অক্সফোর্ডশায়ারে কয়েক দিন

শহরের একেবারে কেন্দ্রে ১.৮ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ইংল্যান্ডের সবচেয়ে পুরনো বাগান ‘দি ইউনিভার্সিটি বোটানিক্যাল গার্ডেন’কে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বিজ্ঞানভিত্তিক পার্কও বলা হয়ে থাকে।
‘ক্রাইস্ট চার্চের’ উত্তর-পূর্ব কোণে ‘চারওয়েল’ নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন বিশ্ববিদ্যালয় পার্কটি শহরের কেন্দ্র এবং উত্তরদিকের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে চলেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে উদ্ভিদের অবদান এবং ব্যবহার সংক্রান্ত গবেষণা চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে ১৬২১ সালে বাগানটি গড়ে তোলা হয়। প্রায় ৮০০০ প্রজাতির গাছপালা নিয়ে বাগানটি এখনও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বৃক্ষ সংরক্ষণাগার বলে বিবেচিত। নদী তীরের তৃণভূমিতে অবস্থিত বাগানটির বিভিন্ন বিরল প্রজাতির গাছ, লতাগুল্ম ও উদ্ভিদের সমারোহ এটিকে যেমন উদ্ভিদবিদদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে তেমনি এর বিশুদ্ধ বায়ু পরিশ্রান্ত মনকেও মুহূর্তের মধ্যে প্রশান্ত করে তোলায় এটি এখন বিনোদনকেন্দ্র হিসেবেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এলাকাটিতে নৌভ্রমণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাছাড়া এটি খেলাধুলার জন্যও ব্যবহার করা হয়। এই বাগানেরই কিছুটা অংশজুড়ে আছে ইহুদীদের প্রাচীন একটি সমাধিস্থল।
অক্সফোর্ড কেন্দ্রের পার্ক রোডে অবস্থিত আর একটি স্থাপনা ‘অক্সফোর্ড টাউন হল’। এখানে আঞ্চলিক সরকারের বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠিত হওয়া ছাড়াও এই স্থাপনাতেই ‘অক্সফোর্ড জাদুঘর’ স্থাপন করা হয়েছে। এই জাদুঘরে অক্সফোর্ড শহরের উন্নয়নের ইতিহাস, আদি বাসিন্দা, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাস ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
‘স্যাক্সন টাওয়ার’ চার্চটি ‘কারফ্যাক্স টাওয়ার’-এর উত্তর-দক্ষিণ দিকে অন্যতম শপিং এলাকা ‘কর্নমার্কেট’-এ পথচারীদের জন্য নির্ধারিত জায়গার ওপর অবস্থিত। এ্যাংলো-স্যাক্সন স্থাপত্যশিল্পের বৈশিষ্ট্যে পাথরের তৈরি এই চার্চটিই অক্সফোর্ডের সবচেয়ে পুরনো দালান।
কেন্দ্রের আরও একটি আকর্ষণ ‘মার্টিয়ার মেমোরিয়াল’ নামক পাথরের তৈরি স্থাপনাটি ১৮৪০ সালে নির্মাণ করা হয় যেখানে শহীদস্মৃতি স্মরণে আজও পর্যটকসহ বহু লোকের সমাগম ঘটে। এর ঠিক দক্ষিণ দিকে ‘সেন্ট ম্যারি ম্যাগডালেন’ চার্চের অবস্থান।
প্রাচীন ঐতিহ্য ও অনবদ্য প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘শেলডোনিয়া থিয়েটার’টি। ১৬৬৪-৬৮ সালে নির্মিত স্থাপনাটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ‘নিউ থিয়েটার অক্সফোর্ড’ অক্সফোর্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত। প্রধান এই বাণিজ্যিক থিয়েটার ভবনটির ধারণক্ষমতা ১৮০০। বছরজুড়ে এই হলঘরগুলোতে গান, কনসার্ট, কমেডিসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। ছুটির দিনগুলো তাই বিখ্যাত কোন থিয়েটার দেখে বা কোন ‘মিউজিক্যাল কনসার্ট’ উপভোগ করে আনন্দে কাটিয়ে দেয়া যায়।
