দামিনী শুধু ভারতকন্যাই নন, বিশ্বকন্যাও- রণেশ মৈত্র

সম্প্রতি দিল্লী নগরীর ‘বাসে মেডিক্যাল ছাত্রী, যাঁকে গণমাধ্যমসমূহ কখনও দামিনী, কখনও ভারতকন্যা, কখনওবা অন্য নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করেছে, সেই জীবনবাজি রেখে ধর্ষক জানোয়ারদের সঙ্গে খালি হাতে আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করে অবশেষে আহত হয়ে প্রথমত দিল্লীর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
তারপর ভারত সরকারের উদ্যোগে সেই বীর নারীযোদ্ধাকে অবস্থার অবনতি ঘটায় ডাক্তারদের পরামর্শে সিঙ্গাপুরে উন্নততর চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে মৃত্যুর সঙ্গে তিন দিন তিন রাত লড়াই করার পর সবশেষে মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করেন। কিন্তু না, দামিনী মরেননি। দামিনী বা জ্যোতি সিং পাণ্ডে (তাঁর বাবা স্বয়ং মেয়েটির নাম প্রকাশ করেছেন গর্বের সঙ্গে বলে অবশেষে জানা যায়) ভারতবর্ষকে কাঁপিয়েছেন। প্রায় দেড়শ’ কোটি নর-নারীকে ধর্ষণবিরোধী উত্তাল গণআন্দোলন গড়ে তুলতে অশ্রুতপূর্ব প্রেরণা জুগিয়েছেন। ভারতকে কাঁপিয়ে তুলেছেন। ভারতবর্ষের সরকারকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়েছেন এবং পরিণতিতে আসামিরা সবাই গ্রেফতার হয়েছে। বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে এবং ততোধিক দ্রুততার সঙ্গে পুলিশ সব আসামির বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে সব আসামির ফাঁসির আদেশ দানে বাধ্য হয়েছেন এবং বিশেষ আদালতে গোপনে তাঁর বিচার কাজ শুরু হওয়ার পথে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই দামিনী বা জ্যোতি সিং পা-েকে মরণোত্তর প্রণতি জানাই।
জ্যোতি সিং পা-ের বাবা বদরি সিং পা-েকেও অভিনন্দন জানাই। দিন কয়েকের মধ্যেই কন্যার শোক সামলে নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমার মেয়ে কোন ধরনের ভুল করেনি, নিজেকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে গেছে। জ্যোতির মতো কন্যার পিতা হতে পারা অত্যন্ত গর্বের। তাঁর এই সাহসী নামটি হাজার বছর ধরে বিশ্বব্যাপী নারীর মান বাঁচানোর জন্য উৎসাহ যোগাবে।’ অবশ্য নিগৃহীত জ্যোতির মা এখনও নিজেকে সামলে উঠতে পারেননি। কারণ তিন মাসের মধ্যে জ্যোতির বিয়ে হবে এমনটি পূর্বেই স্থির হয়েছিল বলে জানা যায়। বিয়ের পিঁড়িতে বসার সেই সুযোগটি পেলেন না জ্যোতি।
দূরদেশ থেকে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি জ্যোতির বিদেহী সাহসী আত্মাকে আর জানাই সশ্রদ্ধ সহানুভূতি তাঁর গর্বিনী বাব-মাকে। এমন বাবা-মা খুব কমই দেখেছি কোন মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার পর যারা এমন ভূমিকা গ্রহণ করেন।
যা হোক, ধর্ষণ পালা জ্যোতিকে দিয়েই শুরু বা শেষ নয়। পিশাচরা সর্বত্র সর্দাসক্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাসহ যে ধর্ষণ তা-বের শুরু হয়েছে বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজ দলের ক্যাডারদের দ্বারা তা ভারতের ওই প্রদেশে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ও প্রদেশ থেকে প্রকাশিত অসংখ্য সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় এ নিয়ে অসংখ্য কাহিনী নিত্যদিনই প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। শুধু পশ্চিম বাংলাই বা কেন? খোদ দিল্লীসহ ভারতের অপরাপর প্রদেশেও নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারী হত্যা অসংখ্য ঘটছে।
