পারিবারিক সহিংসতা ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় by মোহিত কামাল

শিরোনামের দুটি শব্দ ‘পরিবার’ ও সহিংসতা’ বেশ পরিচিত। এর আড়ালে আছে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়। নির্যাতন বা নিপীড়নের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দুর্ঘটনাজনিত নয় এমন শারীরিক জখম (non-accidental injury),
যৌন নিপীড়ন, আবেগীয় নির্যাতন, অবহেলা। প্রাসঙ্গিকভাবে যুক্ত রয়েছে অর্থনৈতিক নির্যাতনও। পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে ২০০৯ সালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) করা এক গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯৩ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার। ৯১ শতাংশ অর্থনৈতিক এবং ৮৪ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার। ১৩ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চান না। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন চাকরিজীবী নারীরাও মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন। নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে তখন তা জানাজানি হয়। ‘আমরাই পারি’ সামাজিক প্রচারাভিযানের পক্ষ থেকে দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৯ জন। স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৯০ জন। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন ২২ জন এবং খুন হয়েছেন ৪৯। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘আমরাই পারি’ বা বিভিন্ন সংগঠন কাজ করার ফলে দেশে নারী নির্যাতন কমে গেছে তা বলার মতো পরিস্থিতি আসেনি। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির ফলে নারীরা মুখ খুলছেন। ২০ বা ২৫ বছর ধরে নির্যাতনের শিকার নারীরাও আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য এখন আসছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (প্রথম আলো ২৫.১১.১২)।
পরিবার
সমন্বিত সম্বন্ধের মধ্যে একযোগে কর্মরত সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা বা পদ্ধতিই (ংুংঃবস) হলো পরিবার। অন্যভাবে বলা যায় সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পরিবার। সুশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশের আলোকিত স্বরূপ মমতার বন্ধন, নৈতিকতার পরিচর্যা। শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের বীজ লুকিয়ে থাকে পরিবারে। যখন অন্তর্গত প্রক্রিয়াগুলো ঠিক থাকে তখনই সিস্টেম বা সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি সুচারুরূপে পরিচালিত হয়। নিউক্লিয়ার পরিবারের অন্তর্গত প্রক্রিয়ার মধ্যে ট্রায়েঙ্গুলার (ঃৎরধহমঁষধৎ ংুংঃবস) পদ্ধতি বিন্যস্ত থাকে। প্রথমত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, দ্বিতীয়ত ভাইবোনদের সম্পর্ক, তৃতীয়ত বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক। একান্নবর্তী পরিবারে যোগ হয় বিবাহিত নারীর শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ-ননাস ও অন্যান্য সদস্য। গৃহকর্মীরা স্থায়ী না হলেও সমাজ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এখন পরিবারের সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
