মানবাধিকার সুরক্ষায় করণীয় by আব্দুল কাইয়ুম
বলা বাহুল্য যে, নিজেদের তৈরি রাজনৈতিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়েই মানবাধিকারের এমন করুণ পরিণতি ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের অধিকার রক্ষায় থাকবে সোচ্চার, তারা এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত। আওয়ামী লীগ নিজ দলের স্বার্থেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। যার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। কথা উঠেছে র্যাব বিলুপ্তির। পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর জন্য মানবাধিকার প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে।
তবে এই সুপারিশ বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সময় কোথায়? আওয়ামী লীগের পতনের পর দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল এখন বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল)। তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আওয়াজ জোরালো হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদায়ের অপেক্ষাতেই রয়েছে দলটি। তাদের চাপ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইউনূস সরকার যে সংস্কারের পূর্ণাঙ্গ সময় পাচ্ছে না তা নিশ্চিত। তবে দেশে মানবাধিকার বলবৎ করতে হলে দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদে সংস্কার প্রক্রিয়া জারি রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এক্ষেত্রে তারা ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগকে অবর্ণনীয় সুযোগ হিসেবে দেখছেন। সময় নিয়ে হলেও মানবাধিকার সমুন্নত করার পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার না থাকলেও যেন এই সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান থাকে- সে লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আগামী মার্চে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক ওই মানবাধিকার সংস্থা।
দেশের সার্বিক রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যারাই সরকারে গিয়েছে তারাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে বিরোধী দলকে দমন করতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে গুমের নজির রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন এই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও বিকল্প শক্তির প্রয়োজন। বিশেষ করে মানবাধিকারকে সমুন্নত করে ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত করাই এখন রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। যার জন্য প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক শক্তির। এক্ষেত্রে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের মানুষের জন্য যুগান্তকারী একটি সুযোগ তৈরি করেছে। কেননা, এই আন্দোলন কেবল সরকার পতনের আন্দোলন নয়, বরং সকল বৈষম্য দূর করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার গভীর পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করেছে। বিগত সময়ে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের ফলেই পুলিশের তাজা বুলেটের সামনে বুক চেতিয়ে প্রতিরোধ গড়েছে ছাত্র-জনতা। এই প্রেক্ষাপটে দেশে মানবাধিকার পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এখন প্রয়োজনীয় বিষয়।
গত ১৫ বছরে দলীয়করণের ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যেগুলোর ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন। অন্যথায় দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যত্যয় ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে নতুন আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি অপরিহার্য। কেননা, জুলাই বিপ্লবের পর মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি’র উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। সমপ্রতি অনলাইন প্ল্যাটফরম ‘ডাক্কা রিভিউয়ের’ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেখা গেছে- মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি আসলে তেমন কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে ছাত্র সংগঠন-ছাত্রদলও ‘স্মার্ট পলিটিক্স’ করতে পারেনি। যার ফলে বিপ্লবের পরেও ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদলের অবস্থান খুব শক্তিশালীভাবে দেখা যায়নি। বিএনপি’র ৩১ দফা বেশ আশাব্যঞ্জক, ধরে নিলেও বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী বিরোধী শক্তি না থাকলে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ঠিক পথে রাখা কিংবা তারা বিপথে পরিচালিত হলে তাদের রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হয়ে পড়বে। আর বিএনপিকে মোকাবিলা করা কঠিন হলে দেশের মানবাধিকার আবারো চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই রাজনৈতিক সুশীলদের অনেকেই মনে করছেন দেশের রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করে জনগণের অধিকার সুরক্ষায় নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
No comments