স্বপ্নের শালিমার by মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক

এ দরবার হলের কৃত্রিম জলপ্রপাতের ওপর সম্রাটের আসন গ্রহণ করার জন্য স্থাপন করা হয়েছিল কালো মার্বেলের সিংহাসন। সিংহাসনের পাদদেশ দিয়ে বয়ে যেত জলধারা।
দ্বিতীয় চত্বরটি অগভীর জলাশয়ের মাধ্যমে পরিবেষ্টিত। এখানে ছিল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, আমলা অমাত্যদের জন্য ‘দেওয়ান-ই-খাস’। এ চত্বরে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল নিষিদ্ধ। এখানে বসে সম্রাট তার অতিথিদের সঙ্গে খোশ গল্পে মশগুল হতেন, পানপাত্রে আকণ্ঠ নিমগ্ন হতেন, পরামর্শ করতেন, রাজ্য শাসনের ফরমান জারি করতেন। এখানকার ঝরনাধারা বিন্যাসিত মার্বেল পাথরের মসৃণ মেঝে এখনও দৃশ্যমান। এ চত্বরের অনতিদূরে উত্তর পশ্চিম প্রান্তের দেয়াল সংলগ্ন অবস্থানে ছিল রাজকীয় হাম্মামখানা বা বাথরুম।
তৃতীয় চত্বরটিতে জলধারা প্রবাহিত হতো জেনানা বাগিচা বা মহিলাদের বাগিচাকে কেন্দ্র করে। এর পার্শ্বদেশেই দেওয়ান-ই-খাস’র অবস্থান যার চারপাশ চিনার গাছের সারিতে সজ্জিত। এ ছাড়াও এ চত্বরেই ছিল নিরাপত্তা রক্ষীদের অবস্থান স্থল বা গার্ড রুম এবং রাজকীয় সেবিকাদের হেরেম। এ হেরেমে গমনাগমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সম্রাট ব্যতীত সেখানে কারো প্রবেশাধিকার অনুমোদিত ছিল না। হেরেমের নারীদের হেফাজতের জন্য দায়িত্ব পালন করত খোঁজা রক্ষীরা। পরবর্তী সময়ে সম্রাট শাহজাহান এখানে আরও অনেক সংস্কার কাজ করে এটিকে আরও সুন্দর ও নান্দনিক করে তুলেছিল।
শালিমার বাগের স্থাপত্যশৈলীর এক অনবদ্য সৃষ্টি ছিল বাগিচার জলপ্রপাতের পশ্চাতে নির্মিত ‘চিনি খানা’। চিনি খানার খোপে খোপে তেলের বাতি জ্বালিয়ে রাখা হতো। এ সমস্ত অসংখ্য আলোবর্তিকা জলপ্রপাতের নিপতিত জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে সৃষ্টি করত চন্দ্রালোকের মতো অলোকজ্জ্বল আবহ। প্রবাহিত জলে প্রতিসরিত হতো নানা বর্ণের রঙের চ্ছটা, বাহ্যিকভাবে সৃষ্টি করা হতো স্বর্গীয় আমেজ।
এখানকার কালো পাথরের চত্বরটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলের প্রারম্ভিক পর্যায়ে নির্মিত হয়েছিল যার কারুকার্য খচিত সিলিংয়ে ফারসী ভাষায় উৎকীর্ণ ছিল, ‘গার ফিরদাউস রোই ই জামিন আস্ত, হামিন আস্ত, ও হামিন আস্ত, ও হামিন আস্ত’। এর ভাষান্তর করলে বাংলায় অর্থ দাঁড়ায়, ‘কেউ যদি প্রশ্ন করে পৃথিবীতে স্বর্গ কোথায়, আমি বলব, এখানেই স্বর্গ, এখানেই স্বর্গ, এখানেই স্বর্গ’।
লাহোরের শালিমার গার্ডেনের মতো এ স্থাপনাটিও মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের শাসনামলে রাজকার্যসহ বিনোদনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এখানকার মার্বেল পাথরের প্যাভিলিয়নটি ইউরোপীয়ান অতিথিদের অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আলোকজ্জ্বল জলধারার পরতে পরতে প্রতিধ্বনিত হতো নর্তকীদের নূপুরের ছন্দ, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় ঝংকৃত হতো বীণা, তানপুরা এবং সেতারের তার। আধুনিকতার প্রারম্ভে কাশ্মীরের শাসনকর্তা মহারাজা হরি সিংয়ের উদ্যোগে এ উদ্যানে বিজলি বাতির ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়কালে এ উদ্যানের সংস্কার, বিস্তৃতকরণ এবং বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হলেও সকল মহলে, সকলের কাছে এ উদ্যান সব সময় শালিমার বাগ নামেই সমধিক পরিচিত। আজও সকলেই গার্ডেনটিকে ও নামেই অভিহিত করে থাকে।
