গণপিটুনিতে জামায়াতের ২ কর্মী নিহত: চট্টগ্রামে কী ঘটেছিল সেদিন?

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জামায়াতের দুই কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, জামায়াতের এই কর্মীদেরকে  হত্যার ছক হিসেবে ডাকাতির নামে গণপিটুনির পরিবেশ তৈরি করেছে খুনিরা। এই ঘটনায় স্থানীয় সদ্য বরখাস্তকৃত আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের ভাই মমতাজ এবং হারুনও জড়িত রয়েছেন। সোমবার (৩রা মার্চ) রাত ১০টার দিকে উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় কমপক্ষে ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই ঘটনায় নিহতরা হলেন-  উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার মাহমুদুল হকের পুত্র  মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন (৪৫) ও একই ইউনিয়নের গুরগুরি এলাকার আবদুর রহমানের পুত্র মোহাম্মদ ছালেক (৩৫)। তারা চট্টগ্রাম শহরের ব্যবসায়ী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোমবার রাতে নিহত নেজামকে একটি পক্ষ বিরোধ মীমাংসার কথা বলে ছনখোলা এলাকায় ডেকে নিয়ে যায়। নেজাম তার ১৮-২০ জন অনুসারী নিয়ে সেখানে আসতেই মাইকে ডাকাত পড়েছে ঘোষণা দিয়ে দেয়া হয়। একপর্যায়ে স্থানীয় দেড় থেকে দুই শতাধিক মানু?ষ রাস্তায় নেমে আসে। এতে দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ওই সময় শতাধিক রাউন্ড গুলিও ছোড়া হয়। একপর্যায়ে নেজাম ও তার সহযোগী ছালেককে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় আরও  ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়। এদের মধ্যে  দুইজন নেজামের সহযোগী ছিলেন।

জানা যায়, নেজামুদ্দিন ও আবু ছালেক-দু’জনই  জামায়াতের কর্মী। এরমধ্যে ছালেক নেজামুদ্দিনের ঘনিষ্ঠ অনুসারী। নেজামুদ্দিন দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। জামায়াতের কোনো পদ- পদবিতে না থাকলেও এলাকায় তিনি জামায়াতের ‘নেতা’ বলে পরিচিত। এরমধ্যে ৫ই আগস্টের পর  কাঞ্চনাসহ কয়েকটি ইউনিয়নে তার বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠে। সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে তাকে কয়েকবার সতর্কও করা হয়।

নিহতদের লাশের সঙ্গে চমেক হাসপাতালে আসা হাশেম খান বলেন, তাদেরকে কেন হত্যা করা হয়েছে জানি না। তাদেরকে হত্যার খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসি। সেখানে ডাকাতির কোনো ঘটনা ঘটেনি। সম্পূর্ণ গুজব বিষয়টি। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

স্থানীয় নুর উদ্দিন বলেন, নেজামুদ্দিন কোনো ডাকাতির সঙ্গে জড়িত নয়। দীর্ঘদিন এলাকায় আসতে পারেননি আওয়ামী লীগের নির্যাতনের কারণে।
এদিকে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছেন, নিহত এই  দুই জামায়াত কর্মী জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের ফেসবুক আইডিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণের অসংখ্য ভিডিও এবং ছবি পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায় ছাত্র- জনতার মিছিলে অংশ নিয়েছেন তারা। আর নিজের মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করেছেন। ভিডিওতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা খান তালাত মাহমুদ রাফি ও চট্টগ্রামের সমন্বয়কদের দেখা গেছে।

সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি তারেক হোসাইন বলেন, নিহতরা আমাদের কর্মী। তাদেরকে একটি সালিশে অংশগ্রহণের কথা বলে ডেকে এনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় আমরা  আইনের আশ্রয় নেবো।

তবে  চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা  জামায়াতের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানিয়েছেন, নিহতরা জামায়াতের লিস্টেড কোনো কর্মী নন। তারা সংগঠনের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন  অপরাধে জড়িয়েছিলেন। এই নিয়ে গত মঙ্গলবারও নিহত নেজামকে ডেকে সতর্ক করা হয়েছে। যদিও নিহতরা দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ বলে জানিয়েছেন এই নেতা। এদিকে হত্যাকাণ্ডের ১২ ঘণ্টা পার হলেও পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। দায়ের করা হয়নি মামলা। একইসঙ্গে  দুই কর্মীকে হত্যার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে সাতকানিয়া জামায়াতের নেতাকর্মীরা।

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সাতকানিয়া থানার ওসি মো. জাহিদুল ইসলামকে একাধিকবার ফোনকল করা হলেও তারা সাড়া দেননি। পরে জানতে চাইলে ওই  থানার ওসি তদন্ত সুদীপ্ত রেজা বলেন, ডাবল মার্ডারের ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। খুব দ্রুত ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ঘটনাটি কি আসলে ডাকাতি নাকি  পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড- সেটা এখনই  বলতে পারছি না। যেহেতু মামলা তদন্তাধীন, তাই তদন্ত করে বলতে হবে।

এদিকে দুই কর্মী খুনের  সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াত। একইসঙ্গে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ‘বিভ্রান্তিকর’ সংবাদের প্রতিবাদ জানানো হয়। বিবৃতিতে জামায়াত নেতারা বলেন, গতকাল রাতের হত্যাকাণ্ড একটি পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা গ্রাম এটি বহু আগে থেকেই সন্ত্রাসকবলিত এলাকা। এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও সন্ত্রাসী নজরুল ইসলাম প্রকাশ মানিক চেয়ারম্যান ছনখোলা গ্রামের পাহাড়, পাহাড়ি গাছ ও ইটভাটা সমূহ নিয়ন্ত্রণে নিতে একাধিকবার সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অসংখ্য মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষের পাহাড়, ভূমি জবরদখল করেছিল।

জামায়াত নেতারা বলেন, এলাকার মানুষ তার (মানিক) অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বয়কট করে। তৎকালীন আওয়ামী সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতার কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনি। বিগত ৫ই আগস্ট ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতনের পর সে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করলেও তার বাহিনী ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মানিকের ভাই হারুন ও মমতাজের  প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই সন্ত্রাসীগণ এখনো নানা অপকর্মে জড়িত। তারা বলেন, গতরাতে পরিকল্পিত ভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী দুঃশাসনে নির্যাতিত ও ব্যবসায়ী নেজামুদ্দিন ও আবু ছালেককে বিচারের কথা বলে ডেকে এনে মাইকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ডাকাত আখ্যা দিয়ে মূলত গণপিটুনির নামে চেয়ারম্যান মানিকের নির্দেশে তার ভাই মমতাজ, হারুনের পরিকল্পনায় কুপিয়ে দুজনকে জঘন্যতম কায়দায় হত্যা করেছে, যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একইভাবে বিগত ২০১৬ সালে মানিক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জামায়াতের কর্মী বশরকে নির্মমভাবে ছনখোলাতে হত্যা করা হয়েছিল।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.