শহরের কেন্দ্রে ১৭ শতকে স্থাপিত ‘কভার্ড মার্কেট’ নামের মার্কেটটি কিছুটা পরিবর্তিত হলেও এখনও সেখানে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। অর্ধেকটা জায়গাজুড়ে কাঁচাবাজারজাত দ্রব্যাদি বিক্রি হলেও এখানে কিছু বেকারি, উপহারসামগ্রীর দোকান গড়ে উঠেছে। এছাড়া কেন্দ্রের বিভিন্ন রাস্তায় ছোট ছোট দোকানসহ কাউলি এলাকা, সামারটাউনসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাবে উপহারসামগ্রী বা বুটিক শপ, পাথরের গহনা, অলঙ্কার বা এ্যান্টিকের দোকান, সেলুন, রেস্টুরেন্ট, কেক বা চকোলেটের দোকান, ‘টেইক এ্যাওয়ে’ খাওয়ার দোকান এবং ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট রয়েছে। কতক নামকরা চেন শপের দোকান, ‘মল’ ধরনের বাজার সবই আছে এই শহরে।
অক্সফোর্ডের আরও একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ‘অক্সফোর্ড ক্যাসেল’। প্রাথমিকভাবে ১০৭১ সালে মধ্যযুগীয় রোমান স্থাপত্য ধারায় নির্মিত কাঠের এই দুর্গটি অক্সফোর্ড শহরের পশিচমদিকে অবস্থিত। পরবর্তীতে এটিকে পাথর দ্বারা পুনর্নির্মাণ করা হয়। পুরনো অনেক রাজা-বাদশাহ্র ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধবিগ্রহের সাক্ষী হয়ে এখনও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে চলেছে দুর্গটি।
অক্সফোর্ড শহরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাড়িগুলোর নকশা মোটামুটি একই রকম। এই সামঞ্জস্যতা একটা আলাদা সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। ছোট ছোট বাড়ির সামনের অল্প জায়গাতে ফুলের বাগান। বাড়ি মানে এমনটাই হতে হবে এটাই যেন তাদের ঐতিহ্য।
অক্সফোর্ড শহরে বাস বা ট্যাক্সি সার্ভিস অনেকটাই সহজলভ্য। ছাদবিহীন বাসে চড়ে সহজেই শহরটি ঘুরে দেখা যায়। এছাড়া লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরে ট্্েরনেও যাতায়াতের সুব্যবস্থা আছে।
অক্সফোর্ড শহর ছাড়া পুরো অক্সফোর্ডশায়ারই যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে আছে। কোথাও ওক, ম্যাপলস্ এবং বাদাম গাছ বেষ্টিত স্বচ্ছ লেকের নিঃশব্দ সঞ্চালন, লতাগুল্মবেষ্টিত ক্ষুদ্র জলধারা, কোথাওবা সুসজ্জিতভাবে গড়ে তোলা গোলাপ বাগান, সেই সঙ্গে বিভিন্ন ঋতুতে গাছপালাগুলোর রং বদল যেন নতুন রূপে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে। যেহেতু যাতায়াত অনেকটাই সুবিধাজনক তাই সময় থাকলে অক্সফোর্ডের আশপাশের বিভিন্ন স্থানও ঘুরে দেখা যায়।