তবে পারিবারিক সহিংসতার বীজ লুকিয়ে থাকে প্রধানত স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মধ্যে। ‘সম্পর্ক’ খুব ছোট একটা শব্দ, যা রক্ষা করা এবং ধরে রাখার দায়বদ্ধতা পরিবারের সকলের। কিন্তু ভুল প্রত্যক্ষণ এবং সচেতনার অভাবে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে দেখা যায় আচরণ ও আবেগীয় সহিংসতার কোন্দল। পরিবারে যে কোন একজন যদি সহিংস আচরণ করে এবং অন্যজন যদি সেটা দ্বারা প্রভাবিত হয়, তবে পরিবারের সবক্ষেত্রে এই সহিংসতার সামগ্রিক নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। অন্তরঙ্গ সম্পর্কেও নানাভাবে প্রকাশ পায় নির্যাতন, যেমন শারীরিক, যৌন, আবেগীয়, অর্থনৈতিক, মানসিক কষ্ট যা স্বাভাবিক জীবনকে প্রভাবিত করে, মানসিক ক্ষতি করে। এই সংকটের প্রধান শিকড় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রোপিত হলেও শ্বশুরবাড়িতে আসা নতুন বউটি প্রথমে আক্রান্ত হয় শাশুড়ি কিংবা ননদ-ননাস কর্তৃক। কোন কোন ক্ষেত্রে দেবর-ভাসুর কিংবা শ্বশুরও সহিংস ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বটেই, শহরেও এখনো যৌতুকের নামে বলি হচ্ছে অসংখ্য নববধূ।
যারা পরিবারের ভেতর সহিংস আচরণ করে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তারা। প্রভুত্বমূলক আচরণ করে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য প্রমাণ করতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আচরণগত এ সহিংসতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসের অভাব, হিংসাত্বক মনোভাব, রাগ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা, এবং হীনম্মন্যতাবোধ। নারী-পুরুষের বৈষম্যমূলক অবস্থান এবং লালিত কিছু ভুল দর্শন যেমন পুরুষের অধিকার রয়েছে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করবার এবং নারী-পুরুষ কখনই সমান হতে পারে না এই প্রেক্ষাপটগুলোও সহিংসতার জন্ম দেয়। এখানে প্রধান শত্রু পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্রের সর্বত্র রয়েছে নারীকে ছোট কিংবা হেয় করার নির্লজ্জ প্রবণতা।
গবেষণায় দেখা গেছে, দাম্পত্যসম্পর্ক জটিল হলে বাবা-মার সঙ্গে তৈরি হয় সন্তানের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, যোগাযোগের অদক্ষতা, পারস্পরিক ব্যক্তিত্বকে বুঝতে না পারার কারণে দেখা যায় সহিংস আচরণÑ যেমন রাগারাগি, গালাগালি, মারপিট করা, অনুভূতি প্রকাশ না করা, আবেগের বহিঃপ্রকাশ না ঘটানো ইত্যাদি অনেক সময় অনুকরণ করে শেখে সন্তানও।
দুটো ভিন্ন পরিবারের মিথস্ক্রিয়ায় বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে একটি নতুন পরিবারের সূচনা হয়। ব্যক্তি তার নিজস্ব পারিবারিক প্রেক্ষাপট থেকেও কিছু আচরণ শিখে আসে। সন্তান তার বাবা-মার আচরণে কিংবা কথাবার্তায় যা দেখবে, তাই-ই শিখবে। ছেলেশিশু যদি দেখে বাবা তার মাকে ধমক দিয়ে কথা বলে, তবে শিশুটিও যেদিন স্বামী হিসেবে আত্মঃপ্রকাশ করবে সেদিন থেকেই স্ত্রীকে অশ্রদ্ধা করতে থাকবে। আবার মেয়েশিশুটি যদি দেখে তার মা প্রতিনিয়ত বাবা দ্বারা নির্যাতিত, মেয়েটিও বড় হয়ে আত্মমর্যাদাশীল হবে না, এবং স্বামী দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হওয়ার মনোভাব পোষণ করবে। কিন্তু আত্মরক্ষার কৌশল শেখা হবে না তার। বাবা-মার নির্যাতনের সবচেয়ে বড় শিকার হয় শিশু। প্রায়শ শিশুর ক্ষেত্রে আবেগীয় নির্যাতন ঘটে থাকে যা পরবর্তীকালে আর কোনো কিছুর বিনিময়ে পূরণ করা যায় না, বরং বর্তমানের ধকল ও ভবিষ্যত মিলেমিশে শিশুটির ব্যক্তিত্ব বিপর্যস্ত হয়ে গড়ে ওঠে। এই ধরনের শিশুরা পরবর্তী জীবনে নির্যাতনকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, সন্দেহ নেই।
মানসিক রোগ, ব্যক্তিত্বের সমস্যা ও পারিবারিক সহিংসতা
