টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আগে আলোচনা প্রয়োজন : ঢাকা

ভাটির দেশ হিসেবে বরাক নদীর মতো অভিন্ন নদীতে কোনো প্রকল্প শুরুর আগে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বলেছে, টিপাইমুখের প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে কোনো ধরনের উদ্বেগ ও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে ভারতের 'স্বচ্ছতা'র সঙ্গেই বাংলাদেশকে তথ্য দেওয়া উচিত। ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে টিপাইমুখ বহুমুখী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের চার দিনের মাথায় গতকাল মঙ্গলবার


সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান তুলে ধরে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ভারত টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে গতকাল বিবৃতি দেওয়ার আগে বাংলাদেশকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি। টিপাইমুখ ইস্যু নিয়ে ভারতের বিবৃতি আরও পর্যালোচনা করে আজ বুধবার বিস্তারিত জানানো হতে পারে।
এদিকে ভারত এক বিবৃতিতে বলেছে, টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। বাংলাদেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিষ্ণু প্রকাশ গতকাল দুপুরে বলেছেন, এটি হবে বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সেচের পানি সরিয়ে নেওয়ার জন্য নয়। প্রকল্পটির জন্য একটি কোম্পানি গঠনের লক্ষ্যে ২২ অক্টোবর মণিপুর সরকার, জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম (এনএইচপিসি) ও রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থার (এসজেভিএন) মধ্যে প্রমোটারস চুক্তি হয়। টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এনএইচপিসি ও এসজেভিএনের মধ্যে একটি যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি সই হওয়া নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হলো।
এদিকে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের এ বিবৃতিতে নতুন কোনো বক্তব্য নেই। মনমোহন সিংয়ের পুরনো প্রতিশ্রুতির কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, টিপাইমুখে
জলাধার ও বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে বিরাট এলাকার পাহাড়-জঙ্গল জলে ডুবে যাবে এবং অনেক প্রাণিসম্পদ ধ্বংস হবে। ঘর আর জীবিকা হারাবে বহু মানুষ। তাছাড়া টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরে সেটি ভূমিকম্পে ধসে পড়লে আসাম ও বাংলাদেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, দু'দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশ আশা করছে, ভারত সরকার পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিস্তারিত এবং ভবিষ্যতে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে তা-ও জানাবে। বাংলাদেশের উদ্বেগ কমাতে বা বোঝাপড়ার দূরত্ব দূর করতে এটা জরুরি। ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ অভিন্ন নদীতে কোনো অবকাঠামো তৈরির আগে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনার ওপর জোর দিতে চায়। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে দু'দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিবেচনায় বাংলাদেশ আশা করে, ভারত সরকার প্রস্তাবিত প্রকল্পের সব বিষয়ে এবং এ সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে জানাবে। মন্ত্রণালয় জানায়, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে পূর্ণ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে তথ্য ভাগাভাগিই পারে ভবিষ্যতে এ নিয়ে যে কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবসান করতে।
'টিপাইমুখ প্রকল্পে সেচ ব্যবস্থার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। এটি শুধু একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।' ভারতের এ বক্তব্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, দু'দেশের প্রধানমন্ত্রী দু'দেশ সফরের সময় আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল_ দু'দেশের স্বার্থহানি হয় এমন কোনো কিছু করা হবে না। বাংলাদেশ আশা করছে, ভারত এ প্রকল্পের ব্যাপারে বিস্তারিত এবং স্বচ্ছভাবে বাংলাদেশকে জানাবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো প্রকল্প সম্পর্কেও বাংলাদেশকে জানানো হবে।
