রাজশাহীতে বিরোধী দলের প্রতি প্রধানমন্ত্রী-হুমকিতে কাজ হবে না by পাভেল হায়দার চৌধুরী ও রফিকুল ইসলাম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, 'খালেদা জিয়া হুমকি-ধমকি দিয়ে জনগণের সেবা করা থেকে আওয়ামী লীগকে বিরত রাখতে পারবেন না। আমরা মনে করি, আমাদের সরকার জনগণের সেবক। তাদের কল্যাণে কাজ করব-এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে লুটপাট করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। লুটপাটকারীদের স্থান বাংলার মাটিতে হবে না।'
জাতির সামনে খালেদা জিয়ার মুখোশ খুলে গেছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, কিসের আশায় খালেদা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চান? তিনি কি দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না? দেশের মানুষ আজ জেগে উঠেছে। যারা এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যা, লুটপাট, অগি্নসংযোগ ও মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে, তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই হবে ইনশা আল্লাহ।
ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে খালেদা জিয়া সরকারের নিষ্ক্রিয়তার যে অভিযোগ তুলেছেন সে প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, 'দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ কোনো দেশ করলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ যত দিন ক্ষমতায় থাকবে, দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড কেউ করতে পারবে না।' শেখ হাসিনা বলেন, 'খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে সব ভুলে যান, বিরোধী দলে গেলে তাঁর আওয়াজ বড় হয়ে যায়। তিনি আবার পত্রও লেখেন!' প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, 'টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সমস্যা আপনার সময় হয়েছে। তখন কেন কিছু বলেননি, কোনো ব্যবস্থা নেননি? আমরাই তো তখন প্রথম এ নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম। আপনাদের এই দ্বিমুখী চরিত্র দেশের মানুষ জানে।'
পদ্মাবিধৌত রাজশাহী শহরের ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে কেন্দ্র করে সেখানে মানুষের ঢল নেমেছিল। বর্তমান সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনার এটাই ছিল রাজশাহীতে প্রথম সফর। এর আগে ২০০৫ সালের ২২ ডিসেম্বরে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রাজশাহীতে এসেছিলেন তিনি।
বিশাল এই জনসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ২০০৮ সালের নির্বাচনে রাজশাহীর সব আসনেই আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের প্রার্থীদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করায় এ এলাকার মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁর ক্ষমতার মেয়াদেই গ্যাস সরবরাহ, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পদ্মা সেতুর ভাঙন রোধসহ রাজশাহীবাসীর সব দাবি পূরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি। ৩২ মিনিটের ভাষণে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বলেন, 'আমরা সরকারে থাকা অবস্থায় যে কাজ করি তা জনগণের কল্যাণে করি।'
বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া দেখিয়েছিলেন, ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি ছাড়া নাকি তিনি আর কিছুই রেখে যাননি! কিন্তু ক্ষমতায় পাঁচ বছর থেকে তাঁর অগাধ ধন-সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার ঘটনা দেশবাসী দেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'লজ্জায় দেশের মানুষের মাথা হেঁট হয়ে যায়, বিদেশ থেকে গোয়েন্দা সংস্থার (এফবিআই) লোক এসে আদালতে সাক্ষী দিচ্ছেন যে খালেদা জিয়ার ছেলেরা কিভাবে বিদেশে দুর্নীতির অর্থ পাচার করেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রীও ক্ষমতায় থাকতে অর্জিত দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করেছেন।' তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, দুর্নীতিবাজদের জায়গা এ দেশের মাটিতে হবে না।
লংমার্চের নামে দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা অপচয়ের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে নাকি লংমার্চ করবেন। লংমার্চ মানে পায়ে হেঁটে চলা। কিন্তু হাজার হাজার গাড়ি প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি (খালেদা) লংমার্চ করলেন। এত টাকা তিনি কোথায় পেলেন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, 'আমরা গাড়ির নম্বর সংগ্রহ করছি। এত দামি গাড়ির উৎস কোথায়, কোথা থেকে এসেছে, কিভাবে এসেছে_তা খুঁজে বের করা হবে। লুটপাট করে টাকা কামিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী লংমার্চ তো নয়, গাড়িমার্চ করছেন!' তিনি আরো বলেন, 'জনগণ কষ্ট করবে, আপনারা লুটেপুটে খাবেন, লম্বা লম্বা কথা বলবেন_এটা হতে পারে না।' তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা খরচ ছাড়া এসব লংমার্চের রেজাল্ট (ফলাফল) কী?
টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, 'আমরা গতবার ক্ষমতায় এসে ভারতের কাছ থেকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছি। আর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে ভারতে গিয়ে গঙ্গার সমস্যার কথা ভুলেই গেছেন। স্বাধীনতার পর এত বছর গেছে, আমাদের কোনো সীমানা নির্ধারণ ছিল না। আমরা এবার স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে সীমানা চূড়ান্ত করেছি। ভারত থেকে প্রায় ৪০ হাজার বিঘা জমি উদ্ধার করেছি।' তিনি এ সময় কৌতুকের সুরে বলেন, 'খালেদা জিয়ার নির্বাচনী এলাকা ফেনীতেও জায়গা উদ্ধার করেছি।'
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, 'আপনারা বিরোধীদলীয় নেত্রীকে প্রশ্ন করুন, ক্ষমতায় থাকতে দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি, হত্যা- সন্ত্রাস ছাড়া দেশের মানুষকে তাঁরা আর কী দিতে পেরেছেন?'