ভয়াবহ সহিংসতার বড় কারণ প্যাথলজিক্যাল জেলাসি। এই রোগে প্রিয়জনের সম্পর্কের অবিশ্বস্ততা নিয়ে অনবরত সন্দেহমূলক চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে রোগীর মাথায়। এর আরেক নাম ওথেলো সিনড্রম। এটি বড় ধরনের মানসিক রোগ ডিল্যুশনাল ডিসঅর্ডারের একটি ধরন। এমন রোগে আক্রান্ত হলে দাম্পত্য সম্পর্ক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। বিষময় হয়ে ওঠে পারিবারিক আবহ। পুরুষেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি ভুগে থাকে। মহিলা ও পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার আনুপাতিক হার (১ : ৩.৭৬)। এ রোগের পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ থাকে না, কোনো গ্রাউন্ডও নেই। যদি এমন আভাস পাওয়া যায় যে পার্টনার সত্যি সত্যি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে, তাহলে এ অবস্থাকে আর প্যাথলজিক্যাল জেলাসি বলা যাবে না। এক্ষেত্রে, মজার ব্যাপার হলো রোগী জানেই না যে, কে সেই কথিত প্রেমিক বা প্রেমিকা। দ্ব্যর্থহীনভাবে সেই পুরুষ বা নারীটিকে খুঁজে বের করার তাড়নাও তার ভেতর কাজ করে না। তবে রোগী সবসময় পার্টনারের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করতে পারে, এমন কি বেতনভুক্ত কাউকে লাগিয়েও রাখতে পারে গতিবিধি জানার জন্য। রোগী মূলত অবৈধ সম্পর্কের প্রমাণ খুঁজে বেড়ায় অনবরত। সঙ্গী/সঙ্গিনীর ডায়েরি ঘেঁটে দেখে গোপনে, চিঠিপত্র এলে কৌশলে পড়ে নেয়। বিছানাপত্র কিংবা অন্তর্বাসও অনেক সময সূক্ষ্মভাবে অনুসন্ধান করে দেখে, কোনো রকম যৌন সম্পর্কের আলামত বের করাই এ ধরনের আচরণের মূল উদ্দেশ্য। এ ধরনের রোগীরা অনবরত পার্টনারকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জীবন বিষিয়ে তোলে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, মারাত্মক পরিস্থিতি এভাবেই হানা দেয়, দাম্পত্য সম্পর্ক বিপর্যস্ত হয়ে যায়। মিথ্যা স্বীকারোক্তিতে অনেক সময় পার্টনারকে বাধ্য করা হয়, উত্তেজিত করে তোলা হয়। নিরন্তর প্রশ্নবানে বিদ্ধ হতে হতে পার্টনার অনেক সময় মিথ্যা স্বীকারোক্তি করে, নিষ্কৃতি পেতে চায়। এমনটি ঘটলে রোগীর জেলাসি কখনো কমবে না, বরং শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে আরও বেশি জটিলতর হতে থাকে। সন্দেহের দাবানল আরও বশি দাপিয়ে ওঠে রোগীর জীবনে। কেবলমাত্র এ ধরনের একটি ভ্রান্ত বিশ্বাসের শেকড় প্রোথিত হলে, অন্য কোনো মানসিক রোগের কারণে অমূলক বিশ্বাসটি না ঘটে থাকলে, ডিল্যুশনাল ডিসঅর্ডারই ডায়াগনোসিস করা হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্যাথলজিক্যাল জেলাসি কয়েকটি প্রাথমিক রোগের সঙ্গেও মিশে থাকতে পারে। এ ধরনের রোগীদের ১৭-৪৪% এর সঙ্গে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া, ৩-১৬% এর সঙ্গে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, ৩৮-৫৭% এর সঙ্গে নিউরোসিস এবং পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, ৫-৭% এর সঙ্গে এলকোহলিজম এবং ৬-২০% ক্ষেত্রে অর্গানিক (দেহগত) ডিসঅর্ডার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ব্যক্তিত্বের সন্দেহ প্রবণতা যেমন প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার; কিংবা ব্যক্তিত্বের নির্মমতা, আকস্মিক তাড়নায় দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভয়াবহতা ঘটানো যেমন সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব বা বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার ইত্যাদিও সহিংসতার জন্য বিরাট অংশে দায়ী।
মাদকাসক্তি ও পারিবারিক সহিংসতা
সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে গেছে মাদকের ভয়াবহতা। সন্তান মাদকাসক্ত হলে বাবা-মা, ভাইবোনসহ পারিবারিক অন্য সদস্যরাও সহিংসতার শিকার হয়। সন্তান মা-কিংবা বাবার গলায় ছুরি বসিয়েছে। মা-বোন মিলে হত্যা করিয়েছে সন্তানকে এমন উদাহরণও রয়েছে। এই ভয়াবহতার প্রধান কারণ মাদক। মাদক গ্রহণের কারণে স্বামীরা সন্দেহপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে স্ত্রীর প্রতি। সন্দেহের কারণে ও রাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ব্যাপক মারধরসহ নানাভাবে স্ত্রীকে নির্যাতন করছে। ডিভোর্স ও পারিবারিক সহিংসতার অন্যতম প্রধান একটি কারণ মাদক।
গৃহকর্মী নির্যাতন
ছোটখাটো ভুলভ্রান্তির কারণে গৃহকর্মীরা প্রায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গরম ছ্যাকা দেওয়া থেকে শুরু করে সহিংস শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এই নির্যাতনের পেছনে গৃহকর্ত্রীর ব্যক্তিত্বের সমস্যা, সন্দেহপ্রবণতা বিরাট অংশে দায়ী। তবে ক্ষেত্রবিশেষে গৃহকর্তার সঙ্গে গৃহকর্মীর অনৈতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে। সেটাও সহিংসতার বীজ রোপণ করে দেয় গৃহকর্ত্রীর মনে। বকা খেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার আশায় কিংবা সংসারে সুখের আবহ দেখে সইতে না পেরে ঈর্ষা-হিংসার আগুনে পুড়ে কখনও কখনও গৃহকর্মীরা বেগম সাহেবার মনে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে সাজা দেওয়ার চেষ্টা করেÑ গৃহকর্তার ছোটখাটো আচরণকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করে বা মিথ্যা বলে সংসারে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঘরে ঘরে তখন বাড়তে থাকে সহিংসতা।
কর্মজীবী নারী ও গৃহবধূ
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে কর্মজীবী মহিলা সহিংসতার শিকার হচ্ছে বেশি। প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সময়ের অফিস ওয়ার্ক শেষ করে পারিবারিক সব ধরনের দায়দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। স্বামী এবং সন্তানসহ আরও আনুষঙ্গিক দায়িত্ব মোকাবেলায় প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছে তারা। অনেক সময় স্বামীকে জীবনযাপনে যেভাবে প্রত্যাশা করে, বিভিন্ন প্রথা ও কৃষ্টির প্রতিকূলতার কারণে পায় না সেরকমভাবে। নারী মনস্তত্ত্বে এই জায়গাটা অনেক স্বামীর কাছেই অনুদঘাটিত থেকে যায়। মহিলারাও দৃঢ়তার সঙ্গে (ধংংবৎঃরাবষু) নিজেদের প্রকাশ করতে পারে না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন পুরুষ তার গতানুগতিক ব্যবহারের ধূম্রজালে আটকে থাকে। সে কখনো এই অজ্ঞাত মনোভাব উদঘাটন করতে চায় না বা শেখে না যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের আচরণে, আবেগে এবং যৌনজীবনসহ পারিবারিক নানা ক্ষেত্রে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, গ্রামীণ প্রেক্ষাপট এমনকি শহুরে জীবনেও গৃহবধূরা ক্ষেত্রবিশেষে কর্মজীবী নারীদের চেয়েও বেশি নিপীড়ন ভোগ করে থাকে। সারা দিন স্কুলে বা কোচিংয়ে বাচ্চা আনা-নেওয়া, বাজার করা ও সংসার সামলানোর বিরাট দায়িত্ব পালন করে চাপে দিশেহারা থাকে। এভাবে সহনশীলতার ঘাটতি তৈরি হয়; রাগারাগি, চেঁচামেচি করে পারিবারিক পরিবেশে বিঘœ ঘটায়।
পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক
পারিবারিক কাঠামোর একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক। পিতা-মাতার অতিরিক্ত প্রত্যাশা, অতিরিক্ত নিয়ম-কানুন কিংবা খোঁজখবর না রাখার প্রবণতা এবং দ্বন্দ্বমূলক নির্দেশনা সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আচরণ ও আবেগীয় সমস্যা তৈরি করে। কর্তৃত্বপরায়ণ বাবার আচরণ যখন ছোটবেলা থেকে ছেলেসন্তান দেখে শেখে এবং কৈশোরে যখন তা অনুকরণ করে বা করা শুরু করে তখন মায়ের প্রতি অভিযোগ তুলে বাবা বলে, ‘তুমি সন্তান মানুষ করতে পারোনি, তোমার আদরে আজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে সে’। এই ধরনের অভিজ্ঞতাগুলো ঘরে ঘরে অজানা নয়। যা অজানা, সেটা জানানোই সচেতনমূলক কাজ। পরিবারের একজন সদস্যের সহিংস আচরণ বা মনোভাব কেবলমাত্র একজনের ওপর আরোপিত হলেও তার প্রভাব নির্দিষ্ট থাকে না। সামগ্রিকভাবে তা পরিবারে সকল সদস্য ও শিশু-সন্তানের ওপর বিস্তার লাভ করে। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৫০ থেকে ৭০% পুরুষ যারা স্ত্রীকে নির্যাতন করতেন, একই সঙ্গে তারা তাদের সন্তানকেও নির্যাতন করেছেন।
পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, মৌলবাদ ও পুঁজিবাদ
পিতৃতন্ত্র অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব রেখেছে পুরুষের হাতে। অর্থের ওপর নির্ভর করে সম্মান ও স্বাধীনতা। নারীর অর্থনৈতিক পরনির্ভরতার কারণে আশ্রিত হয়ে থাকতে হয় পুরুষের ওপর। অনেক পুরুষ বিয়ের পর স্ত্রীকে তাই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা নারী স্বাধীনতার নামে গোপনে পণ্য করে তোলে নারীকে, পণ্যরূপ প্রকৃত অর্থে নারীকে বিকশিত করতে দেয় না, ভোগবাদী সত্তার উন্মেষ ঘটায়। মৌলবাদীরা নারীকে উপার্জনক্ষম ও আত্মনির্ভরশীল হতে বাধা তৈরি করে। পিতৃতন্ত্র ও পরিবার দাঁড়িয়ে আছে শোষণের ওপর একশ্রেণী শোষণ করছে আরেক শ্রেণীকে। একটি নারীর যখন বিয়ে হয় তখন শাশুড়ির যন্ত্রণা ছাড়াও দেবর, ননদ, স্বামী সব মিলিয়ে চলে তার ওপর আক্রমণ। পারিবারিক রাজনৈতিক জালে জড়িয়ে তছনছ হয়ে যায় তার সাজানো সংসার। সাধারণত এক নারীর সুখ আরেক নারী সইতে পারে না। আর মেয়েরাও না বুঝে বিয়ের পর স্বামীকে দেবতা মনে করে। অবশ্য এর কারণ আছে। অশিক্ষিত দাদি-নানিদের যে আদর্শ ও নীতি তারা শিখে এসেছে তা রক্তমাংসের ভেতর এমনভাবে ঢুকে থাকে, বের হওয়ার কোনো উপায় অনেক সময়ই খুঁজে পায় না। ভ্রান্তিগুলোই নারীর কাছে সত্যি মনে হয়। একজন নারী সবদিক থেকে অসহায়। বিয়ের পর বাবা-মা, ভাইবোনেরাও পর হয়ে যায়। অভিভাবকরা বলে, ‘স্বামী ছাড়া তোমার কোনো গতি নেই, যেভাবে পারো স্বামীর বাড়ির সবাইকে সন্তুষ্ট রেখেই চলো। এটাই তোমার কর্তব্য।’ এভাবেই নারীকে এখনও অবদমিত করে রাখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নারীর শত্রু শুধু পুরুষই নয়, নারীরা নিজেরাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী (অপরাজিতা পাতা, জনকণ্ঠ ১৯.১০.১২)।
শাশুড়ি-ননদ ও নতুন বউ
নতুন বাড়িতে নতুন বউ স্বামীর ভালোবাসা পুরোপুরি দখল করে নেয়। শাশুড়ি নিজের প্রতি ছেলের ভালোবাসার ঘাটতি দেখেন, ভাইটি এখন আর তার বোনের যেন খোঁজখবর নেয় না। ফলে তারা অতি গোপনে ঈর্ষার অনলে পুড়তে থাকে। গোপনে ঘরের নতুন অতিথির শত্রু হয়ে যেতে থাকে। খুব সূক্ষèভাবে পরিবর্তনটুকু ঘটতে থাকে। এমনটি ঘটে পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নের অভাব কিংবা বিকৃত মূল্যায়নের কারণে। ফলে নতুন বউয়ের খুঁত ধরা শুরু হয়ে যায়। খুঁত ধরা শুরু হলে বউয়ের মনে শাশুড়ি কিংবা ননদিনীর জন্য শ্রদ্ধার আসন গড়ে উঠবে না, ব্যবধান বাড়তে থাকবে। পারিবারিক আবহ জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। অথচ সন্তান কিংবা ভাইটি সুখে আছে, বউকে ভালোবাসে, বউয়ের ভালোবাসা পাচ্ছেÑ শাশুড়ি কিংবা ননদের এই মূল্যায়ন তাদের মনের আবহটি সুন্দর করে দিতে পারে। ফলে পুরো পরিবেশ পাল্টে যেতে পারে। অন্যথায় নতুন বউ প্রথমে মানসিক যাতনার শিকার হবে, মানসিকভাবে নির্যাতিত হতে থাকবে। এই নির্যাতন তার আবেগেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেও তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবে।
