আশায় বুক বেঁধেছেন সিরাজ আলেয়া দেবী সুলতানারা
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব। তুমি বলেছিলে- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে প্রশ্রয় দিও না...'। এটি বহুল জনপ্রিয় 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' যাত্রাপালার একটি সংলাপ।
কিংবদনত্মির নায়ক নবাব সিরাজের পতন হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধে। কিন্তু যাত্রা শিল্পীদের অভিনয় শৈলীতে আজও তিনি সাধারণের কাছে জীবনত্ম হয়ে ওঠেন। জনতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে এখনও তিনি বলে ওঠেন- 'বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা...'। শুধু কি সিরাজ? সূর্য সেন, ুদিরাম, নেতাজী, গান্ধিজী, টিপু সুলতান, দসু্যরানীর মতো ইতিহাসের নায়ক-খলনায়করাও হাজির হন যাত্রার মঞ্চে। ঐতিহাসিক নানা চরিত্র-কাহিনীর পাশাপাশি যাত্রাশিল্পীরা উপস্থাপন করেন সমাজজীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনার নানা প্রতিচ্ছবি। এ জন্য বলা হয়_ 'যাত্রা সমাজ জীবনের দর্পণ'। কিন্তু যাদের কল্যাণে যাত্রা শিল্পের এই গৌরবময় ঐতিহ্য, এখনও যারা গভীর রাত অবধি আন্দোলিত করেন হাজারও দর্শককে; কেমন আছেন মঞ্চের সেই সিরাজ, আলেয়া, নটি বিনোদিনী আর দেবী সুলতানারা?বিশ্বখ্যাত মহুয়া-মলুয়ার কাহিনীবিজড়িত মৈমনসিংহ গীতিকার উৎসভূমি নেত্রকোনা। এ জেলার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে আছে বাউল, ভাটিয়ালী, জারি-সারি, ঘাটু গান, পালাগান, ঢপ ও কিস্সাসহ লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান। এসবের পাশাপাশি নেত্রকোনার যাত্রা শিল্পের সুখ্যাতিও সারা দেশে। বিশ শতকের শুরম্ন থেকে আশির দশক পর্যনত্ম যাত্রাশিল্প চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল এ জেলায়। গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু পেশাদার যাত্রাদল। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল: মোহনগঞ্জের নিউ গণেশ অপেরা, নবযুগ অপেরা, নেত্রকোনা সদরের কৃষ্ণাকলি অপেরা, মহুয়া নাট্য সংস্থা, লীপুর যাত্রা ইউনিট, শ্যামগঞ্জের সবুজ অপেরা, কলমাকান্দার পলাশ অপেরা, রংছতির রিপন যাত্রা ইউনিট, বারহাট্টার রকি অপেরা ও বন্ধন অপেরা। শুধু নেত্রকোনাতেই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় সারা বছর গান করে বেড়িয়েছে দলগুলো। এ ছাড়াও জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ছিল এ্যামেচার (সৌখিন) যাত্রা দল। এ জেলায় এমন কোন গ্রাম নেই, যেখানে বছরে অনত্মত দুই-একটি যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়নি। জেলার ডাকসাইটে যাত্রাভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন- আশ্রব আলী, যাত্রাসম্রাট নয়ন মিয়া, মুখলেছ উদ্দিন, খমির উদ্দিন, হরেন সরকার, রমেশ আদিত্য, শরীফ এ মুখলেছ, পঞ্চানন বিশ্বাস, হরিপদ সরকার, অমূল্য শর্মা, আব্দুর রহিম, মোসলেম উদ্দিন, আব্দুর রব, আফাজ উদ্দিন, আব্দুল হাই । বিবেক চরিত্রের গান ও অভিনয়ের জন্য গৌরাঙ্গ আদিত্যের খ্যাতি এখনও দেশজুড়ে। এছাড়াও অশ্বিনী সরকার, মদন সরকার, গোপাল দত্তের মতো শিল্পীরা বিবেকের অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন ব্যাপক।
স্বাধীনতার আগ পর্যনত্মও যাত্রা গানে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন পুরষ শিল্পীরা। বিনোদ দাস (বিনোদ রানী), পিয়ারী মোহন সাহা (পিয়ারী রানী), সতু ভৌমিক (সতু রানী)সহ বেশ ক'জন যাত্রাশিল্পী তখন নারী চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্বাধীনতার পর যাত্রাশিল্পে নারী শিল্পীদের প্রবেশ ঘটলে শিল্পটি আরও জনপ্রিয় এবং প্রাণবনত্ম হয়ে ওঠে। এ সময় যাত্রাশিল্পের বাণিজ্যিক প্রসারের কারণে নেত্রকোনা শহরের সাতপাই রেলক্রসিং এলাকায় গড়ে ওঠে একটি যাত্রাপলস্নী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রা জগতের মহিলা শিল্পীরা এখানে বসতি গড়ে তোলেন। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্যরা হলেন: কৃষ্ণা চক্রবর্তী, ইলা, রীতা, ফরিদা, সাধনা, শিরিন, বিউটি, গীতা, উষা, শাপলা, পারভীন, গৌরী, সুরভী, রীনা, অঞ্জনা, আনোয়ারা । এছাড়াও যাত্রাশিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু 'সাজঘর'। আগের মতো বাণিজ্যিক প্রসার না থাকলেও কৃষ্ণা ড্রেস হাউজ, দ্বীনা ড্রেস হাউজ, একতা ড্রেস হাউজ, বিউটি ড্রেস হাউজ, শিল্পী সাজঘর, পলাশ পোশাকঘর, লাকি সাজঘরসহ বেশ কয়টি সাজঘর এখনও টিকে আছে। এছাড়া কেন্দুয়া এবং মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরেও কয়েকটি সাজঘর আছে। যারা যাত্রার আয়োজন করেন, তারা এসব সাজঘর থেকে অর্থের বিনিময়ে মহিলা শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী, বাদ্যযন্ত্র, মেকাপম্যান, পোশাক প্রভৃতি ভাড়া করেন।
নেত্রকোনার পেশাদার যাত্রাশিল্পী দ্বীন ইসলাম জানান, রমরমা বাণিজ্যের কারণে যাত্রাশিল্পে এক সময় অপসংস্কৃতির 'আছর' পরে। বিশেষ করে আশি ও নব্বইয়ের দশকে একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যাত্রার সঙ্গে জুয়া, হাউজি ও অশস্নীল নৃত্যসহ নানা অপসংস্কৃতিকে যুক্ত করে। ফলে সুধীসমাজ যাত্রার আসর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আইনী বাধ্যবাধকতা, নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনিক বেড়াজাল ও মৌলবাদীদের রক্তচুর কারণে শিল্পটি মারাত্মক তির সম্মুখীন হয়। জঙ্গীবাদের উত্থানের পর দেশে দীর্ঘদিন যাত্রাগান বন্ধ থাকে। এ কারণে অনেকে পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়।
নেত্রকোনার এক প্রখ্যাত মহিলা যাত্রাশিল্পী কৃষ্ণা চক্রবর্তী। নারী চরিত্র ছাড়াও নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করে তিনি এখন যাত্রামোদীদের মুখে মুখে। এ শিল্পী জানান, বর্তমান সরকার মতায় আসার পর যাত্রাশিল্প কিছুটা আলোর মুখ দেখতে শুরম্ন করেছে। অনত্মত খেয়েপরে বাঁচা যাবে- এমন আশায় আবার বুক বেধেছেন তারা। এর মধ্যেই শিল্পীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাত্রা গানের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন। নেত্রকোনাতেও বেশ কয়েকটি যাত্রা প্রদশর্নী অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যাত্রার সঙ্গে জুয়া, হাউজি ও অশস্নীল নৃত্যের সম্পর্ক নেই। আয়োজকরা ব্যবসায়িক দিক বিবেচনা করে এগুলো সম্পৃক্ত করেন। আর যখনই জুয়া-হাউজি বন্ধের কথা ওঠে, তখন এসবের সঙ্গে যাত্রাগানও বন্ধ করে দেয়া হয়। এর ফলে যাত্রাও একটি অপসংস্কৃতি বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু প্রশাসনের উচিত- যাত্রার নামে সকল অসামাজিক কর্মকা- বন্ধ রেখে যাত্রার বিকাশে এগিয়ে আসা। কারণ, জুয়া-হাউজি বন্ধ হলে কেউ না খেয়ে মরবে না। কিন্তু যাত্রা বন্ধ হলে হাজার হাজার শিল্পী-কলাকুশলীর জীবন ও জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
লোক ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও গবেষক গোলাম এরশাদুর রহমান বলেন, নেত্রকোনায় এমন কোন প্রাচীন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি জীবনে অনত্মত দু-চারবার গুনাইবিবি, একটি পয়সা, সিঁদুর নিওনা মুছে, কোহিনূর, মন্দির থেকে মসজিদ, টিপু সুলতান, সিরাজউদ্দৌলা, দেবী সুলতানা, বাগদত্তা, অশ্রম্ন দিয়ে লেখা, ভক্ত রামপ্রসাদ ও ক্রীতদাস যাত্রাপালা দেখেননি। রাতভর মুগ্ধ হয়ে মানুষ এসব পালা দেখেছেন এবং জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়ে কেঁদেছেনও। এটি গ্রাম-বাংলার মানুষের কাছে একটি শিনীয় মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখত। কিন্তু বাঙালীর সেই চিরকালের নাটক যাত্রা আজ বিলুপ্তির পথে। এর কিছুটা গ্রাস করেছে বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন ও সরকারের উদাসীনতা। আর বাকিটুকু গ্রাস করেছে মৌলবাদ নামের বিষবৃ।
No comments