জেন্ডার বৈষম্য ও জেন্ডার সচেতনতা

মানব জাতির অর্ধেক পুরুষ আর অর্ধেক নারী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতোই বাংলাদেশের একই অবস্থা। দেশের অর্ধেক জনগণ নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সবসময় পেছনে টেনে রাখে।
আর এ জন্যই উন্নতির গতি ত্বরান্বিত হয় না। তাই সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে আজকে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো জেন্ডার ধারণা। এটি এমন একটি বিষয় যেখানে নারী ও পুরুষের সামাজিক ভূমিকা, অবস্থা, অবস্থানের সাম্য ও অসাম্যের দিকগুলো বিশ্লেষণ করে থাকে। এর ফলে পাওয়া যায় জেন্ডার বৈষম্যের কারণসমূহ। বৈষম্যের কারণগুলো শনাক্ত করা গেলে তা প্রতিকারের উপায়গুলোও পরিষ্কার হয়ে যায়। তখন জেন্ডার সাম্য, জেন্ডার সমতা, জেন্ডার মূলধারাকরণ, জেন্ডার সচেতনতা, এরা জেন্ডারবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মতো পদক্ষেপগুলোতে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়।জেন্ডার সচেতনতার মূল উদ্দেশ্য হলো জেন্ডার বৈষম্যের শিকার নারীর প্রতি বৈষম্য হ্রাস ও নারীর ক্ষমতায়ন করা। নারী নির্যাতন ও অনগ্রসরতার কারণ হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার ভূমিকা না থাকা অথবা দুর্বল ভূমিকা। সারা বিশ্বে পুরুষের ১ ডলারের বিপরীতে নারী পায় ৭০ সেন্ট। এটি শুধু কর্মজীবী নারীর অবস্থাকে ব্যাখ্যা করে। যে নারীকে গৃহকর্মে আবদ্ধ রেখে শ্রম শোষণ করা হয় তাকে কোন অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়া হয় না। আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত বৃহত নারী গোষ্ঠীকে অর্থের জন্য, বস্ত্রের জন্য, আশ্রয়ের জন্য সারাজীবন কারও না কারও উপর নির্ভর করে জীবন কাটাতে হয়। আর এ কারণেই নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে না। এই অক্ষমতা জন্ম দেয়, নারী নির্যাতন, দৈহিক অত্যাচার, মানসিক অত্যাচার, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক সমস্যা, তালাক, নারী পাচার, গণিকাবৃত্তি, অপহরণ প্রভৃতির।
নারী নির্যাতন রোধে সরকার যেসব আইনী বিধান রেখেছেন তার উল্লেখযোগ্যগুলো হলো ১৯৮০ এবং ১৯৮৬ সালের যৌতুক নিরোধক আইন। ২০০০ এবং ২০০৩ অনুযায়ী নারী নির্যাতন দমন আইন। অপহরণ ও পাচার, ধর্ষণ রোধে ১৯৮৩ নারীর প্রতি নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স। বর্তমান সরকার ও নারী উন্নয়নে ও নারী অধিকার সংরক্ষণে কতিপয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন যা ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার।
বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মকাণ্ডে নারী শিক্ষায় সরকারের সদিচ্ছার ফলে নারী শিক্ষার হার ও দ্রুত বেড়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সীমিত অংশগ্রহণ, নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব,নারীদের কর্মসংস্থানের অভাব, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব,নারী অধিকার আইনের প্রয়োগহীনতা,নারীর প্রতি অমর্যাদা ও অবহেলার ফলে নারীরা অনগ্রসরই রয়েছে । অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর কোন সুফল দেখা যাচ্ছে না।
আবার অনেক বাবা মাই মেয়ে সন্তানের সামাজিক নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে । ফলে মেয়েকে চাকরিতে বা কর্মক্ষেত্রে দেয়ার বিপরীতে তারা তাকে বিয়ে দেন। একজন শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত নারী তখন গৃহকন্নায় ব্যস্ত হয়ে যান। সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনের মতো মহান কাজে ব্রতী হন। আমাদের সমাজে নারীর প্রতি পুরুষদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়েছে।অনেক স্বামী চান না যে তার স্ত্রী উপার্জন করুক। তাই নারীকে উপার্জন ক্ষেত্রের বাইরে রেখে নিজে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে ।আর্থসামাজিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে জন্ম দেন, ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাকারবারী তথা অনৈতিক কার্যকলাপ। অথচ একটু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করলে হয়ত তার পরিবারের চাহিদার যোগানে স্ত্রীর উপার্জন ও ভূমিকা রাখতে পারত।