মুঘলদের পতনের পর মহারাজার শাসনকাল পর্যন্ত এ বাগিচা ভালভাবেই রক্ষণাবেক্ষণ হতো। এখন এটি সরকারীভাবে সংরক্ষণ করা হয়। যে স্থাপনা একদিন সাধারণ জনগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল, যেখানে সাধারণের উপস্থিতি ছিল অননুমোদিত তা এখন সকলের জন্য উন্মুক্ত। কাশ্মীরে বেড়াতে আসা পর্যটকগণ এখন প্রাণ ভরে এখানকার সৌন্দর্যে অবগাহন করতে পারে। এটি এখন পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপনা। প্রতিবছর বসন্তে যখন এখানকার চিনার গাছের পাতাগুলো রঙ বদলায় তখন চারদিকে উদ্ভাসিত হয় সৌন্দর্যের এক অপরূপ দৃশ্য। এ বাগানের সৌন্দর্যেই বিমোহিত হয়ে, অনুপ্রাণিত হয়ে সম্রাট শাহজাহান পরবর্তীতে একই নামে ১৬৪১ সালে দিল্লীতে এবং ১৬৫৩ সালে পাকিস্তানের লাহোরে দুটি বাগিচা সৃষ্টি করেছিলেন।
দিল্লীর শালিমার বাগ
আগেই বলা হয়েছে যে, সম্রাট শাহজাহান কাশ্মীরের শালিমার বাগের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে লাহোরে এবং দিল্লীতে একই নামে দুটি বাগিচা নির্মাণ করেছিলেন। দিল্লীর বাগিচাটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন ১৬৫৩ সালে। এক সময় এ বাগিচার নাম ছিল ‘আইজাবাগ’। এখানেই ৩১ জুলাই, ১৬৫৪ সালে আওরঙ্গজেবের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। লাহোর এবং কাশ্মীরের শালিমার বাগের সঙ্গে এর বিশেষ পার্থক্য এই যে, এখানে একটি স্বতন্ত্র শীশ মহল নির্মাণ করা হয়েছিল।
সম্রাট শাহজাহানকে প্রায়ই রাজকীয় কাজের জন্য রাজধানী থেকে কাশ্মীর, লাহোর অথবা পাঞ্জাবের পথে যেতে হতো, যে কারণে তিনি পথিমধ্যে বিশ্রামের প্রয়োজনে রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এ বাগিচা নির্মাণ করেছিলেন। অন্যান্য মুঘল বাগিচার মতো এটিও মুঘল স্থাপত্যের বিশেষ রীতি অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। এখানেও ছিল জল সরবরাহ এবং নিষ্কাশনের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা। শীশ মহলের অভ্যন্তরে নানা বর্ণের ফুলের কারুকার্যের সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল। এর দেয়াল ছিল সৌকর্যম-িত। কক্ষের সন্নিকটে ছিল ঝরনাধারার বিন্যাস। এত শখ করে এ বাগিচা নির্মাণ করলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সম্রাট শাহজাহান এটি উপভোগ করতে পারেননি। এ স্থাপনা নির্মাণের পরের বছরই তাকে সাম্রাজ্য হারাতে হয়। নিজ পুত্রের হাতে বন্দি হয়ে অবস্থান করতে হয় অবরুদ্ধ আগ্রায়।
এ স্থাপনার সৌন্দর্যের সুবাদে সম্রাট আওরঙ্গজেব এটিকে তার বাগান বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন। নৃত্যগীতের আয়োজন না থাকলেও তিনি এর প্রাকৃতিক সুধা পানের নিমিত্ত প্রায়ই এখানে অবস্থান করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে স্যার ডেভিড অক্টারলনি এবং সরকারী আমলা লর্ড মেটকাফ এ বাগান বাড়িটিকে গ্রীষ্মকালীন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করতেন।
এখন এ স্থাপনার তেমন আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা তাৎপর্য নেই। পুরো বাগিচা এলাকায় গড়ে উঠেছে হাউজিং কমপ্লেক্স। দিল্লী মহানগর বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে এর অস্তিত্বও অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে। অযতেœ অবহেলায় পড়ে আছে শীশ মহলটি। পুরো এলাকায় গড়ে উঠেছে আবাসন, মার্কেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারী স্থাপনা। তারপরও মুঘল স্থাপনার কিছু কিছু অংশ এখনো পাবলিক পার্ক হিসেবে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও এখানকার কিছু কিছু ফলের গাছ এবং বন্য ফুলের সমারোহ মানুষকে আকৃষ্ট করে। পার্শ্বস্থ শালিমার গাও এখনও মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় হতভাগা মুঘলদের কথা।

No comments

Powered by Blogger.