গর্তে পুঁতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বৃদ্ধার 'চিকিৎসা' by লিমন বাসার,
খোলা আকাশের নিচে মশারির মতো করে ঝোলানো লাল-নীল কাপড়ের 'কাণ্ডারি'। ভেতরে মাটিতে গর্ত। পক্ষাঘাতগ্রস্ত ৯০ বছরের বৃদ্ধা আইরিন বিবিকে কোমর পর্যন্ত মাটিচাপা দিয়ে চলছে 'চিকিৎসা'। পাঁচ-ছয়জন যুবক ঢোল-খোল বাজিয়ে গান করছেন। গানের তালে তালে নৃত্যের ভঙ্গিতে ৯ শিশু কাণ্ডারির চারপাশে ঘুরছে। কাণ্ডারির (রঙিন কাপড়ে ঘেরা স্থান) পাশে দাঁড়িয়ে কবিরাজ হঠাৎ গান ধরেন_'নেমে যাও নেমে যাও, নুলার বাও, ভাটির দিকে
নেমে যাও...। মা ফাতেমার দোহাই লাগে নেমে যাও...।' চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের জন্য রোগীর চারপাশে লোহার ছুরি, দা, কোদাল, ডালা-চালুনিসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। একটি ডালায় রাখা ধান, দূর্বাঘাস ও ফুল_যেন অর্চণার আয়োজন। চলবে সাত দিন পর্যন্ত।
বগুড়ার ধুনট উপজেলার পারনাটাবাড়ী গ্রামে চিকিৎসার নামে এই অপচিকিৎসা চলছে। আর তা দেখার জন্য এলাকার শত শত নারী-পুরুষ ভিড় করছে।
পারনাটাবাড়ী গ্রামের জহির সরকারের স্ত্রী আইরিন বিবি। ৫০ বছর আগে জহির সরকার মারা গেছেন। আইরিন বিবি দীর্ঘদিন ধরে পক্ষাঘাতে (প্যারালাইসিস) আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। কথাও ঠিকমতো বলতে পারেন না। নানা স্থানে চিকিৎসা করানোর পর নিঃস্ব পরিবার যখন তার চিকিৎসার আশা ছেড়েই দিয়েছিল, সেই মুহূর্তে আবির্ভাব ঘটে এক কবিরাজের। আইরিন বিবির নাতবউ আজিরন খাতুনের ভাইয়ের ছেলে এই কবিরাজ স্বপন মিয়া। আত্মীয়তার সূত্র ধরে তিনি আইরিনের চিকিৎসা করতে রাজি হয়েছেন। কবিরাজের কথামতোই তৈরি করা গর্তে পুঁতে রেখে চলছে চিকিৎসা। সাত দিনের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে গত বুধবার রাতে তৃতীয় দিনের চিকিৎসা চলছিল। কবিরাজ প্রতিদিন চিকিৎসার সময় বেছে নেন এশার নামাজের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত।
রাতে আজব চিকিৎসা দেখতে গেলে গ্রামের কয়েকজন সাবধান করে দেন, আশপাশের লোকজন সবাই কবিরাজের পক্ষে। তাই সাবধান থাকতে হবে। গিয়ে দেখা যায়, কাণ্ডারির ভেতর দক্ষিণ মুখ করে আইরিন বিবিকে পুঁতে রাখা হয়েছে।
আজব কথা দিয়ে তৈরি করা কবিরাজের গানের চরণগুলো কবিরাজই বলে দিচ্ছেন। পাশে বসা পাঁচ যুবক তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ওই চরণগুলো বাদ্যের তালে তালে গেয়ে যান। আর গানের তালে তালে ফেরদৌসী, সাথী, রাজিয়া, কহিনুরসহ ৯টি শিশু রোগীর চারপাশে ঘুরছে আর নাচছে। সাত পাক শেষ হলে শিশুদের দলনেত্রীর হাতে থাকা ঝাঁটা দিয়ে রোগীর শরীরে পেটাচ্ছেন কবিরাজ। সঙ্গে চলছে 'তন্ত্রমন্ত্র' পাঠ করে রোগীর শরীরে ঝাড়ফুঁক দেওয়া। এরপর কবিরাজ বাঁ পা দিয়ে রোগীর মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত স্পর্শ করছেন। এভাবেই থেমে থেমে গভীর রাত পর্যন্ত চলে চিকিৎসা। অর্ধপোঁতা অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকার কারণে বৃদ্ধা আইরিন বিবির অবস্থা তখন আরো সঙ্গীন।
অন্য রোগীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে কথা হয় 'কবিরাজ' স্বপন মিয়ার (৩০) সঙ্গে। স্বপন জানান, বগুড়ার ধুনট উপজেলার আড়কাটিয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। পেশায় মাংস ব্যবসায়ী (কসাই)। প্রায় পাঁচ বছর ধরে কবিরাজি চিকিৎসা করেন। কাজিপুরের মেঘাই গ্রামের খুদু হাওয়ালদার তাঁর ওস্তাদ। ওস্তাদ কোথা থেকে কবিরাজি চিকিৎসা শিখেছেন তা তিনি জানেন না। তবে ওস্তাদের শিখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে নুলা রোগে (প্যারালাইসিস) আক্রান্ত ১০৫ জন রোগীকে সুস্থ করেছে বলে দাবি করেন স্বপন। এই লোকগুলো কোথাকার জানতে চাইলে স্বপন মিয়া বলেন, তারা উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। তাঁর বাড়ি ধুনট উপজেলায় হলেও এখানে তাঁর এটাই প্রথম রোগী।
স্বপন মিয়া বলেন, তিনি চিকিৎসার জন্য কোনো টাকা-পয়সা নেন না। তবে রোগীর লোকজন ইচ্ছা করে দিলে সেই টাকা নিয়ে থাকেন। মাত্র সাত দিনের মধ্যে রোগ নিরাময়ের ঘোষণা প্রসঙ্গে স্বপন মিয়া জানান, কিছুটা তো ভালো হবেনই, এর পরও কবিরাজি চিকিৎসা করাতে হবে। যে ওষুধ দেওয়া হবে সেসব নিয়মিত খেলে হয়তো রোগী চলনসই হয়ে উঠবেন, তবে একেবারেই যে ভালো হবেন এর কোনো গ্যারান্টি নেই।
কথা বলার চেষ্টা করা হয় চিকিৎসারত বৃদ্ধা আইরিন বিবির সঙ্গে। তখন তিনি আজব চিকিৎসার কারণে ব্যথায় কাতর। বৃদ্ধা বলেন, 'কিচ্চুই বুজিচ্চি না বাবা। আল্লা শ্যাষ পন্ত ব্যাঁচা আকলে হয়।'
আইরিন বিবির ছেলে মংলা সরকার বলেন, 'হামার মায়ের অনেক বয়স হচে। চলবার পারে না। আগে অনেক কিচু করিচি। শ্যাষে এই কবিরাজের খোঁজ পানু। কবিরাজ চিকিৎসার খরচের জন্য ৪ হাজার ট্যাকা চাছে। এক হাজার টাকা দিচি।' জানা যায়, এক ছেলে ও তিন কন্যাসন্তানের জননী আইরিন। অভাব-অনটনের সংসার। স্বামী মারা যাওয়ার পর দিনমজুর ছেলে মংলা সরকারই তাঁর দেখাশোনা করেন।
এলাকার বাসিন্দা জহুরুল ইসলাম, জুবায়ের হোসেন, করিম বক্সসহ বেশ কয়েকজন জানান, যারা কবিরাজের সঙ্গে চিকিৎসাকাজে অংশ নিয়েছে তাদের আগে থেকেই বলে দেওয়া আছে কী করতে হবে। কবিরাজ কখনো আল্লাহর নামে, কখনো মা ফাতেমার নামে, আবার কখনো কালী মাতার নামে বাদ্যের তালে জারিগান করে চিকিৎসা করেন।
যোগাযোগ করা হলে বগুড়ার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. সাদিক খান কালের কণ্ঠকে জানান, এটা একটা উদ্ভট ব্যাপার। এটাকে কোনোভাবেই চিকিৎসা বলার সুযোগ নেই। এ ধরনের কাজে রোগী আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি মাটির বাড়তি চাপের কারণে রোগীর মেরুদণ্ড এবং পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ধুনট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হোসনে ফিরোজা জানান, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় এ ধরনের কোনো কিছুর সুযোগই নেই। গ্রাম এলাকার মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে এ ধরনের প্রতারণা চালানো হচ্ছে।
ধুনটের নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গনি জানান, এটা একটা অমানবিক কাজ। সঙ্গে প্রতারণা এবং দণ্ডনীয় অপরাধও। বিষয়টি জানার পর তিনি সেই এলাকার চেয়ারম্যানকে বলেছেন এ ধরনের কাজ আবার যাতে না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে। আবার করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
No comments