শেখ হাসিনা বলেন, 'আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দেশের মানুষ কিছু পায়। দেশের মানুষ আবার জেগে উঠেছে। সংবিধান সংশোধন করে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করেছি। বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। অর্থনৈতিক মুক্তি ও অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে বুকের রক্ত দিয়ে গেছেন। জনগণের অধিকার, ভাগ্যের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে প্রয়োজনে বাবার মতো আমিও বুকের রক্ত ঢেলে দেব। দেশের মানুষের ভাগ্যের আমরা পরিবর্তন করবই।'
রাজশাহী মহানগর ও জেলা কমিটি যৌথভাবে এই জনসভার আয়োজন করে। মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যাপক বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে জনসভায় আরো অনেকের পাশাপাশি শহীদ জাতীয় তিন নেতার ছেলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, দলের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং রাজশাহীর সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বক্তব্য দেন।
বিমানযোগে সকাল সাড়ে ৯টায় শেখ হাসিনা রাজশাহীতে এসে পেঁৗছান। এরপর তিনি প্রথমে রাজশাহী সেনানিবাসে বীর-এর বার্ষিক অধিনায়ক সম্মেলন-২০১১, জাতীয় পতাকা প্রদান অনুষ্ঠান ও প্রথম বীর পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন। রাজশাহী সেনানিবাস থেকে প্রধানমন্ত্রী যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে শহীদ ড. শামসুজ্জোহার মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে 'বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা ছাত্রী হল' এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও বক্তব্য দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী কাটাখালীতে নর্দান ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নির্মিত ৫০ মেগাওয়াট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেশিন উদ্বোধন এবং কাটাখালী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে সরাসরি মাদ্রাসা মাঠের জনসভায় যোগ দেন। রাতেই তিনি ফিরে যান ঢাকায়।
প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে নবরূপে সাজানো হয়েছিল মহানগরীকে। কাটাখালী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠ পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার রাস্তায় শত শত তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুন, ডিজিটাল ব্যানার, রং-বেরঙের পতাকা টানানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে। এই দীর্ঘ পথের দুই ধারে হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিয়ে ও হাত নেড়ে তাঁকে স্বাগত জানান।
সকাল থেকেই মানুষের স্রোত নামে ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে। রাজশাহীর ৯টি উপজেলা ছাড়াও আশপাশের জেলা নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া থেকেও হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে যোগ দেন জনসভাতে। ব্যান্ড পার্টির তালে তালে নেচে গেয়ে মানুষ আসতে থাকে সেখানে। বেলা ২টায় জনসভা শুরুর আগেই বিশাল মাদ্রাসা মাঠ ভরে যায়। বিকেল ৩টার দিকে মাদ্রাসা মাঠ ছাপিয়ে জনতার ঢল আশপাশের রাস্তা, শাহ মখদুম ঈদগাহ মাঠ, শহর রক্ষাবাঁধ ও জিরো পয়েন্ট থেকে কোর্ট চত্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
লাখো মানুষের উপস্থিতি সামাল দিতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের। প্রধানমন্ত্রী জনসভার মঞ্চে উপস্থিত হওয়া মাত্রই স্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, 'শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী দুই বছরে সারা দেশ, উত্তরবঙ্গ ও রাজশাহীর জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন করে আবারও সরকার ক্ষমতায় আসবে। আন্দোলনের ভয় আওয়ামী লীগ করে না। এটা কত প্রকার ও কী কী তা আওয়ামী লীগ জানে। আপনাকে (খালেদা) আন্দোলন করে ক্ষমতাচ্যুত করেছি আমরা।'
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও উপনির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচন কেন অবাধ হবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সব নির্বাচন নিরপেক্ষ করে সরকার প্রমাণ করেছে শেখ হাসিনা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, ভোট ডাকাতিতে বিশ্বাস করে না। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে হবে। তিনি বলেন, ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থায় শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করছেন।
সমাবেশে আরো বক্তব্য দেন এমপি ও ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, জিনাতুননেসা তালুকদার এমপি, মেরাজ উদ্দিন মোল্লা এমপি, শাহরিয়ার আলম এমপি, কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা এমপি, মজিবুর রহমান মজনু, কেন্দ্রীয় নেতা আক্তার জাহান, স্থানীয় নেতা মকবুল হোসেন, মীর ইকবাল, রফিক উদ্দিন আহম্মেদ, শফিকুর রহমান বাদশা, জাসদ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ শিবলী প্রমুখ।
জনসভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সতিশ চন্দ্র রায়, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক, শেখ হেলাল এমপি, অ্যাডভোকেট ফজলে রাবি্ব মিয়া এমপি, ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক এমপি, শামসুর রহমান শরিফ ডিলু এমপি, সাবেক ভিসি আবদুল খালেক, মমতাজ উদ্দিন, সাজেদুর রহমান খান এমপি, অধ্যাপিকা অপু উকিল প্রমুখ।
বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন গ্যাস সরবরাহের ঘোষণায় উচ্ছ্বাস

No comments

Powered by Blogger.