‘ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়’ by ড. মধুশ্রী ভদ্র

নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে খুলনার করোনেশন গভঃ গার্লস হাই স্কুলের ভূমিকা সত্যিই উজ্জ্বল ও প্রশংসার দাবিদার। এই বিদ্যালয় শতবর্ষ যাবত নারীদের মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে জীবনকে সার্থকতায় ভরে দিতে ব্রতী হয়েছে।
বর্তমানে এই স্কুলের নাম- সরকারী করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, খুলনা। ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠের শর্তবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান হয়ে গেল ক’দিন আগে। আর স্কুলের এই শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমরা তিনজন প্রাক্তন ছাত্রী (আমি, ড. মারুফী খান ও আফরোজা আক্তার) শীতের তীব্রতা, ও হাড়কাঁপানো কনকনে ঠা-া আর হীম শীতল বায়ুপ্রবাহকে উপেক্ষা করে রওয়ানা দিলাম ঢাকা- খুলনাগামী আন্তঃনগর ট্রেন চিত্রা এক্সপ্রেসে। সারাদেশের তাপমাত্রা যখন ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়ে দেশটা যখন ডিপফ্রিজ হয়ে গেছে, তখন রাতের রেলগাড়িতে চড়ে আঁধারের রূপ দেখতে দেখতে অন্য এক রোমাঞ্চ ও ভাললাগার অনুভূতিতে ভরে উঠল মনটা।
স্মৃতির সাজানো পৃষ্ঠাগুলো ক্রমশ খুলে যেতে লাগল চোখের সামনে; ছোট্টবেলার সেই সোনাঝরা দিনগুলো নানা মাত্রিকতায় বর্ণিল হয়ে দেখা দিল। আমার মা (ড. মঞ্চুশ্রী চৌধুরী ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। তখন সরকারী চাকুরে মানেই ঘন ঘন বদলি। আমার ‘মা ষাটের দশকে সমগ্র খুলনা ডিভিশনের এসিস্টেন্ট ইন্সপ্রেকট্রেস্ অব স্কুলস্ হয়ে সিলেট থেকে বদলি হয়ে খুলনা এসেছিলেন। সঙ্গে আমাদের বাবা ও তিন নাবালক শিশু সন্তান। আমি ভর্তি হলাম খুলনার করোনেশন গভঃ গার্লস্ হাইস্কুলে, ক্লাস ফোরে, ভাই অরূপ, সেন্ট জোসেফ স্কুলে- ক্লাস থ্রি-তে ও বড় দাদা শুভাগত দৌলতপুরে। তখন খুলনা ডিভিশন মানে অনেক বিশাল, যার অধীনে অনেক জেলা ছিল। স্কুল পরিদর্শনে মাকে প্রায়ই ট্যুরে যেতে হতো। তখনকার দিনে স্কুল ইন্সপেকট্রেসকে গ্রামবাসীরা দেবী মনে করত। মায়ের সামনে রাজভোগ, গব্য ঘৃত, হরিণের চামড়া, ডাব, যশুরে কৈ ও লিচু, ক্ষীর ও নারিকেলের সন্দেশ, পায়েশ, সরপড়া দই, লাল মোহন, রসগোল্লা বড় সাইজের, পান্তুয়া ও ভূরি ভূরি দ্রব্যা বিরাট টেবিলের (‘সুখে থাক’ রেখা ঢাকনি এমব্রয়ডারি করা) উপর সযত্নে সাজিয়ে রাখত স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আমার নীতিবান আদর্শবান, সত্যনিষ্ঠ, দক্ষ প্রশাসক ব্যক্তিত্বময়ী মা শুধু এক গ্লাস ডাবের জল ছাড়া কিছুই স্পর্শ করতেন না। তখন করোরেশন গার্লস স্কুলের হেডমিসট্রেস ছিলেন দক্ষ প্রশাসক মিসেস হাসিনা খানম, আমাদের পারিবারিক শুভাকাঙ্খী ও মায়ের বান্ধবী এবং ড. মারুফীর মা। আজ প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় পরে আমরা