ঘটায় তাদের বিরুদ্ধেও। এমনকি অহিংস পথে লড়াই চালিয়ে যাওয়া গান্ধীবাদীরাও রেহাই পান না। দান্তেওয়াড়ায় হিমাংশু কুমারের আশ্রম কোনো মাওবাদী ধ্বংস করেনি, করেছে পুলিশ। আমি ভাবতাম, মুক্ত সমাজে লেখক-শিল্পীরা সেন্সরশিপের খড়্গের বাইরে থাকবেন। কিন্তু আমরা ভালোভাবেই জানি, তা নয়। তসলিমা নাসরিনকে থামাতে সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস এক স্বরে বলল, তিনি ভারতীয় নন। যেন আপনি যদি ভারতে বসবাসকারী অভারতীয় হোন, তাহলে আপনার অধিকারগুলো ভারতের সংবিধান দ্বারা চালিত হবে না!
‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ লেখালেখি ও কর্মকাণ্ডের কথা বলে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের হয়রানির প্রবণতা শুরু হয়েছে অনেক আগে। ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগ জাতীয় স্বার্থ বিষয়ে মতৈক্য ভেঙে পড়ার সময়। ইন্দিরা গান্ধী তখন জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং গুরুতর সেন্সরশিপ ও নজরদারির ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তিনি দাবি করেন, এসবই জাতীয় স্বার্থ, গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। ১৯৭০-এর দশক এবং একবিংশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে পার্থক্য হলো, এখন কোটি কোটি মানুষ নানা ভাবে ভিন্নমত জানাচ্ছে এবং মূল স্রোতের জনমতের সঙ্গে তাদের মতের আমূল পার্থক্যকে স্পষ্ট করতে সরব হচ্ছে। পুরো উপজাতীয় আন্দোলন তার উদাহরণ।
কিছু কিছু সময় আছে, যখন জাতীয় মতৈক্য সম্ভব নয়, কাঙ্ক্ষিতও নয়। তখন সর্বোচ্চ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়া যায়। কাশ্মীরিদের ক্ষেত্রে এ কাজ হয়তো সহজ হবে না। ভারত সরকারের প্রতি তাদের আস্থা এখন শূন্যের কোঠায়। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাশ্মীরিরা ইতিমধ্যে ভারতের বাইরে চলে গেছে। অন্তত দুই প্রজন্মে এই মনোভাবের পরিবর্তন হবে না। এলোপাতাড়ি হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও নিত্যনতুন উপায়ে নৃশংসতা চালানোর ফলে তাদের সমাজও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। মনে প্রচণ্ড চোট নিয়ে তাদের বসবাস করতে হচ্ছে। এ বক্তব্য যদি আপনার কাছে অত্যন্ত রূঢ় মনে হয়, তাহলে কাশ্মীর প্রসঙ্গে মনোরোগ চিকিৎসক শোভনা সোনপারের প্রতিবেদনটি খুঁটিয়ে পড়ে দেখতে পারেন।
আজকের ভারতীয় রাজনীতির সংস্কৃতিতে কী হচ্ছে যে তা এতটা নিষ্ঠুর, আত্মপ্রত্যয়ী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে? আমরা নিজেরা কি এতই নিষ্ঠুর হয়ে গেছি যে চারপাশের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে আমাদের অনুভূতি একেবারে ভোঁতা হয়ে গেছে? ভারতের ঐক্যের ধারণাটাই বা কী, যা ভারতবাসীকে বাধ্য করে পুলিশের নৃশংসতা ও নির্যাতনে সমর্থন দিতে? দেশের পুলিশ, আধা সামরিক ও সামরিক বাহিনীর সামর্থ্য সম্পর্কে গণতান্ত্রিক সরকারের স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও তারা কেমন করে নির্যাতনবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর ঠেকিয়ে রাখতে পারে? স্বাধীনতার ৬০ বছর পরও আমরা কেমন করে এনকাউন্টারে মৃত্যুকে সমর্থন দিয়ে যেতে পারি? ভারতের দাম্ভিক মধ্যম শ্রেণীর বড় এক অংশকে যদি গণতন্ত্রের দাবির প্রতি পুরোপুরি সংবেদনশীল করা যেত, তাহলে কি এসব অনুশীলন এত দিন টিকতে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারত?
প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রীতিকর নয়। আমরা ভালো করেই জানি, বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায়, গণমাধ্যম ও শিল্পী-সমাজ যদি তাদের কাজটি ঠিকমতো করত, তাহলে আজকের এই অবস্থা হতো না। মধ্যম শ্রেণীর পরিবর্তনশীল চরিত্র সহায়ক হয়নি।
ভারতবাসী তাদের গণতন্ত্র নিয়ে গর্বিত—গণতন্ত্রের ব্যাপারে এখনো মতৈক্য আছে। কিন্তু তারা যে গুরুতর স্ববিরোধের মধ্যে রয়েছে, সে ব্যাপারে সচেতন নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নতুন মধ্যম শ্রেণী সৃষ্টি করেছে, যার বড় এক অংশ গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। গরিব এবং অপেক্ষাকৃত পাকাপোক্ত অবস্থানের মধ্যম শ্রেণী ভাবনাহীন, আত্মসমালোচনাহীন উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বিরোধী মতের প্রতি অসহিষ্ণু রাজনীতিকে নিজের রাজনীতি মনে করে না। সাধারণ ভারতীয়রা অসামান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে বাস করতে অভ্যস্ত। রাজনৈতিক বৈচিত্র্য তাদের নিকট সমস্যা হিসেবে হাজির হয় না। পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসা মধ্যম শ্রেণীর ক্ষেত্রেও তা-ই।
উদাহরণ হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধের প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। প্রবন্ধটিতে উনিশ শতকের মধ্যভাগে মধ্যম শ্রেণী আক্রমণে জর্জরিত হয়েছে। স্কুলে প্রবন্ধটি আমাদের পড়তে হয়েছিল। এক শতকেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের পাঠ্যবইতে এ প্রবন্ধ আছে। আজকের দিনে এমন লেখা পাঠ্য করতে গেলে ভারতের অনেক জায়গাতেই রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হবে এবং সেন্সরশিপের দাবি উঠবে।
সম্প্রতি ভারতের তথ্য কমিশনের আয়োজনে এক বক্তৃতায় আমি বলেছিলাম, ভারতে সেন্সরশিপ ও নজরদারির ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। এটি শুধু সরকারের পছন্দনীয় নয়, মধ্যম শ্রেণীর বড় অংশও তাদের অপছন্দের লেখক, শিল্পী, নাট্যকার, পণ্ডিত ও চিন্তকদের কণ্ঠ রোধ করতে চায়। বিশ্বায়িত মধ্যম শ্রেণী হয়ে ওঠার চেষ্টায় তারা নিজেদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস এবং ভাষাও বদলে ফেলতে রাজি, কিন্তু সেন্সরশিপের প্রতি ভালোবাসা নয়। ভাগ্য ভালো যে আমাদের মধ্যে এখনো এমন কিছু মানুষ আছেন (সম্পাদক, রাজনৈতিক কর্মী, এনজিও, আইনজীবী ও বিচারপতি), যাঁদের কাছে বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের কোনো প্রান্তীয় বিবেচ্য কিংবা বুর্জোয়া গুণ নয়, বরং সভ্য সমাজ হিসেবে টিকে থাকার সূত্র।
ভারতের আউটলুক ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আশীষ নন্দী: ভারতীয় রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের সমাজতাত্ত্বিক।
No comments