সন্তানদের একটু বড় করে স্কুলে পাঠাবার পর অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের চিন্তা করেন। তখন চাকরির বয়সসীমা হয়ে দাঁড়ায় প্রধান বাধা। কারণ শিক্ষিত করার সমস্ত উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করলেও তাকে কর্মক্ষম করার জন্য চাকরির বয়সকে উন্মুক্ত অথবা শিথিল কোনটাই করেননি। কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া সাধারণ শিক্ষায় কর্মসূচী গ্রহণমূলক কিছু বিষয় রয়েছে।যেমন সেলাই, কাটিং, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। অথচ এ সকল কাজকে হাতে কলমে শেখাবার মতো বিষয় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত নয়। যেটুকু আছে তা হলো তাত্ত্বিক প্রয়োগ, অনুশীলনমূলক নয়। ফলে নারী তখন অত্যাচার, নির্যাতন সয়ে পরনির্ভরশীল জীবন কাটান, অকাল মৃত্যুর বলি হন। অথবা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
নারী উন্নয়নের জন্য ১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব সম্মেলন। ১৯৭৬-৮৫ কে নারী দশক হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। ১৯৯৫ সালে নাইরোবী অগ্রগতি কৌশলসমূহ, ১৯৯৫ সালের চীনের বেইজিং-এ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন, চষধঃভড়ৎস ঋড়ৎ অপঃরড়হ (চঋঅ) এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে গৃহীত হয় ঈড়হাবহঃরড়হ ড়ভ ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ উরংপৎরসরহধঃরড়হ অমধরহংঃ ডড়সবহ (ঈঊউঅড)। এর আলোকে সরকার জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এগুলো হলো শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক ও সহপাঠিদের জেন্ডারবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, পারিবারিক ক্ষেত্রে জেন্ডার সচেতনতা প্রয়োগ করা,জেন্ডারবান্ধব উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। অর্থাৎ ঊয়ঁধষরঃু ড়ভ ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু ধহফ ঃৎবধঃসবহঃ রহ বসঢ়ষড়ুসবহঃ, বাস্তবসম্মত জেন্ডার চাহিদা পূরণের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের জন্য সমাজ নির্ধারিত ভূমিকা দায়দায়িত্ব, আচরণ এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনা।
এরপরও আর ও কিছু বিষয় রয়েছে যেসব বিষয়ের দিকে বাস্তবমুখী কর্মপ্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন।প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করা।নারীকে তার যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের বয়সসীমা উন্মুক্ত রাখা।নারীর উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ বা সংগ্রহ করার জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সেন্টার তৈরি করা।নারী উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ ও নারী নির্যাতন আইনের ফলে নারী কল্যাণ যেন সুশিক্ষিত হয় তার ব্যবস্থা করা। নারীকে নারী হিসেবে নয় তাকে পরিবারে, যানবাহনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে উন্নয়ন সহকর্মী হিসেবে ও একজন মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।
নারী ও পুরুষের যে লিঙ্গ বিভাজন তার প্রেক্ষিতে তাকে বিচার না করে তার ভূমিকাকে বিচার করলে ও একজন মানুষ হিসেবে তার প্রতি যথাযথ সম্মান মর্যাদা প্রদর্শন করে অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারলেই আসবে জেন্ডার সমতা আর এ জন্য নারী পুরুষ সবাইকে স্বস্থানে থেকে হতে হবে জেন্ডার সচেতন।
ফাতেমা আক্তার

No comments

Powered by Blogger.