টিপাইমুখ বাঁধ-দিল্লিকে ঢাকার কড়া বার্তা, ব্যাখ্যা দাবি by মেহেদী হাসান
বরাক নদের ওপর বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে চুক্তির আগে একই অববাহিকার দেশ বাংলাদেশকে কেন জানানো হলো না তার ব্যাখ্যা চেয়ে কড়া ভাষায় দিল্লিকে বার্তা পাঠিয়েছে ঢাকা। বার্তায় ওই চুক্তির খুঁটিনাটি জানানোর পাশাপাশি বিতর্কিত টিপাইমুখ নিয়ে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার সঙ্গে আলোচনা এবং যত দ্রুত সম্ভব যৌথ সমীক্ষা চালানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে দিল্লির কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে প্রথম বার্তাটি পাঠানো হয় গত বুধবার। 'রিমাইন্ডার' (স্মরণ করিয়ে দিতে) হিসেবে গতকাল সন্ধ্যায় আবারও ওই বার্তাটি পাঠানো হয়। ওই কূটনীতিক জানান, বার্তাটি একই সঙ্গে নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠানো হয়েছে।
দিল্লির কাছে পাঠানো বার্তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাইলে অপর এক কূটনীতিক বলেন, 'কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। প্রস্তাবিত টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে কেন আমাদের (বাংলাদেশকে) জানানো হলো না তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে ওই বার্তায়।' তিনি বলেন, 'টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে ভারতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সে সম্পর্কে ভারতকে স্বচ্ছতার সঙ্গে জানাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া টিপাইমুখ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা জানানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ প্রকল্প নিয়ে যেকোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশকে আগে থেকে অবগত করে আলোচনা করতে বলা হয়েছে।'
ওই কূটনীতিক আরো বলেন, 'বার্তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো_ভারতকে বলা হয়েছে, তারা যাতে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে একটি যৌথ সমীক্ষা চালায়।'
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কে বিশ্বাস করে। কিন্তু টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে গত ২২ অক্টোবর ভারতের মণিপুর রাজ্যের সঙ্গে অন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরের খবরে বাংলাদেশ রীতিমতো হতাশ। টিপাইমুখ ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু করা হবে না বলে বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও যেভাবে গোপনে চুক্তি হলো তা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। এ ছাড়া ওই চুক্তির পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বৈঠক হয়েছে। সেখানেও ভারতের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানানো হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতে চুক্তির পর বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পরও এ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নে বাংলাদেশ ভারত নিয়ে যে মন্তব্য করেছে তাতে বারবার আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ তার বক্তব্য বা বিবৃতির মাধ্যমে ভারতের জন্য অসম্মানজনক কিছু বলেনি। কিন্তু কূটনৈতিক চ্যানেলে যে বার্তা পাঠানো হয়েছে তার ভাষা কড়া। তিনি আরো বলেন, দিল্লিকে এমন বার্তাই দেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশ ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার দেওয়া আশ্বাসে আস্থাশীল। এর পরও টিপাইমুখ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে না, তা দুই দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে যৌথ সমীক্ষা থেকেও আসা উচিত। এ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আগে অবশ্যই যৌথ সমীক্ষা হওয়া উচিত।
ঢাকায় সরকারি কর্মকর্তারা জানান, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে গত ২২ অক্টোবর বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে তাঁরা এ সপ্তাহে সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে জেনেছেন। বিষয়টি তাঁদের কাছেও স্পষ্ট নয়। তাই নিশ্চিত না হয়ে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় ভারতের কাছে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে উদ্বেগ জানানোর কথাও তাঁরা ভাবেননি।
সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু না করার আশ্বাস দিয়ে ভারত গোপনে চুক্তি করে এ দেশকে রীতিমতো বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। এর জন্য বাংলাদেশের জনগণ মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
এদিকে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে চুক্তির খবরে বাংলাদেশে অব্যাহত সমালোচনার মুখে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে চুক্তির কথা স্বীকার করে। বিবৃতিতে ভারত সরকার প্রথমবারের মতো জানায়, যৌথ অংশীদারত্বে একটি কম্পানি (জেভিসি) প্রতিষ্ঠার জন্য গত ২২ অক্টোবর মণিপুর সরকার, এনএইচপিসি (ন্যাশনাল হাইড্রোপাওয়ার করপোরেশন) লিঃ ও সুতলেজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেডের (এসজেভিএন) মধ্যে সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরই টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের একমাত্র অগ্রগতি। 'টিপাইমুখ হাইড্রোইলেকট্রিক করপোরেশন লিমিটেড' বা সংশ্লিষ্ট কম্পানির নিবন্ধক অনুমোদিত অন্য কোনো নামে জেভিসিটি প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, টিপাইমুখ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না। প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকছে এবং এর মাধ্যমে সেচের জন্য পানি সরিয়ে নেওয়া হবে না।
ভারতের বিবৃতির কয়েক ঘণ্টা পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে টিপাইমুখসহ অভিন্ন নদ-নদীতে হস্তক্ষেপ করার আগে ঢাকার সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেয়। বিবৃতিতে সরাসরি উদ্বেগ জানানো না হলেও বলা হয়েছে, তথ্য বিনিময় এবং আগাম আলোচনা এ দেশের উদ্বেগ প্রশমনে ভূমিকা রাখবে।
No comments