গাজায় আরও বড় হামলার ফন্দি আটছে ইসরায়েল
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে কী কী বিষয়ে আলোচনা হতে পারে তার ধারণা দেন।
তিনি বলেন, গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের শাসনের অবসান এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন প্রধান লক্ষ্য। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির বলয় সম্প্রসারিত করব এবং গাজার সংকট সমাধানের একটি কার্যকর পথ বের করব।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা কমানোর গোপন পরিকল্পনা?
ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহু একটি নতুন মার্কিন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবেন, যার মূল লক্ষ্য গাজার জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন কৌশল অনুযায়ী, গাজা থেকে ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেওয়া গেলে হামাস শাসনের অবসান ঘটানো সহজ হবে। এটি ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে পারে।
তবে এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে দমনপীড়ন এবং জোরপূর্বক স্থানান্তরের কৌশল হিসেবে দেখছে।
গাজা দখলের পরিকল্পনায় কী রয়েছে?
নেতানিয়াহু জানান, ট্রাম্পের সঙ্গে তার আলোচনায় মূলত ৩টি বিষয় প্রাধান্য পাবে— হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাদের উপস্থিতি বাড়ানো এবং ফিলিস্তিনিদের গাজা ছাড়তে বাধ্য করা।
নেতানিয়াহু বলেন, আমরা এমন একটি মধ্যপ্রাচ্য গড়তে চাই, যেখানে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে এবং সন্ত্রাসবাদ শিকড় গাড়তে পারবে না।
গাজায় হামলা জোরদার করবে ইসরায়েল?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর বৈঠকের পর গাজায় সামরিক অভিযানের মাত্রা আরও তীব্র হতে পারে। সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলের বিমান হামলা ও স্থল অভিযান ব্যাপকহারে বেড়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত এক মাসেই ৩,৫০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
নেতানিয়াহু বলেন, শক্তির মাধ্যমে আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করব। গাজার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের নৈতিক কর্তব্য।
আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন পরিকল্পনা আরব বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে, সৌদি আরব ও কাতার যদি ফিলিস্তিনের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়, তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে না।
তবে নেতানিয়াহু আশাবাদী, আরব দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নতুনভাবে গড়তে পারব।
প্রসঙ্গত, নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের বৈঠক শুধু একটি কূটনৈতিক আলোচনা নয়, বরং এটি গাজার ভবিষ্যতের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। নেতানিয়াহুর ভাষায়, আমরা শান্তির বলয় সম্প্রসারিত করতে যাচ্ছি। গাজা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আলোচনার ফলে গাজায় দীর্ঘস্থায়ী দখলদারিত্ব এবং জনসংখ্যা পরিবর্তনের চেষ্টা হতে পারে, যা শুধু ফিলিস্তিন নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বদলে দিতে পারে।
গাজা খালির বিরোধিতা করে পাঁচ আরব দেশের চিঠি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা খালি করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন পাঁচ আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফিলিস্তিনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তারা এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে একটি যৌথ চিঠি পাঠিয়েছেন।
চিঠিটি সোমবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) পাঠানো হয়। এতে সই করেছেন জর্ডান, মিসর, সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। খবর রয়টার্স।
এ ছাড়া ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হুসেইন আল-শেখও চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। প্রথমে মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস চিঠিটির খবর প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই কূটনীতিকেরা গত সপ্তাহান্তে মিসরের কায়রোতে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।
এদিকে ফিলিস্তিনিরা বহু বছর ধরে আশঙ্কা করে আসছেন যে, তাদের বাড়িঘর থেকে চিরতরে বিতাড়িত করা হতে পারে। ট্রাম্পের এই প্রস্তাবে সেই আশঙ্কার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সমালোচকেরা এই পরিকল্পনাকে জাতিগত নির্মূলের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। জর্ডান, মিসরসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশ ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে পাঠানো যৌথ চিঠিতে আরব কূটনীতিকেরা স্পষ্টভাবে বলেছেন, গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনের দায়িত্ব গাজাবাসীর হাতেই থাকতে হবে। ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমিতেই বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, গাজা পুনর্গঠনের সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব কেড়ে নেওয়া উচিত নয়। এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন থাকা জরুরি হলেও, নেতৃত্ব ফিলিস্তিনিদের হাতেই থাকতে হবে।
গাজা উপত্যকায় নিহতের সংখ্যা ৬২ হাজার
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬১ হাজার ৭০৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, নতুন পরিসংখ্যানে হাজারো নিখোঁজ ব্যক্তিকে মৃত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। খবর আল-জাজিরার।
গাজা উপত্যকার সরকারি তথ্য দপ্তরের প্রধান সালামা মারুফ এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, নিহতদের মধ্যে ৭৬ শতাংশের মরদেহ উদ্ধার করে চিকিৎসাকেন্দ্রে আনা হয়েছে। তবে এখনও অন্তত ১৪ হাজার ২২২ জন ধ্বংসস্তূপের নিচে বা এমন এলাকায় আটকে আছেন, যেখানে উদ্ধারকারীরা পৌঁছাতে পারেননি।
গাজার আল-শিফা হাসপাতাল থেকে দেওয়া এক বক্তব্যে মারুফ বলেন, নিহতদের মধ্যে ১৭ হাজার ৮৮১ জন শিশু, যার মধ্যে ২১৪ জন নবজাতক রয়েছে।
মারুফ আরও জানান, ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। অনেকে ২৫ বারেরও বেশি স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। সংঘর্ষে আহতের সংখ্যা ১ লাখ ১১ হাজার ৫৮৮ জন।
নতুন এই পরিসংখ্যান এমন সময়ে এসেছে যখন ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলছে। ১৫ মাস ধরে চলা ইসরায়েলের এই গণহত্যা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছে।
বর্তমান যুদ্ধবিরতি অন্তত মার্চের শুরু পর্যন্ত বহাল থাকার কথা। এর ফলে উদ্ধারকর্মীরা গাজার বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে আগে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি।
No comments