মধুসূদন দত্ত ॥ কবি ও নাট্যকার- শিপ্রা গোস্বামী
খুলনাতে গিয়েছিলাম অফিসের একটা কাজে ২০১১-এর মাঝামাঝিতে। ফেরার পথে ঠিক করলাম সাগরদাঁড়ি হয়ে ফিরব। আমরা ক’জন একসঙ্গে ছিলামÑব্যারিস্টার আরাফাত, অজন্তা, রীতো, রুমি, জাহাঙ্গীর, অমিত এবং আমি।
আরও দু’জন ছিল। এই মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না। আমার ভগ্নিপ্রতিম সহকর্মী অজন্তার আগ্রহেই মূলত যাওয়া। ও আগে কখনও সাগরদাঁড়ি যায়নি। বাংলার ছাত্রী হিসেবে তাঁর একটা বিশেষ পক্ষপাত ছিল ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে। আমি যদিও ১০/১২ বছর আগে একবার গিয়েছিলাম কিন্তু ঐ যাওয়া পর্যন্তই সার। সেদিন ওখানটায় এত বনভোজনের দল ছিল যে দাঁড়াবার জায়গা ছিল না। তাই আমারও পুনর্বার যাওয়ার বেশ আগ্রহ ছিল। আমরা যখন সাগরদাঁড়ি পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর বারোটা ছুঁই ছুঁই।আমরা প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকেই চলে গেলাম সমাধিস্থলে যেখানে কবি মধুসূদনের আবক্ষমূর্তি। প্রতিবছর মধুমেলার আগে আগে ভাস্কর্যটি রঙ করানো হয়। যেহেতু তখনও মেলার ঢের বাকি তাই ওটির রঙ বেশ কিছুটা ম্লান। তবু তার গায়ে থাকা কবিতার অংশটুকু পড়তে কোন অসুবিধা হয়নি——-
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!
তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে
যেমতি বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
আমাদের দলের সবাই মাইকেলের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলে তাদের সখ মেটাল। ওরা যখন ফটোসেশনে ব্যস্ত তখন আমি আর অজন্তা একটা গাছতলায় নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পিকনিকের মৌসুম ছাড়া ওখানটা মোটামুটি ফাঁকা থাকে তা বোঝা গেল। আমাদের সহকর্মীরা যখন হইহট্টগোল করতে করতে অন্যদিকে চলে গেল জায়গাটা তখন একেবারেই জনশূন্য হয়ে পড়ল। এবার আমরা দু’জন ঠিক করলাম ছবি তুলব। আমরা দু’জন দু’জনের ছবি তুলে দিলাম। পরে অবশ্য জাহাঙ্গীরকে ডেকে আমার আর অজন্তার একটা দ্বৈত ছবিও তোলা হয়েছিল। একক ছবি তুলবার সময় ভাস্কর্যটির খুব কাছে গিয়ে ছুঁতেই আমার মনে হয়েছিল যেন কোন রক্ত-মাংসের মানুষকে স্পর্শ করলাম যার উষ্ণ শরীরে এখনও প্রাণের স্পন্দন আছে। মুহূর্তেই আমার একধরনের অজানা অনুভূতি হলো। ছবি তোলা শেষে অজন্তাকে আমার অনুভূতির কথা বলতেই সে জানাল তারও নাকি একই রকম লেগেছে। আজও সেই ক্ষণটির কথা মনে পড়লে শিহরিত হই।
এরপর আমরা এক এক করে সব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাড়িটি অনেক পুরনো হয়ে গেলেও যৌবনে তার আড়ম্বর টের পাওয়া যায় সহজেই। দেখলাম ভেতরবাড়িতে বাঁধানো উঠোন এবং একপাশে দত্তবাড়ির আঁতুরঘর যেখানে ১৮২৪ সালে ২৫ জানুয়ারি জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত আর জাহ্নবী দেবীর কোল আলো করে এসেছিল এক শিশুপুত্র। অনেক ধুমধামের সঙ্গে ঘৃতপ্রদীপ জ্বালিয়ে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ‘মধুসূদন’। দত্তদম্পতি কি সেদিন জানতেন যে তাঁদের অতি আদরের ধন মধু বড় হয়ে একদিন তাঁর নামের আগে ‘মাইকেল’ জুড়ে দেবেন ? তাঁরা কি এও জানতেন যে সোনার চামচ মুখে জন্ম নেয়া তাঁদের নয়নের মণি একদিন দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে জীবনের খেলা সাঙ্গ করবেন?