এই খারাপ আচরণের খবর পৌঁছে যাবে নিজ সন্তান কিংবা আপন ভাইটির কানে। ভাইয়ের মেজাজ যাবে বিগড়ে। সে বউয়ের প্রতি উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে, খারাপ আচরণ করতে পারে। নতুন জীবনের যাত্রাতে এ ধরনের খারাপ আচরণ উভয়ের মৌলিক বিবাহবন্ধনের গিঁটটি ঢিলে করে দিতে পারে। সুখ তখন পালাতে থাকে। নতুন বউটিও নির্যাতিত হতে থাকে। চোখ বুজে হয়তো সয়ে যায় সব কিংবা বিদ্রোহী হয়। ধ্বংসের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যেতে পারে। এভাবে দেখা যায় নারী দ্বারাও নির্যাতিত হতে পারে নারী। ইতোমধ্যে আলোচিত আমাদের দেশের পরিসংখ্যান ছাড়াও পাশের দেশ ভারতের এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, সেখানে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের হার খুব বেশি, নির্যাতনের সীমা এত ব্যাপক যে বউটিকে পুড়িয়ে হত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটে। এমনি ঘটনা বাংলাদেশেও আজকাল প্রায়ই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়।
বাল্যবিবাহ ও শোষণ
বাল্যবিবাহের কারণেও শিশু কিংবা কিশোরীটি মনস্তাত্ত্বিক এবং দৈহিক নির্যাতনের শিকার হয়। পরিপূর্ণ বিকাশের পূর্বেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে তার জীবনবোধ। ফলে শ্বশুরবাড়িতে এসে অদক্ষতা ও অপরিপক্বতার কারণে শিকার হয় যৌন সহিংসতার, নির্মম শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের। পরবর্তী কালে এরা ডিপ্রেশন, যৌন সমস্যা, এ্যাডজাস্টমেন্টের সমস্যা, পোস্টট্রমাট্রিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারসহ নানা ধরনের সমস্যায় ভুগতে থাকে।
পরনারীতে আসক্তি ও স্ত্রী নির্যাতন
পরকীয়া শীর্ষক রসালো বর্ণনা এবং সংবাদ আমরা ইদানীং খবরের কাগজে পেয়ে থাকি। স্বামীর পরকীয়াতে স্ত্রীর বাধা, ফলে স্ত্রী নির্যাতন কিংবা খুন, এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
একজন মনোচিকিৎসক হিসেবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। যে হারে পরকীয়া ঘটছে সমাজে, তার সঠিক হিসাব প্রকাশ পায় না বলেই মনে হয়। বাইরে সুখী স্ত্রীর মুখোশ পরে নীরবে নিভৃতে লালন করে চলেছে কষ্টের আগুন, এমন অনেক মহিলা ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে মনোচিকিৎসা গ্রহণের জন্য চেম্বারে আসছে। লক্ষ্য করেছি, এদের মাঝে আত্মহননের ইচ্ছাও প্রবলভাবে সক্রিয়।
অন্য মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্করত অবস্থায় নিজ স্বামীকে দেখে অনেক গৃহবধূর মানসিক বিপর্যয় ঘটে। অবিশ্বাস্য দৃশ্যটি তার মূল জীবনের বিশ্বাস এবং ভিত্তিমূল গুঁড়িয়ে দেয়। ফলে বিষণœতা রোগে আক্রান্ত হয় সে কিংবা আত্মহত্যা করে বসে।
অফিসে প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত স্বামীটি হয়তো সহকর্মী কোনো তরুণীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে পারে। ঘরের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে ডেটিং করে বেড়ায়। ঘরে হয়তো নিজ বধূ অপেক্ষার প্রহর পার করে, টেনশনে ভোগে। কানাঘুষা সে শোনে, অন্য নারীর প্রতি স্বামীর আসক্তি টের পেয়ে যায়। এই টের পাওয়ার উপলব্ধিও ভয়াবহ। ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে নিঃশেষ করে দেয় একটি রমণীর পুরো জীবন। স্ত্রীর পরকীয়ার কারণেও অনেক স্বামী দিনের পর দিন ভোগ করে মানসিক দহন ।
পারিবারিক সহিংসতা থেকে মুক্তির উপায়
সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় একটি পরিবার একটি রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র সংস্করণ। হিংসাত্মক ব্যবহার এবং নির্যাতনমূলক মনোভাব, চিন্তা, আবেগ একটি পরিবারের আবহ ও পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখতে পারে না। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উচিত তাদের সমস্যার জায়গা চিহ্নিত করা, এবং আন্তরিক ও প্রায়োগিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেই সমস্যার সমাধান খোঁজা। কর্তৃত্বমূলকভাবে একজন আরেকজনের আচরণ নিয়ন্ত্রণ না করে, পারস্পরিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতামূলক কার্যকরী ভূমিকা পালন করা উচিত। প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। পারস্পরিক ব্যক্তিত্বকে বোঝার চেষ্টা করা এবং শ্রদ্ধাশীল থাকার চেষ্টা করা জরুরী। সন্তান, বাবা-মার ব্যক্তিত্বের সংমিশ্রণে নতুন এবং একক, স্বকীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সুতরাং বাবা-মা তাদের নিজস্ব চাওয়া, মূল্যবোধ তার ওপর না চাপিয়ে তার স্বকীয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশে সাহায্য করলে, সন্তানের বেড়ে ওঠা হয় স্বাস্থ্যকর ও বুদ্ধিদীপ্ত। পারিবারিক মূল্যবোধ আপনাআপনি ধারণ করে নিতে পারে সন্তান।
পরিবারে প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগের উন্নতি করে ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সমাধান করে অনেক অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব। সেই সঙ্গে মতামত প্রকাশের দক্ষতা অর্জন ও অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার মননশীলতা অর্জন করা জরুরি। ব্যক্তির রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল শিখতে হবে। রাগ একটি সহজাত নেতিবাচক আবেগ কিন্তু তা প্রকাশ করার এবং নিয়ন্ত্রণ না করার অদক্ষতার জন্য আগ্রাসনে পরিণত হয়, সেই বিষয়ে কৌশলগত প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
বাংলাদেশের ১০ লাখের বেশি মানুষ পারিবারিক নির্যাতন করবেন না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে অঙ্গীকার করেছেন। চোখের সামনে এ ধরনের নির্যাতন দেখলে তাঁরা মেনে নেন না। অন্যদেরও এ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করবেন। এই অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষগুলোই হলেন ‘চেঞ্জমেকার’। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের উদ্যোগে ‘আমরাই পারি’ নামে সামাজিক প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়েছেন চেঞ্জমেকাররা। ২০০৪ সালে অক্সফামের সহায়তায় এই প্রচারাভিযানের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশেই। দক্ষিণ এশিয়াসহ বর্তমানে বিশ্বের মোট ৫টি দেশে এ কার্যক্রম চলছে। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের জাতীয় সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক বলেন, যে-কেউ যে কোনো সময় থেকে নিজেকে চেঞ্জমেকার হিসেবে ভাবতে পারেন। তবে তাঁর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনকে চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছা বা মনোবল থাকতে হবে। কাজে দায়বদ্ধতা বাড়ানো এবং পরিসংখ্যান রাখার সুবিধার জন্য এলাকার স্থানীয় সংগঠনের কাছে গিয়ে চেঞ্জমেকার হিসেবে নাম লেখাতে হয়। এর আওতায় সব কাজ করতে হয় সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। একজন ব্যক্তিকে চেঞ্জমেকার হওয়ার পর তিনি কমপক্ষে ১০ জনের সঙ্গে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কথা বলবেন বলে অঙ্গীকার করতে হয়। তবে গত বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন চেঞ্জমেকার গড়ে ৬৪ জনের সঙ্গে কথা বলেন। জরিপ বলছে, চেঞ্জমেকারদের কথা শোনার পর বাংলাদেশের শতকরা ৬৯ ভাগ মানুষই তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছে। এটিও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি (প্রথম আলো, ২৫.১১.১২) ।
