আগরতলা যেন প্রাণের কাছাকাছি

সকালে আমরা রওনা হলাম ছবিমোড়া পাহাড়ের দিকে। একটি প্রাইভেট কারে বনের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পিচঢালা সরু পথে যাত্রা। প্রায় ১২ কিলোমিটার পাহাড়ি পথে আমাদের গাড়ি চলল।
জঙ্গল পাহাড়ের মধ্যে দেববাড়ী বাজারে সকালের নাস্তা পরোটা ও ডিম। উপজাতীয় এক যুবক ও তার স্ত্রী দোকান চালান। ওদের উপজাতীয় ভাষা ‘ককবরক’। আমাদের প্রত্যেককে তিনটি করে ডিম মামলেট দেয়া হলো। এত ডিম কেন ? প্রশ্ন করায় দোকানদার রেগে গেলেন। আমরা আর কথা বাড়ালাম না। গোমতী নদীর তীরে রুদ্র ভৈরবী খামারের ‘চাক্রাক্মা তীইবঙ্’ (উপজাতীয়দের বিশ্বাস : রাত্রী দেবী, যিনি রাতে বলিয়ান হয়ে ওঠেন। নর মাংস যার প্রিয়) ঘাট থেকে কোষা নৌকায় উঠলাম। আমাদের গাইড পাহাড়ী উপজাতীয় জমাতিয়া সম্প্রদায়ের নেতা অষ্টমোহন। নৌকা চালক অনন্ত গোপাল। গোমতী নদীর স্রোতের অনুকূলে আমাদের নৌকা চলল প্রায় ৪০ মিনিট। কিছু দূর যাবার পরই বিস্ময়ে হতবাক হলাম। পাহাড়ের গায়ে ছবি আঁকা হয়েছে নিখুঁত। তিন স্তরবিশিষ্ট ছবি। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে পাহাড়ের গাত্রে আঁকা দেব-দেবীর ছবি। প্রায় বারো শ’ বছর আগে আঁকা এসব ছবির অনেকগুলোই ধসে গেছে। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেল প্রাচীনকালে রাজারা নদী পথে যাতায়াত করতেন। রাজাদের চিত্ত বিনোদন বা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই তৎকালীন সময়ের আঞ্চলিক জমিদার ও মহলদাররা রাজাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই শিল্পীদের দিয়ে পাহাড়ের গাত্রে টেরাকোটার মতো ছবি এঁকেছেন। অপূর্ব ছবিসমূহ। যাবার সময় তো ছিল স্রোত অনুকূলে। এবার ফেরার পালা স্রোতের প্রতিকূলে। সময় লাগল তিন গুণ। দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীতে হাতড়িয়ে মাছ ধরতে দেখলাম উপজাতীয় যুবকদের। কি বলিষ্ঠ শরীর। ওরা দারুণ পরিশ্রমী। আইড় এবং রিঠা মাছ পাওয়া যায়। বেশ কয়েকটা মাছ ধরতে দেখলাম।
গোমতী নদীর উৎপত্তিস্থল আঠারো মোরা পাহাড়। এর দুটি ঝর্ণাধারা রাইমা ও শরমা থেকে গোমতী নদী প্রবাহিত হচ্ছে। গোমতী নদীর ৪২ মাইল ভাটিতে ভারত ষাটের দশকে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এরপর আরও প্রায় ৩৫ কিলোমিটার ভাটিতে রানীর বাজারে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছে রানীর ড্যাম। এখান থেকে ফিডার ক্যানেলে সেচের জন্য পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ত্রিপুরার সমতল ভূমিতে। ভাটিতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এক সময়ের খরস্রোতা গোমতী নদী এখন মৃতপ্রায়। ত্রিপুরার বিশালগড় হয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লার বক্সনগরে প্রবেশ করেছে গোমতী।
দুপুরে আমরা একটি প্রাইভেট কারে আগরতলা ফিরলাম। ফেরার পথে আঁকাবাঁকা সড়কের দু’ধারে দেখলাম বিশাল বিশাল সেগুন গাছ। শতবর্ষের পুরাতন না হলেও ওগুলোর বয়স তার কাছাকাছি তো বটেই। ভাবছিলাম এদেশে কি গাছ খেকোরা নেই ? সড়ক পথের প্রায় ৫০ কিলোমিটার এমন দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এই এলাকার ভূমির গঠন আমাদের পার্বত্য এলাকার মতোই।