মধুসূদনের পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতা সদর দেওয়ানি আদালতের একজন নামকরা আইনজীবী। মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর মা জাহ্নবী দেবী কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাঁকে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়।
তেরো বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি তদনীন্তন হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। মধুসূদন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই অচিরেই কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন ডি.এল. রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কবিতার প্রতি ভালবাসার সৃষ্টি করেছিলেন। কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভুদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ সেই সময়কার বিখ্যাত ব্যক্তি। আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলেতে যাওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষা তাঁর মনে প্রবলভাবে জেগে ওঠে। কপোতাক্ষ নদের পারে আলো-হাওয়ায় বেড়েওঠা পুরোদস্তুর বাঙালী এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সন্তান অসীম প্রতিভার অধিকারী মধুসূদন কলেজে পড়ার সময় থেকেই পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রতি প্রচ- আকর্ষণ অনুভব করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইংরেজী ভাষায় প্রভূত দক্ষতা অর্জন করেন। এই সময় তিনি নারী শিক্ষার ওপর একটি ইংরেজী প্রবন্ধ লিখে হিন্দু কলেজ থেকে স্বর্ণপদকও অর্জন করেন।
ঐ সময় স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষার প্রতি কিছুটা তাচ্ছিল্য আসে মধুসূদনের। তখন তাঁর কবিত্ব শক্তিরও প্রকাশ ঘটে। কবিতা লিখতে শুরু করেন ইংরেজীতে। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয় ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’, ‘লিটারারি গ্রামার’, ‘ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট’, ‘লিটারারি ব্লুসম’ ইত্যাদি পত্রিকায়। মধুসূদনের মনের মধ্যে চিন্তাচেতনায় তখন সব বিদেশী কবি-মহাকবি বাসা বেঁধেছে। তাঁরাই তখন তাঁর আদর্শ।
মধুসূদনের চোখে তখন মহাকবি হবার স্বপ্ন। বিলেতে যাবার জন্য মরিয়া। বিলেতে যাবার জন্য সুবিধা হবে এই ভেবে তিনি ১৮৪৩ সালে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। নামের শেষে যোগ করেন ‘মাইকেল’। যদিও শেষ অবধি তাঁর আর বিলেত যাওয়া হয়নি। উপরন্তু একই বছর হিন্দু কলেজ থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ফলে পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এক সময় তাঁর পিতা তাঁকে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেন।
১৮৫৬ সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়। এখানে থাকতেই তিনি ক্রমে ক্রমে বাংলাভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ অনুভব করেন। আত্মনিয়োগ করেন বাংলা ভাষার সেবায়। এই সময় তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন রামনারায়ণ তর্করতেœর ‘রতœাবলী’। পরে রচনা করেন নাটক শর্মিষ্ঠা (১৮৫৮), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৫৯), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৫৯), পদ্মাবতী (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) ইত্যাদি। ১৮৬১ সালেই তিনি রচনা করেন তাঁর অমর সৃষ্টি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’।
আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় মনে হয় তিনি যদি তাঁর জীবনে একটিমাত্র কাব্য রচনা করতেন তবু তিনি আমাদের মাঝে অমর হয়েই থাকতেন। সেই কাব্যটির নাম ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। যদিও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বালক বয়সে এই কাব্যটির বিরূপ সমালোচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই পরিণত বয়সে মেঘনাদবদ কাব্যকে ‘বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কাব্য’ বলে স্বীকৃতি দেন। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বেঙ্গলি লিটারেচার’ নামের প্রবন্ধে এই কাব্যকে ‘গ্রেটেস্ট ওয়ার্ক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২ খ-ে। ১৮৬১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রথম খ-ে ছিল প্রথম থেকে পঞ্চম পর্ব। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৩১। মে মাসে প্রকাশিত দ্বিতীয় খ-ে ছিল ষষ্ঠ থেকে নবম পর্ব। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ১০৪। এই সংস্করণের ছাপার খরচ দিয়েছিলেন দিগম্বর মিত্র। কবি তাঁকেই কাব্যখানা উৎসর্গ করেন।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংস্করণ। সম্পাদক হিসেবে নাম ছাপা হয় কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এভাবে ৫টি সংস্করণ প্রকাশিত হয় পাঠকের ব্যাপক আগ্রহের ফলে। ১৮৬৯ সালে ষষ্ঠ সংস্করণ হিসেবে এটি ১ খ-ে প্রকাশিত হয়। ১৮৭৩ সালে মধুসূদনের প্রয়াণের আগে প্রকাশিত এই অখ- সংস্করণই সকল মহলে গ্রাহ্য হয়ে আছে।
রামায়ণের কাহিনীকে নবরূপে সাজানো হয়েছে মেঘনাদবধ কাব্যে। আবার মেঘনাদবধ কাব্যেরও নানান রূপান্তর ঘটেছে বিভিন্ন লেখকের কলমে। তবে আমরা হয়ত অনেকেই জানি না যে, প্রকাশের ৬ বছর পরে অর্থাৎ কবির জীবদ্দশাতেই এর নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। কলকাতার ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে প্রকাশিত ৬৮ পৃষ্ঠার এই নাটকটি মঞ্চায়নের খবর পাওয়া যায়নি। তবে কবির মৃত্যুর পরে ১৮৭৭ সালের ২৪ মার্চ মেঘনাদবধ কাব্যের অভিনয় হয় বেঙ্গল থিয়েটারে। এর নাট্যকারের নাম জানা যায়নি। ১৮৮১ সালের গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাট্যরূপায়ণে মেঘনাদবধ কাব্য মঞ্চস্থ হয় ন্যাশনাল থিয়েটারে। গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং নটী বিনোদিনী এই নাটকে অভিনয় করেন।
১৮৬৬ সালে মধুসূদন ব্যারিস্টারি পাস করেন। এ সময় তিনি অমিতব্যয়িতার কারণে নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়েন। তাঁর এই দুঃসময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন আরেক মহাপ্রাণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
১৮৬৭ সালে তিনি দেশে ফিরে ব্যারিস্টারি শুরু করলেও সুবিধা করতে পারেননি। তাই বাংলা ভাষার এই ক্ষণজন্মা মহাকবির শেষ জীবন কেটেছে একপ্রকার মানবেতরভাবে। ঋণের বোঝায় তাঁর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ভগ্নস্বাস্থ্য, ভগ্ন মনোরথ নিয়ে মধুসূদনের অকাল প্রয়াণ হয় ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে।
No comments