নবযাত্রার অপেক্ষায় বিএনপি -শওকত মাহমুদ
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিসৌধ থেকে সামান্য দূরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আজ বিএনপির পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনার বটমূলে জিয়াউর রহমানের দল ঘোষণার পর আজকের তারিখটি হতে পারে বিএনপির নয়া অভিযাত্রার, নব উদ্বোধনের।
‘নানান মানুষ নানান পথ, দেশ বাঁচাতে ঐক্যমত’ স্লোগান তুলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জাতীয় সম্মেলনকে জাতীয় সম্মিলনীতে বিকশিত করার ‘রংধনু’ প্রয়াস, এ উপলক্ষে তৃণমূল পর্যায় থেকে সাংগঠনিক সজীবতা এবং আয়োজনের প্রাণচাঞ্চল্য যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, নেতাদের বিশ্বাস—বাংলাদেশের সমকালীন লোক-চিন্তায় ও রাজনৈতিক অববাহিকায় এ অনুষ্ঠান সম্ভাবনার তরতাজা পলি ছড়াবে। বিএনপির রাজনীতিকে নেতির নেত্রে পরখ করেন না, এমন অভিজন সমাজের ধারণা হলো, এক-এগারোর পর থেকে রাষ্ট্র যেমন গণতন্ত্রে ও সার্বভৌমত্বে বিপন্ন হয়েছে, উপর্যুপরি দুই আমলের নিগ্রহে বিএনপি ততোধিক বিদীর্ণ। ১৬ বছর পর বিরোধী দলে থেকে এ কাউন্সিলকে সফল করা গেলে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে। এর পৌঁছ রাষ্ট্র-রাজনীতিতেও বিস্তৃত হবে, ‘তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে’।
ইতিমধ্যে বেগম খালেদা জিয়া আবারও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দেবে, দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে একজন রাজনৈতিক নেতার শীর্ষ জনপ্রিয়তা, তিনবারের কাউন্সিলে দলের প্রধান হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকা, দলকে দুবার ভোটে বিজয়ী করা এবং সর্বদা সর্বোচ্চ ভোটে সবচেয়ে বেশি আসনে নিজের নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড নজিরবিহীন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি রাজপথের আপসহীন আন্দোলনে দলকে গড়ে তুলেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্র তিনি ফিরিয়ে এনেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন তাঁর হাতে। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দলের বিপর্যয়েও বেগম জিয়ার প্রাপ্ত ভোট বরাবরের মতো উচ্চতায় ছিল। অনেকেরই চোখে পড়েনি, আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শেষে বিপর্যস্ত রাষ্ট্রকে সুঠাম করার অভিপ্রায়ে নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসেবে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। ২০০৮-এর নির্বাচনের ফল বিএনপির জন্য অপমানজনক হয়েছে বটে, কিন্তু দেশ বাঁচানোর জ্বলন্ত আবেগে সরকারকে তিনি সহযোগিতার অঙ্গীকার দিয়ে রেখেছেন। যা ২০০১-এর ভোটের পর বিরোধী দল করেনি। এ জন্য বোধ করি সরকার-নিন্দার বদলে এই জাতীয় কাউন্সিলের স্লোগানে নানান পথে নানান মানুষের জাতীয় ঐক্যই মূলমন্ত্র। থিম সংটাও তাই বলে, ‘বন্ধু-সাথিরা এক মোহনায়/ মিশেছি সবাই এসে লাখো শহীদের রক্তে/ রাঙানো পবিত্র এই দেশে।’ সম্মেলনের পোস্টারে মাঝখানে সূর্য রেখে চারদিকে সাত রঙের রংধনুর অবস্থান, জমিনজুড়ে সৌভাগ্যের হলুদ রং, ওয়েবসাইট উদ্বোধন নতুন উপলব্ধিরই আবাহন। পার্লামেন্টে না যাওয়া, আপাত দুর্বল বিরোধী দল বিএনপির জন্য এই শোডাউন বড় একটি ঘটনা। বেশ কয়েক দিন ধরে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানসহ বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথোপকথনে মনে হয়েছে, পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলকে তাঁরা শুধু আইনি বাধ্যবাধকতার কাউন্সিল মনে