দাইমায়ের দুই মেয়ে, স্কুলের শতবর্ষ পূর্তির মহোৎসবে যোগদান করতে যাচ্ছি। বিষয়টি কাকতালীয়। কত যুগ পূর্বে সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমাদের মায়েরা শত প্রতিকূলতা, বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে দীর্ঘ কর্মজীবনে মেধা ও মননের সমন্বয় ঘটিয়ে সুনামের সাথে দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকা পালন করে গেছেন, এজন্য আমি গর্ববোধ করি।
স্মৃতির ঝাঁপিটা ক্ষণিকের তরে বন্ধ করতে হলো মাফী ও আফরোজার জন্য। রাত সাড়ে দশটা। আফরোজার নিজের হাতে তৈরি মাংস- ্পরোটা, মাফীর স্বাদু পুডিং ও আমার তৈরি চপ লুচি ও আলু- ফুলকপির জালনা দিয়ে আমরা রাতের ডিনারটা সেরে ফেললাম একসঙ্গে। কম্পার্টমেন্ট তাপানুকূল হলেও বগিতে শীতের আমেজ বেশ ছিল। কুউ-ঝিক ঝিক শব্দে বিদ্যুতগতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। ট্রেনের দুলুনিতে গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙল ঘোষিকার কণ্ঠস্বরে। শীতের সকাল বেলায় সোনা ঝরা রোদ্দুরের মাঝে ট্রেন প্রবেশ করছে খুলনা শহরে। অকারণ পুলকে মনটা নেচে উঠল। কত বছর পর খুলনা আসলাম । আজ থেকে প্রায় ৪৪ বছর আগে বাবা মা ভাইদের সাথে। রকেট (স্টীমার) চড়ে পশুর নদীর তীরে এসে নেমেছিলাম। তারপর তিনটি বছর হাসি আনন্দে কাটিয়ে অনেক বন্ধুকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিলাম ঢাকা। সেদিন ও রকেটে করেই নদীভ্রমণ করে ফিরেছিলাম; স্টীমার ঘাটে দাঁড়িয়েছিলেন কত আপনজন অশ্রুসজল চোখে, যাঁদের ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল খুব।
নগরায়ণের যান্ত্রিক সভ্যতা থেকে দূরে এসে ট্রেনের দু’পাশের সবুজ শ্যামলিমার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলাম। খালবিলের পানির ওপর ঝরে পড়া অজস্র ফুলের আস্তরণের দৃশ্য নয়ন লোভন, পাশে সুউচ্চ সবুজ বৃক্ষ।
স্টেশনে নেমে বিদ্যোৎসাহী মাসুদ ও তার স্ত্রী রতœার সঙ্গে পরিচয় হলো, তারা আফরোজার ভাই ও ভাবী। তাদের আতিথেয়তার কোন তুলনা নেই। বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়েছে করোনেশন স্কুল। দেখলাম, এখন প্রবেশদ্বার দুটো, যা বাহারী নকশায় বর্ণময় আগে ছিল একটি গেট। নতুন ভবন ও স্থাপনা গড়ে উঠেছে, অনেকটাই পরিবর্তন সূচিত হয়েছে স্কুল ক্যাম্পাসে। লাল-সাদা শাড়িতে সুসজ্জিত অসংখ্য মেয়ের কল- কাকলিতে মুখর স্কুল প্রাঙ্গণ, কি যে ভাল লাগল দেখে। ষাট ও সত্তর এবং আশির দশকের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর আগমন ও যোগদান এই অনুষ্ঠানে যোগ করেছিল ভিন্ন মাত্রা, কারণ তারা আমাদের মতই নিজ কর্মস্থল (ঢাকাসহ অন্য জেলা) থেকে খুলনা এসেছিলেন শুধুমাত্র এই মহামিলনকেন্দ্রে যোগ দিতে। এখানে এসে এই বিদ্যাপীঠের অনেক রতœরাজির সঙ্গে দেখা হলো তাঁরা হলেন অধ্যক্ষ শেফালী মাহবুব; প্রফেসর- সুলতানা; বাংলাদেশের প্রথম মহিলা সচিব -ড. তাহমিনা হোসেন, অনেক