আগরতলায় ফিরে আমরা নতুন অতিথিশালায় উঠেছি। শহরের ব্যস্ত সড়ক থেকে একটু ভেতরে রয়েল গেস্ট হাউস। বেশ সুন্দর। এটিরও আসবাবপত্র বাংলাদেশী একটি কোম্পানির। সন্ধ্যায় কবি সাহিত্যিকরা এলেন। জমলো লম্বা আড্ডা। আধুনিক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে চলল নাতিদীর্ঘ আলোচনা। ত্রিপুরার প্রখ্যাত কবি সেলিম মোস্তফা, কৃত্তিবাস চক্রবর্তী, প্রবুদ্ধ সুন্দর কর ছাড়াও তরুণ কবি আকবর আহম্মদ, পল্লব ভট্টাচার্য ও প্রদীপ মজুমদার। ওরা আসার সময় সবাই কিছু খাবার নিয়ে এসেছেন। পরিমাণে অনেক। রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলে আড্ডা।
পরদিন আমরা সারাদিন দেখলাম ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রতিকৃতি উদ্বোধন করেছেন। বিশাল ক্যাম্পাস। গাছপালায় ভরা। সুন্দর পরিবেশ। এর পর বাজার-দোকানপাট ঘুরলাম। কিছু কেনাকাটা করলাম। একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম প্রায় প্রতিটি দোকানেই বাংলাদেশী পণ্য। বিশিষ্ট সাহিত্যিক রাতুল দেব বর্মণ (শচীন দেব বর্মণ এবং রাহুল দেব বর্মণের নিকটাত্মীয়) জানালেন ওখানকার স্থানীয়রা বাংলাদেশী পণ্য দারুণ পছন্দ করে। ত্রিপুরা সরকার শহরে একটি জমি দিয়েছে বাংলাদেশকে। যেখানে নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশী মার্কেট। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী ফোরাম বেশ আগ্রহী হয়ে এগিয়ে এসেছেন। দুপুরে রাতুল দেব বর্মণের বাড়িতে আমরা নিমন্ত্রিত ছিলাম। খাবার টেবিলেই কথা হচ্ছিল। বিকেলে দেখলাম রাজবাড়ী। দেড় শ’ বছরের প্রাচীন রাজবাড়ীর সংস্কার কাজ চলছে। বিকেলে কপোত-কপোতীদের ভিড় রাজবাড়ীর আঙ্গিনায়। বেশ সুন্দর পরিবেশ। গেটে প্রবেশের জন্য টিকেট কাটতে হলো দু’টাকায়। বিশ একর জমির ওপর রাজবাড়ীর মধ্যে দুটি বড় দীঘি। প্রচুর মাছ দীঘির জলে ভাসছিল। বিকেলে মাছগুলো বেশ খেলা করছিল।
আমরা যাওয়া আসার পথে সীমান্তে দেখলাম বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় প্রবেশ করার অপেক্ষায় দুই শতাধিক পণ্য বোঝাই ট্রাক। এসব ট্রাকে রড, সিমেন্ট, ইট, বালু, খোয়া ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রী। রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশী মিঠা পানির মাছ এবং সামুদ্রিক মাছ। কাভার্ডভ্যান ভরে যাচ্ছে আসবাবপত্র। ওপার থেকে আসছে সামান্যই। ২৫ মে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব জামাই ষষ্টি। রাজবাড়ীর সামনে বটতলা বাজারে বড় বড় ইলিশ মাছ বিক্রি হতে দেখলাম। ভারতীয় মুদ্রায় ২ কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল কেজিপ্রতি ১২শ’ টাকায়।
বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ আয়তনের ত্রিপুরা রাজ্যের জনসংখ্যা মাত্র ৩৯ লাখ। জনসংখ্যার অর্ধেক নানা উপজাতীয় গোষ্ঠী। তবে বাংলা ভাষাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রায় ২৪ বছর একনাগাড়ে বামফ্রন্ট ক্ষমতায়। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বেশ জনপ্রিয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। ত্রিপুরার সমতল ভূমিতে ধান-গম উৎপন্ন হয়। পাহাড়ে জন্মে মসলা এবং ফল। ত্রিপুরার আবহাওয়া আমাদের দেশের মতোই। মানুষজন সহজ-সরল এবং আন্তরিক। (সমাপ্ত)
হাবিবুর রহমান স্বপন

No comments

Powered by Blogger.