করেন না। তার পরও আইন মেনে কাউন্সিল ও গঠনতন্ত্রের সংশোধনীর ক্ষেত্রে তাঁরা যত্নবান। বরং জাতীয় সমস্যাকে জাতীয় ঐক্যে মোকাবিলার জন্য বিএনপির আদর্শিক পুনরুজ্জীবন, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দলকে সুবিন্যস্ত করার অগ্রাধিকারকেই তাঁরা এ মুহূর্তের কর্তব্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এ বিবেচনায় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল উল্টো পথে হেঁটেছে। তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেখা যায়নি। যদিও দল পুনর্গঠনে দলটির সভানেত্রী ঢের চমক উপহার দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কীভাবে নতুন করে সাজবে? কাউন্সিলের আম অর্থই হচ্ছে পুনর্বিন্যাস। স্থানীয় পর্যায়ের ৭৫ শতাংশে সফল সম্মেলন হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাকিগুলোতে কোন্দল, সংঘর্ষ, মতানৈক্য এমনভাবে হয়েছে যে মিডিয়া লুফে নিয়েছে। দলটির নেতারা এ নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নন। তাঁরা মনে করেন, এর কোনো ছাপ আপাতত জাতীয় সম্মেলনে পড়ছে না। বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপির নতুন সদস্য হয়েছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। কম কথা নয়। এক, দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়া এবং এক-এগারোর রেশ তো থাকবেই। দুই, সাংসদ বা প্রার্থীভিত্তিক স্থানীয় কমিটির গঠনের মন্দ দিকটাও পেখম মেলেছে। সাংসদ বা মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা আমাদের মতো দেশে সংগঠন বানাতে গেলে ‘ভাই’ভিত্তিক স্লোগানধারীদের পোয়াবারো হয়। অথচ এক-এগারোর পর দেখেছি, বড় দুই দলের সাবেক সাংসদদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে বা জেনারেল মইনের পক্ষে ধাবিত হলেও দেশজুড়ে দল দুটির সাধারণ নেতা-কর্মীরা খালেদা-হাসিনার জন্য জীবনবাজি আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। নেত্রীদ্বয়কে রক্ষা করেছেন। যা হোক, এ থেকে হঠাত্ বের হওয়াটা কঠিন, তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল যে এক-এগারোর বিপরীতে দাঁড়াবে, তা বলাটাই বাহুল্য। দলের নতুন সাজুনিতেও অমন রেশ থাকবেই। আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে তা দৃশ্যমান। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হালে প্রায় ঘোষণার মতোই বলেছেন, ‘৮ ডিসেম্বরের পর জনগণ নতুন বিএনপি দেখতে পাবে।’ সময়ের দাবিও অবশ্য নতুন পরিচ্ছন্ন বিএনপি। অন্তত এক-এগারোর বিরোধী চেতনায় দুর্নীতিবাজ বলে যাদের কুনাম আছে, তাদের অপরাধও যেন এ অজুহাতে মুছে না যায়। দলের ভেতর-বাইরে এমন উপলব্ধি প্রবল। বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী তাঁদের অনুভূতির মূল্যায়ন চান। দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা চেইন অব কমান্ড থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় না থাকলে বিএনপি সব সময় অপেক্ষমাণ রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু দলটি যে পারফর্ম করতে পারে, আগের উদাহরণ সামনে এনে নতুন করে সাজিয়ে বিএনপিকে তা-ই দেখাতে হবে। সবার প্রত্যাশা, নতুন রক্তের সংযোগ-সাধন ঘটুক। প্রয়াত জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান, তরুণ রাজনীতিক তারেক রহমানের আশু দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম। তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। নির্যাতনে তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাঁকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে বহুদিন। সম্প্রতি লন্ডনে তারেক রহমান এক সাক্ষাতে আমাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতির মানদণ্ডে একজন রাজনীতিবিদের যে সীমারেখা, তা আমি কখনো অতিক্রম করিনি।’ বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল যদি বিএনপির নবযাত্রার সূচনা করে, তারেক রহমান হতে পারেন ভবিষ্যতের কান্ডারি। সময় হলেই ফিরবেন তিনি এবং বীরোচিত সংবর্ধনায়। এ প্রত্যাশা বহু মানুষের।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনার বটমূলে সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দলের ঘোষণাপত্র তিনি পড়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ দাঁড়াবে নিজের পায়ে, চলবে আত্মশক্তিতে।’ স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন এবং দল ও রাষ্ট্র গঠনের সুবিশাল যজ্ঞ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তনসহ রাজনৈতিক সংস্কার দেশকে নতুন পরিচিতি, নতুন স্বয়ম্ভরতা দিয়েছিল। বিশ্ব ও দেশবাসীর সামনে থেকে তীব্র দেশপ্রেমে ও আত্মিক সততায় তিনি তাঁর পূর্ব সময়কে পৃথক করতে পেরেছিলেন। ‘The Final test of a leader is that he leaves behind him in other men the conviction and the will to carry on’—বিলেতি রাজনীতির এই পর্যবেক্ষণ জিয়ার জন্য বেশি প্রযোজ্য। আজকের বিএনপির জন্য জিয়ার দেশপ্রেম, সততা ও নিঃস্বার্থের আদর্শ, দলের ঘোষণাপত্রের চেতনা এবং বেগম জিয়ার উদার গণতন্ত্র হতে পারে নবযাত্রার মূল ভিত্তি। বেগম খালেদা জিয়ার নজরের আড়ালে কিছুসংখ্যক নেতা-কর্মীর আদর্শিক বিচ্যুতি দলকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অভিজন সমাজের মতে, ৩১ বছরের যাত্রায় বিএনপি কিন্তু আওয়ামী লীগের পাশাপাশি এক সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে এখন বিএনপির সদস্য, সমর্থক বা শুভাকাঙ্ক্ষী তৈরি হয়েছে।
শওকত মাহমুদ: সাংবাদিক। সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব।
‘নানান মানুষ নানান পথ, দেশ বাঁচাতে ঐক্যমত’ স্লোগান তুলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জাতীয় সম্মেলনকে জাতীয় সম্মিলনীতে বিকশিত করার ‘রংধনু’ প্রয়াস, এ উপলক্ষে তৃণমূল পর্যায় থেকে সাংগঠনিক সজীবতা এবং আয়োজনের প্রাণচাঞ্চল্য যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, নেতাদের বিশ্বাস—বাংলাদেশের সমকালীন লোক-চিন্তায় ও রাজনৈতিক অববাহিকায় এ অনুষ্ঠান সম্ভাবনার তরতাজা পলি ছড়াবে। বিএনপির রাজনীতিকে নেতির নেত্রে পরখ করেন না, এমন অভিজন সমাজের ধারণা হলো, এক-এগারোর পর থেকে রাষ্ট্র যেমন গণতন্ত্রে ও সার্বভৌমত্বে বিপন্ন হয়েছে, উপর্যুপরি দুই আমলের নিগ্রহে বিএনপি ততোধিক বিদীর্ণ। ১৬ বছর পর বিরোধী দলে থেকে এ কাউন্সিলকে সফল করা গেলে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে। এর পৌঁছ রাষ্ট্র-রাজনীতিতেও বিস্তৃত হবে, ‘তিমির কাঁপিবে গভীর আলোর রবে’।
ইতিমধ্যে বেগম খালেদা জিয়া আবারও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন। উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দেবে, দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে একজন রাজনৈতিক নেতার শীর্ষ জনপ্রিয়তা, তিনবারের কাউন্সিলে দলের প্রধান হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকা, দলকে দুবার ভোটে বিজয়ী করা এবং সর্বদা সর্বোচ্চ ভোটে সবচেয়ে বেশি আসনে নিজের নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড নজিরবিহীন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি রাজপথের আপসহীন আন্দোলনে দলকে গড়ে তুলেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্র তিনি ফিরিয়ে এনেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন তাঁর হাতে। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দলের বিপর্যয়েও বেগম জিয়ার প্রাপ্ত ভোট বরাবরের মতো উচ্চতায় ছিল। অনেকেরই চোখে পড়েনি, আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শেষে বিপর্যস্ত রাষ্ট্রকে সুঠাম করার অভিপ্রায়ে নির্বাচিত সরকারের প্রধান হিসেবে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। ২০০৮-এর নির্বাচনের ফল বিএনপির জন্য অপমানজনক হয়েছে বটে, কিন্তু দেশ বাঁচানোর জ্বলন্ত আবেগে সরকারকে তিনি সহযোগিতার অঙ্গীকার দিয়ে রেখেছেন। যা ২০০১-এর ভোটের পর বিরোধী দল করেনি। এ জন্য বোধ করি সরকার-নিন্দার বদলে এই জাতীয় কাউন্সিলের স্লোগানে নানান পথে নানান মানুষের জাতীয় ঐক্যই মূলমন্ত্র। থিম সংটাও তাই বলে, ‘বন্ধু-সাথিরা এক মোহনায়/ মিশেছি সবাই এসে লাখো শহীদের রক্তে/ রাঙানো পবিত্র এই দেশে।’ সম্মেলনের পোস্টারে মাঝখানে সূর্য রেখে চারদিকে সাত রঙের রংধনুর অবস্থান, জমিনজুড়ে সৌভাগ্যের হলুদ রং, ওয়েবসাইট উদ্বোধন নতুন উপলব্ধিরই আবাহন। পার্লামেন্টে না যাওয়া, আপাত দুর্বল বিরোধী দল বিএনপির জন্য এই শোডাউন বড় একটি ঘটনা। বেশ কয়েক দিন ধরে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানসহ বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথোপকথনে মনে হয়েছে, পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলকে তাঁরা শুধু আইনি বাধ্যবাধকতার কাউন্সিল মনে করেন না। তার পরও আইন মেনে কাউন্সিল ও গঠনতন্ত্রের সংশোধনীর ক্ষেত্রে তাঁরা যত্নবান। বরং জাতীয় সমস্যাকে জাতীয় ঐক্যে মোকাবিলার জন্য বিএনপির আদর্শিক পুনরুজ্জীবন, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দলকে সুবিন্যস্ত করার অগ্রাধিকারকেই তাঁরা এ মুহূর্তের কর্তব্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এ বিবেচনায় আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল উল্টো পথে হেঁটেছে। তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেখা যায়নি। যদিও দল পুনর্গঠনে দলটির সভানেত্রী ঢের চমক উপহার দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি কীভাবে নতুন করে সাজবে? কাউন্সিলের আম অর্থই হচ্ছে পুনর্বিন্যাস। স্থানীয় পর্যায়ের ৭৫ শতাংশে সফল সম্মেলন হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, বাকিগুলোতে কোন্দল, সংঘর্ষ, মতানৈক্য এমনভাবে হয়েছে যে মিডিয়া লুফে নিয়েছে। দলটির নেতারা এ নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নন। তাঁরা মনে করেন, এর কোনো ছাপ আপাতত জাতীয় সম্মেলনে পড়ছে না। বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপির নতুন সদস্য হয়েছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। কম কথা নয়। এক, দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়া এবং এক-এগারোর রেশ তো থাকবেই। দুই, সাংসদ বা প্রার্থীভিত্তিক স্থানীয় কমিটির গঠনের মন্দ দিকটাও পেখম মেলেছে। সাংসদ বা মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা আমাদের মতো দেশে সংগঠন বানাতে গেলে ‘ভাই’ভিত্তিক স্লোগানধারীদের পোয়াবারো হয়। অথচ এক-এগারোর পর দেখেছি, বড় দুই দলের সাবেক সাংসদদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে বা জেনারেল মইনের পক্ষে ধাবিত হলেও দেশজুড়ে দল দুটির সাধারণ নেতা-কর্মীরা খালেদা-হাসিনার জন্য জীবনবাজি আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। নেত্রীদ্বয়কে রক্ষা করেছেন। যা হোক, এ থেকে হঠাত্ বের হওয়াটা কঠিন, তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল যে এক-এগারোর বিপরীতে দাঁড়াবে, তা বলাটাই বাহুল্য। দলের নতুন সাজুনিতেও অমন রেশ থাকবেই। আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে তা দৃশ্যমান। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হালে প্রায় ঘোষণার মতোই বলেছেন, ‘৮ ডিসেম্বরের পর জনগণ নতুন বিএনপি দেখতে পাবে।’ সময়ের দাবিও অবশ্য নতুন পরিচ্ছন্ন বিএনপি। অন্তত এক-এগারোর বিরোধী চেতনায় দুর্নীতিবাজ বলে যাদের কুনাম আছে, তাদের অপরাধও যেন এ অজুহাতে মুছে না যায়। দলের ভেতর-বাইরে এমন উপলব্ধি প্রবল। বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী তাঁদের অনুভূতির মূল্যায়ন চান। দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা চেইন অব কমান্ড থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় না থাকলে বিএনপি সব সময় অপেক্ষমাণ রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু দলটি যে পারফর্ম করতে পারে, আগের উদাহরণ সামনে এনে নতুন করে সাজিয়ে বিএনপিকে তা-ই দেখাতে হবে। সবার প্রত্যাশা, নতুন রক্তের সংযোগ-সাধন ঘটুক। প্রয়াত জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান, তরুণ রাজনীতিক তারেক রহমানের আশু দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম। তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। নির্যাতনে তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাঁকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে বহুদিন। সম্প্রতি লন্ডনে তারেক রহমান এক সাক্ষাতে আমাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতির মানদণ্ডে একজন রাজনীতিবিদের যে সীমারেখা, তা আমি কখনো অতিক্রম করিনি।’ বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল যদি বিএনপির নবযাত্রার সূচনা করে, তারেক রহমান হতে পারেন ভবিষ্যতের কান্ডারি। সময় হলেই ফিরবেন তিনি এবং বীরোচিত সংবর্ধনায়। এ প্রত্যাশা বহু মানুষের।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনার বটমূলে সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দলের ঘোষণাপত্র তিনি পড়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ দাঁড়াবে নিজের পায়ে, চলবে আত্মশক্তিতে।’ স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন এবং দল ও রাষ্ট্র গঠনের সুবিশাল যজ্ঞ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তনসহ রাজনৈতিক সংস্কার দেশকে নতুন পরিচিতি, নতুন স্বয়ম্ভরতা দিয়েছিল। বিশ্ব ও দেশবাসীর সামনে থেকে তীব্র দেশপ্রেমে ও আত্মিক সততায় তিনি তাঁর পূর্ব সময়কে পৃথক করতে পেরেছিলেন। ‘The Final test of a leader is that he leaves behind him in other men the conviction and the will to carry on’—বিলেতি রাজনীতির এই পর্যবেক্ষণ জিয়ার জন্য বেশি প্রযোজ্য। আজকের বিএনপির জন্য জিয়ার দেশপ্রেম, সততা ও নিঃস্বার্থের আদর্শ, দলের ঘোষণাপত্রের চেতনা এবং বেগম জিয়ার উদার গণতন্ত্র হতে পারে নবযাত্রার মূল ভিত্তি। বেগম খালেদা জিয়ার নজরের আড়ালে কিছুসংখ্যক নেতা-কর্মীর আদর্শিক বিচ্যুতি দলকে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অভিজন সমাজের মতে, ৩১ বছরের যাত্রায় বিএনপি কিন্তু আওয়ামী লীগের পাশাপাশি এক সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি পরিবারে এখন বিএনপির সদস্য, সমর্থক বা শুভাকাঙ্ক্ষী তৈরি হয়েছে।
শওকত মাহমুদ: সাংবাদিক। সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব।
No comments