প্রতিটি ব্যক্তিকেই বদলাতে হবে। ব্যক্তির মনোজাগতিক পরিবর্তনই পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধের প্রধান উপায়। সামাজিক যে আন্দোলন সূচিত হয়েছে, সেটা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু মূল আন্দোলন শুরু করতে হবে ঘর থেকে। প্রতিটি বাবাকে হতে হবে শ্রেষ্ঠ বাবা। শ্রেষ্ঠ স্বামী না হলে শ্রেষ্ঠ বাবা হওয়া যায় না। স্ত্রীকে নির্যাতন করলে কখনোই কোনো বাবা শ্রেষ্ঠ হতে পারবেন না। সন্তানের কাছে মর্যাদা পাবেন না। সন্তান সেই বাবাকে ঘৃণা করবে, বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে। এমন পরিবার কখনোই সুখী হতে পারবে না।
সম্পর্কে সৎ হতে হবে স্বামী-স্ত্রীকে। সৎ সম্পর্কে সুন্দর হয় পারিবারিক পরিবেশ।
মনে রাখা দরকার, নারী-পুরুষ যখন বিয়ে করে উভয়ই দোষে-গুণে পূর্ণ পুরো মানুষটার সঙ্গেই গাঁট বাঁধে। বিয়ের পর কেবলই দোষ খুঁজতে থাকলে সম্পর্কের বাঁধন দৃঢ় হয় না। গুণের প্রতিই নজর রাখতে হবে বেশি। আর সম্পর্কের প্রথম দিকে আবেগের যে উত্তাল ঢেউ থাকে, দিনে দিনে কিছুটা স্থিত হয়ে আসে সেই প্লাবন। শান্ত-সৌম্য মায়ার বাঁধন দৃঢ়তর হতে থাকলেও মমতা ও ভালোবাসার প্রকাশ কমে যায় আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে। ফলে ভালোবাসা হারিয়ে গেছে, অবহেলার শিকার হচ্ছি এমন ভুল ভাবনার জালে জড়িয়ে স্বাভাবিক সম্পর্কে বিষ ঢেলে দেয় স্ত্রীরা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামীরাও। ফলে পারিবারিক পরিম-লে শুরু হয়ে যায় ঝড়-তুফান। এই তুফান থামাতে হলে যৌন-জীবনের যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে উভয়কে। আমাদের সমাজে মেয়েরা ভাবে, এই দায়িত্ব কেবলই স্বামীর। না। কেবলই স্বামীর না। একই রকম সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে স্ত্রীদেরও। স্বামীসোহাগ, স্বামীর নিবিড় সান্নিধ্য, দেহমিলন, উপভোগ করা স্ত্রীর আইনগত, ধর্মীয়-নৈতিক অধিকার। মনে রাখতে হবে স্ত্রীদের। লজ্জার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে তাদের। নিয়মিত অকৃত্রিম দেহমিলনে দেহে নিঃসরিত হয় অক্সিটোসিন হরমোন। এই জৈব-রাসায়নিক উপাদানটি দৃঢ় করে মায়ার বাঁধন। বন্ধন মজবুত রাখার দায়িত্ব উভয়েরই সমান।
পরিবারে কারও মানসিক সমস্যা যেমন সন্দেহ প্রবণতা বা ওথেলো সিনড্রম কিংবা ব্যক্তিত্বের সমস্যা থাকলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে নির্যাতনের শিকার হতে পারেন। ফ্যামিলিথেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি ও অন্যান্য মনোচিকিৎসায় এই বিপর্যয় রোধ করে সম্ভব পারিবারিক আবহ সুন্দর করা। সুখী হতে হলে পারিবারিক আবহ সুন্দর করতেই হবে।
সুন্দর আবহ নিশ্চিত প্রতিরোধ করতে পারে পারিবারিক সহিংসতা। একই সঙ্গে মাদকমুক্তি না ঘটলে পরিবারের ভয়াবহ সহিংসতা কমানো সম্ভব নয়। পারিবারিক সহিংসতা থেকে মুক্তি, সুস্থ পরিবার ও সুন্দর সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে মাদক নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামতে হবে জাতিকে। একই সঙ্গে ঘরে ঘরে নৈতিক, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা রক্ষার সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
drmohitkamal@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.