ভারতের মুখপাত্র বলেছেন, টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করা প্রতিবেদন আমরা দেখেছি। এ প্রকল্পের সাম্প্রতিক অবস্থা হচ্ছে এই যে, একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি (জেভিসি) গঠনের লক্ষ্যে মণিপুর সরকার, জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম (এনএইচপিসি) ও রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থার (এসজেভিএন) মধ্যে একটি প্রমোটারস চুক্তি হয়েছে। জেভিসির নামকরণ হবে 'টিপাইমুখ হাইড্রো-ইলেকট্রিক করপোরেশন লিমিটেড' বা অন্য কোনো নামে, যার অনুমোদন দেবে সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ। তিনি বলেন, স্মরণ করা যেতে পারে, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী এবং পানিসম্পদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ১০ সদস্যের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল ২০০৯ সালে ভারত সফর করে। সে সময় তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, টিপাইমুখ প্রকল্পটি বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি সেচের জন্য পানি ভিন্ন খাতে সরিয়ে নেওয়ার জন্য নয়। মুখপাত্র আরও বলেন, এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১০ সালের জানুয়ারিতে নয়াদিলি্ল সফরের সময় তাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পুনরায় আশ্বস্ত করেন, বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এমন কোনো পদক্ষেপ টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারত নেবে না। এ বছরের সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে একই ধরনের আশ্বাস দিয়েছেন।
হাইড্রোওয়ার্ল্ডডটকম নামে একটি ওয়েবসাইট বলেছে, ২২ অক্টোবর সই হওয়া যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পে এনএইচপিসি ৬৯, এসজেভিএন ২৬ এবং রাজ্য সরকারের পাঁচ ভাগ মালিকানা থাকবে।
মণিপুর সরকারের মুখপাত্র ও রাজ্যের সেচ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী এম বিরেন সিং বিবিসিকে টেলিফোনে বলেন, রাজ্য সরকারের নীতি খুব পরিষ্কার। টিপাইমুখ প্রকল্প হবেই। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তা, বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারত উন্নয়ন দফতর এর জন্য টাকা দেবে। প্রকল্পটি তৈরি হবে এনএইচপিসির নেতৃত্বে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ডিসেম্বরের শুরুর দিকে মণিপুর সফর করবেন। রাজ্য সরকার চেষ্টা করছে টিপাইমুখ প্রকল্পটিকে প্রধানমন্ত্রী যাতে জাতীয় প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করেন।
জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম বলছে, টিপাইমুখ প্রকল্পটির সাহায্যে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে বরাক নদীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণও করা যাবে। ওই প্রকল্পে ১৬২ মিটার উঁচু বাঁধ থাকবে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ছয়টি ইউনিট থাকবে, যার প্রতিটির ক্ষমতা হবে ২৫০ মেগাওয়াট করে। যে সরকারি সংস্থাটি অনেকদিন ধরে টিপাইমুখ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিল সেই নিপকোর হাত থেকে ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়ে নেয় ভারত সরকার। সে সময় ভারত আর বাংলাদেশে টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপক বিরোধিতা শুরু হয়েছিল।
বিবিসির রিপোর্টার অমিতাভ জানান, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, শুধু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে নদীর নিম্ন অববাহিকায় কোনো সমস্যা হবে না বলে ভারতের পক্ষ থেকে যে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে তার কোনো ভিত্তি দেখা যাচ্ছে না। যদি এনএইচপিসি এবং সাতলেজের ওয়েবসাইট দেখা যায়, এই প্রকল্পে জল জমা রাখা হবে। এর লক্ষ্য হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা। প্রশ্ন হলো, এই জল যে জমা রাখা হবে অর্থাৎ জলটা টেনে নেওয়া হবে এবং তা বড় জায়গায় জমা রাখা হবে। যেমন তিস্তার ক্ষেত্রে হয়েছে। সেই জলের পরিমাণটা কত? জল কোথা থেকে টানা হবে। বাড়তি জল বন্যার সময় ছাড়া হলে তার কী প্রভাব ওই অঞ্চলের ওপর পড়বে এবং অন্য দেশের ওপর পড়বে। এগুলো কিন্তু প্রশ্ন। এসবের উত্তর ভারত সরকার এখনও দেয়নি বা এই সংস্থাগুলো দেয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি শুধু একটি মাত্র জায়গায় আটকে রয়েছে, সেটা হলো বন দফতরের অনুমতি তারা এখনও পায়নি। এ ছাড়া যাবতীয় অনুমতি পাওয়া গেছে।

No comments

Powered by Blogger.