সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী-ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি কোনো আপত্তি করেনি

টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বিএনপির অবস্থান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, '১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আপত্তি করেনি। তারা শুধু বলেছে, কনসালটেশন (পরামর্শ) করে হলে ভালো হয়। তারা লিখিতভাবে কিছু আদায় করতে পারেনি।' তিনি আরো বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি যদি সঠিক দায়িত্বটি পালন করত তাহলে আজ টিপাইমুখ প্রসঙ্গই উঠত না।


গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে টিপাইমুখ বাঁধের মতো জাতীয় ইস্যুতে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই সচিবালয়ে একটি সভায় যোগ দেওয়ার কথা বলে চলে গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে আশ্বাস অনুযায়ী গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে সাংবাদিকদের কাছ থেকে প্রশ্ন আহ্বান করেন তিনি। আগের দিনের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে নাকাল পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস এ সময় উপস্থিত ছিলেন না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। পাশাপাশি ভারতের বেঙ্গালুরুতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকের যৌক্তিকতা নিয়েও ব্যাখ্যা দেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনস্থল ছেড়ে যাওয়ার সময় বলেন, 'আজকের এই যাওয়াটাকে ভিন্ন যাওয়া হিসেবে নেবেন না আশা করি।' গতকালের সংবাদপত্রে বুধবার তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগের সমালোচনার বিষয়ে ইঙ্গিত করে তিনি সাংবাদিকদের নূ্যনতম শালীনতাটুকু বজায় রাখার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, 'নূ্যনতম শালীনতা সুস্থ রাজনীতির জন্য অপরিহার্য।'
টিপাইমুখ ইস্যুতে সরকারকে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সহযোগিতার আশ্বাসের বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'বিষয়টি খুবই ইন্টারেস্টিং। আমি বিরোধীদলীয় নেত্রীর সহযোগিতার আশ্বাসকে স্বাগত জানাই।' এর পরই তিনি বিরোধী দলের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, 'বিরোধীদলীয় নেত্রীর নেতৃত্বে ১০ বছর এবং তাঁর দলের নেতৃত্বে আরো পাঁচ বছর এ দেশে সরকার ছিল। তাঁরা যদি সঠিক কাজটি করতেন তাহলে আজকে টিপাইমুখ প্রসঙ্গটিই আসত না। এটি দুঃখজনক, লজ্জাজনক।' টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে বিরোধী দল ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে বিবৃতি দিচ্ছে এবং নানা রকমের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনার জন্য উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে কারা থাকছেন এবং দলটি কবে দিলি্ল যাচ্ছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ঢাকার এ আগ্রহের কথা আজ (বৃহস্পতিবার) দিলি্লকে জানানো হয়েছে। দিলি্লর কাছ থেকে সাড়া পেলে প্রতিনিধিদল ও সফরের তারিখ চূড়ান্ত করা হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ টিপাইমুখ নিয়ে দিলি্লর কাছে আরো তথ্য চেয়েছে এবং যৌথ সমীক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ সংসদীয় প্রতিনিধিদলের টিপাইমুখ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের ২১ মে ভারতীয় পক্ষ ওই প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছে, টিপাইমুখ প্রকল্পে দুটি পরিকল্পনা রয়েছে। এর একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন, অন্যটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ। সেচের জন্য বরাক নদের পানি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সেখানে নেই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এর পাশাপাশি ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার আশ্বাস এসেছে যে টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না।
টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশ ভারতীয় আশ্বাসে কতটা বিশ্বাসী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আসা আশ্বাসকে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, চুক্তিটি এখনো ভারত সরকার অনুমোদন করেনি। ৮৭ মাসে চুক্তিটি বাস্তবায়নের আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে তা অনুমোদন করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মমতার বিজয়ের পর এটি ছিল কেবলই সৌজন্য বৈঠক। এ বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যুতেও আলোচনা হয়েছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।
টিপাইমুখ প্রকল্প ইস্যুতে মণিপুর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠকের পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'এখনো এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জাতীয় স্বার্থরক্ষায় যা করা দরকার আমরা তা করব।'
টিপাইমুখ প্রকল্পের সাম্প্রতিক অগ্রগতির পর উদ্বিগ্ন কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু আছে কি নেই, পর্যালোচনার আগে তা কিভাবে বলি?' পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতকে টিপাইমুখ নিয়ে যৌথ সমীক্ষার আহ্বান জানানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, ওই সমীক্ষা থেকেই জানা যাবে তা বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে।
সাংবাদিকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, না বলে ভারত কিছু করতে পারবে না। পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, ভারতের আশ্বাসে বাংলাদেশ আস্থাশীল। অন্যদিকে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সরকারের অবস্থান কি তাহলে এক নয়?' জবাবে পররাষ্ট্রসচিব সরকারের মধ্যে অবস্থানগত ভিন্নতার কথা নাকচ করে দেন।
ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবেই সব সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে গেল, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন আলোচনার পরও অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশ ওই উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ অন্য ইস্যুগুলোতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে ফল না হলে আন্তর্জাতিক ফোরামের পথ থাকছে বলেও তিনি জানান।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, টিপাইমুখ প্রকল্প কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহৃত হবে বলে ভারত আবারও আশ্বাস দিয়েছে। ভারতকে ইতিমধ্যে যৌথ সমীক্ষা চালানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে টিপাইমুখ নিয়ে যেকোনো অগ্রগতির আগে তথ্য জানাতেও বাংলাদেশ ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় একযোগে কাজ করবে বলে বাংলাদেশ ও ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া মালদ্বীপের আদ্দুতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনেও বাংলাদেশ যৌথ নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব দিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে দুই দেশ একটি কাঠামো চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তিতে বিদ্যুৎ ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় দুই দেশের একযোগে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।


No comments

Powered by Blogger.