লেডি ডক্টর, সমাজ কর্মী, প্রকৌশলী, উকিল, শিক্ষাবিদ, শিক্ষিকা, স্থপতি তারা এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী যারা কৃতিত্ব ও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের এই গৌরবময় পদচারণা আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করে। একজন নারী হিসেবে আমি যখন প্রত্যক্ষ করি, এই স্কুলের ছাত্রীদের মেধার উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন, তখন আমি গর্বিত হই। এমনকি বিদেশেও তারা মেধার বিকাশ ও প্রতিফলন রেখে চলেছেন। যা অহংকার করার মতই। শতবর্ষের সফল পরিক্রমায় আধুনিকতায় উত্তীর্ণ এই বিদ্যাপীঠ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমার ছোট বেলার বান্ধবী ভুটান (ডা. আবিদা), আছিয়া (ডা. আছিয়া), মাহমুদা (প্রফেসর), দীপালি, ও জাহানারার সঙ্গে দেখা হলো না। ওরা আসতে পারেনি; আফসোস্ । শৈশবের আনন্দময় ও স্বর্ণালী তিনটি বছর হেসে খেলে নেচে-গেয়ে উপভোগ করেছি। ‘সোসাইটি হলে’ নৃত্যপরিবেশন, গান -গাওয়া, আবৃতি, অভিনয়ে সবাই মিলে অংশগ্রহণ করতাম।
বান্ধবীদের স্পর্শ পেতে স্কুলের পুকুরপারে যাব, মনস্থ করে অনেক খুঁজলাম। নাহ, পুকুরটি আর নেই, ভরাট হয়ে গেছে। আশপাশে নতুন বিল্ডিং। পুকুরটি কেন ভরাট হলো এই দুঃখ বেদনা সারাদিন মনের মাঝে বাজল। আবারও স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেল এই পুকুরে ছিল লাল শাপলা, গোল গোল সবুজ পাতা। ছিল অনেক মাছ। আমি মাফী- (মারুফী), খোকন, অরূপ বিকেলবেলা পুকুরে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতাম। সে কি আনন্দ।
স্কুলের প্রাঙ্গণ ছিল সবুজ নরম মখমলের মতো দূর্বাদলে আবৃত, যার ওপর দিয়ে আমি ও ভুটান (ডা. আবিদা) আলতো পায়ে হেঁটে বেড়াতাম। এ সবই আমাকে এখনও আবেগাপ্লুত করে। ইন্দমোহনের ‘লাল মোহনের কি যে স্বাদ ছিল।
মুগ্ধ হলাম প্রতিষ্ঠান প্রধান ফারহানা নাজের আন্তরিকতায়। যোগ্য লোক ও গুণীজনকে সম্মান দিতে ফারহানা নাজ কার্পণ্য করেননি মোটেও, তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। ষাটের দশকেও এই বিদ্যাপীঠে ছিলেন অনেক সুশিক্ষক, যাদের অপার স্নেহে ধন্য হয়েছি আমি।
সেই ছোটবেলার মতই একরাশ আনন্দ ও চঞ্চলতা নিয়ে কাটিয়ে দিলাম তিনটি দিন, থাকলাম সি. এস কেন্দ্রে। শিশুকালের স্মৃতির সেই স্বর্ণঝাঁপিতে আরও আছে মণি-মাণিক্য- মুক্তা। খুলনায় আমাদের বাসা ছিল খানজাহান আলী রোডের মোড়ে লাল সিরামিক ইটের নির্মাণ শৈলীতে দোতলা প্রাসাদসম বিল্ডিং, নিচ তলাতে মায়ের অফিস, উপরে বাড়ি। প্রতিদিন সকাল বেলা ১ জোড়া সাদা কবুতর এসে আমাদের ভিতর বারান্দার দরজার ওপর বসত। ও ‘বাকুম বাকুম’ করে বাড়ি মুখরিত করে তুলত। শর্তবর্ষ পূর্তির নবীন- প্রবীণের মহামিলনে এই অনুষ্ঠানে এসে বলতে ইচ্ছে করে “পুরনো সেই দিনের কথা, ভুলবি কিরে হায়/ ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়।”

No comments

Powered by Blogger.