এরূপ অক্সফোর্ড থেকে প্রায় ছয় মাইল দূরে ইংরেজ স্থাপত্যশৈলীর অনবদ্য একটি নিদর্শন তথা ইতিহাসখ্যাত ‘ ‘ব্লেইনহেম প্যালেস’। ইংল্যান্ডের রানী এ্যান ‘মার্লবোরো’র প্রথম ডিউক জন চার্চিলকে পদবিসহ ১৭০৫ সালে নির্মিত এই ভবনটি উপহার হিসেবে প্রদান করেছিলেন। পরবর্তীতে ‘মার্লবোরো’র ডিউকদের আবাসস্থল হিসেবে এটি গড়ে ওঠে। ১৮৭৪ সালে স্যার উইনস্টন চার্চিল এখানেই জন্মগ্রহণ করেন। বাড়িটির ভেতরের বিরাটকায় হলঘর, বিভিন্ন রুচিশীল ও দুষ্প্রাপ্য শিল্পকর্মে সুসজ্জিত দেয়াল, তৈজসপত্র, কারুকার্যম-িত আসবাবপত্র, পাঠাগার সবই যেন ৩০০ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কাহিনী বর্ণনা করে চলেছে।
‘ভেইল অব হোয়াইট হর্স’ আঞ্চলিক সরকারের অধীনস্থ জেলাশহরের অন্তর্ভুক্ত ‘চিলটন‘ নামের ছোট একটি গ্রামে ছিল আমার অফিস যা ‘ডিডকট’ শহর থেকে ৫.৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। ‘ডিডকট’ শহরটি অক্সফোর্ড থেকে ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণদিকে অবস্থিত। প্রতিদিন অফিসবাসে করে অক্সফোর্ড শহর থেকে আমাকে সেখানে যেতে হতো। তাই অক্সফোর্ডশায়ার সম্পর্কে জানার একটা ভাল সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলাম। এবিংডন হয়ে ডিডকটের ভেতর দিয়ে আমার অফিসে পৌঁছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লেগে যেত। কিন্তু এই পুরো সময়টা অক্সফোর্ডশায়ারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সেই সঙ্গে শপিং এলাকাগুলোতে মানুষের আনাগোনা উপভোগ করতে করতে যেতাম বলে আমি কখনই ‘বোরড্’ হইনি। যদি যানজট অসহনীয় পর্যায়ে না থাকে তবে চলন্ত গাড়িতে দূরের পথে যাত্রার নামই তো ‘লং ড্রাইভ’ আর তা যদি হয় ইউরোপের একটা শহরতলিতে!
‘এবিংডন’ হচ্ছে এই জেলার প্রধান শহর যা আবার অক্সফোর্ড শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। টেমস্ নদীর তীরে অবস্থিত পুরনো এই শহরটি ঐতিহাসিক এবং প্রত্মতাত্ত্বিক দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানেও পুরনো আমলের কয়েকটি স্থাপনা দেখা যায়। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কয়েকটি পার্ক, বাগান, মাছ ধরা ও সাঁতারকাটার ‘স্পট’ এবং মার্কেট যা শহরটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে রেখেছে। আছে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা। বিশেষ ধরনের এই নৌকাগুলোতে চড়ে নদীতে ঘুরে বেড়ানো সেই সঙ্গে নদী তীরের শান্ত-মনোরম গ্রামগুলোর দৃশ্য অবলোকন মনকে অনেকটাই পুলকিত করে তোলে। অক্সফোর্ডশায়ারের এই অংশ চাষাবাদর জন্য এখনও খুব উপযুক্ত। তাই এখানে বড় বড় ফার্ম গড়ে উঠেছে। রাস্তার দু’পাশে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। কোন কোনটিতে আপেল বা নাশপাতির বাগান। মাঝে মাঝে দেখা যায় গাছের নিচে আপেল পড়ে স্তুপ হয়ে আছে কিন্তু হৈহুল্লোড় করে সেগুলো তুলে নেয়ার কেউ নেই। এ দৃশ্য দেখে আমাদের দেশের পুষ্টিহীন মানুষগুলোর মুখ ভেসে উঠে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কেন সেই সৌভাগ্যবানদের জায়গায় পৌঁছতে পারি না! (সমাপ্ত)
ড. জাকিয়া বেগম

No comments

Powered by Blogger.