আর বাংলাদেশে? এখানে তো নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের যে ঘটনা প্রতিবছর ঘটে চলেছে, নারী সংগঠনগুলো তার সংখ্যা মাঝে মধ্যেই সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে অবহিত করে থাকে। কিন্তু তার কি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া আমাদের সমাজে এখন প্রত্যক্ষ করি? হ্যাঁ, নারী সমাজকে অনেক সময়ই দেখা যায় ধর্ষণ, যৌন হয়রানি প্রভৃতির বিরুদ্ধে রাজপথগুলোতে মানববন্ধন রচনা করতে, ছোটখাটো সভা-সমাবেশ করতে বা সংবাদপত্রে তার বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রকাশ করতে। কিন্তু বিশাল যে পুরুষ সমাজ তারা? তাদের নিহায়ত অল্প অংশকেই ওই ধরনের সভা-সমাবেশ বা মানববন্ধনে উপস্থিত হতে দেখা যায়। এ আর এক নিষ্ঠুরতা বলা চলে।
আদালতের জন্য কঠোরতার সুযোগ আছে ধর্ষকের বিরুদ্ধে। কিন্তু এ ধরনের অনেক ঘটনাই প্রথমত আদালত পর্যন্ত গড়ায় না, গড়াতে দেয়া হয় না ওই মাতবর কিংবা সমাজপতিদের চেষ্টার কারণেই। তার পরেও যা গড়ায়- তার মাত্র পাঁচ থেকে দশ ভাগ সাজা পেতে দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা প্রমাণ হয় না কারণ হিসেবে বলা হয় উপযুক্ত সাক্ষীর অভাব। আসলে ধর্ষণ এমনই একটি ক্রিয়া, যা সচরাচর কাউকে সাক্ষী রেখে কেউ করে না সংঘটিত হয় অত্যন্ত গোপনে। দ্বিতীয়ত অদি ধর্ষিত বেঁচে থাকেন তবে আদালতে তাকে পড়তে হয় অস্বাভাবিক বিড়ম্বনায়। কারণ বাদী হিসেবে তাকে নিজেকেই প্রকাশ্য আদালতে অজস্র আইনজীবী, সহকারী, বিচারকের পেশকার, পিয়ন ছাড়াও অসংখ্য দর্শনার্থীর সামনে বর্ণনা করতে হয়। এই বিড়ম্বনা চরমে পৌঁছায় যখন আসামি পক্ষের আইনজীবী বাদীকে জেরা করতে বসেন। প্রথমেই বলা হয়, আসামিকে কতদিন থেকে চেনেন, কীভাবে চেনেন, কতদিন থেকে তার সঙ্গে আলাপ-যোগাযোগ, প্রকাশ্যে-গোপনে দেখামতে প্রভৃতি অস্বস্তিকর প্রশ্ন। যেন তাদের মধ্যে অতীত থেকে চেনাজানা ও প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তদুপরি প্রশ্ন এমনভাবে করা হয় যাতে চবহবঃৎধঃরড়হ, স্বেচ্ছায় নাকি বাধ্য হয়ে উলঙ্গ হওয়া ইত্যাদি। কোন মহিলাই এগুলো সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পারেন না অত পুরুষের সামনে। এমন কোন বিধান নেই যাতে বিচারক থেকে শুরু করে যাঁরাই আদালতে উপস্থিত থাকবেন সবাইকে মহিলা হতে হবে। ফলে ঠিক মতো বলতে না পারার কারণেও আসামিরা খালাস পেয়ে যায় বহু ক্ষেত্রে। তাই বিচারের প্রচলিত এই বিধানটি পাল্টানো প্রয়োজন। অপর পক্ষে প্রকাশ্যে নয়, গোপনে ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সর্বশেষ আমাদের রাষ্ট্রও দেখা যাচ্ছে ধর্ষকদের প্রতি সহানুভূতিশীলÑ ধর্ষিতার প্রতি নয়। এই মানসিকতার আবসান হওয়া জরুরী। রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট কোন অঙ্গ এই জঘন্য অবস্থানের পক্ষাবলম্বন করলে তার প্রতিকার সম্ভব নয়।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.