মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের আধিপত্য না থাকলে দেশবোধের সৃষ্টি হবে কিভাবে? by মুনতাসীর মামুন

গত দু’বছর নির্দিষ্ট দিনে টেলিভিশনে দেখা যায় খুদে ছাত্রছাত্রীরা বিপুলভাবে আন্দোলন করছে। তিনটি দিন এ দৃশ্য দেখি। পঞ্চম, অষ্টম শ্রেণী ও এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন। এবার যুক্ত হলো ১ জানুয়ারি, যেদিন সারাদেশের ছাত্রছাত্রীরা পেল নতুন বই।
গত সপ্তাহে দেখলাম, বয়সী মহিলারা সব ভুলে নাচছেন প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণ করায়। এগুলো অতীব মনোহর দৃশ্য। এসব কিছ্ইু অভিনন্দনযোগ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাফল্য। এ সাফল্যের ভিত্তি কিছু উদ্ভাবনী শক্তির পরিচায়ক। কিছু রুটিন কাজ দক্ষতার সঙ্গে করা।
গত চার বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এর একটি কারণ, মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত তিনি যা করতে চেয়েছেন তা পেরেছেন। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন সাফল্য নেই। ভিসিদের অপকর্মের খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। এর দশভাগ সত্য হলেও লজ্জাকর। কারণ, ভিসির আগে তার পরিচয় একজন শিক্ষক। প্রায় যতজন ভিসি এ সরকার নিয়োগ করেছে, তাদের কেউ-ই ঔজ্জ্বল্য দেখাতে পারেননি, উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে পারেননি; রুটিন কাজ করেছেন এবং সে কাজ করতে গিয়ে অপকর্ম করেছেন। ভিসি নিয়োগ খুব সম্ভব প্রধানমন্ত্রীই করেন, মাঝে অনেকে হস্তক্ষেপ করে, এসব ক্ষেত্রে শিক্ষক হিসেবে তাদের সুনাম থাকলেও তদবির হয় প্রচুর। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তারা মোটামুটি অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
পাঠ্যবই সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়া এই সরকারের বড় কৃতিত্ব। আগেও পাঠ্যবই পৌঁছাবার রীতি ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট দিন কেউই তা পারেননি। নাহিদ পেরেছেন এবং পরিধিও বাড়িয়েছেন। মাধ্যমিক, প্রাথমিক ও মাদ্রাসার সব ছাত্রছাত্রীকে বিনে পয়সায় পাঠ্যবই দেয়া হচ্ছে। একটি গরিব দেশে এটি অনেক বড় ব্যাপার। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই নির্দিষ্ট দিনে বই পেয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। এ বছর ৩ কোটি ৬৮ লাখ ছাত্রছাত্রীর মাঝে ২৬ কোটি ১৭ লাখ বই পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বই পৌঁছে দেয়া মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এই কাজটি এতদিন সুষ্ঠুভাবে করা যায়নি। এবার মন্ত্রণালয় পেরেছে, দক্ষতা দেখিয়েছে, নিজের কাজ সুষ্ঠুভাবে সমাপন করেছে। একজন মন্ত্রী যথাযথভাবে তা করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্ভাবনী কাজের মধ্যে দুটি কাজ গুরুত্বপূর্ণ একটি পঞ্চম শ্রেণী ও অন্যটি অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছার আগে দুটি সার্টিফিকেট পাচ্ছে এবং ঝরে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমেছে এবং কতভাগ হ্রাস পাচ্ছে তারও একটি হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে মাধ্যমিকে পাসের হার বেড়েছে। ২০০৯ সালে যা ছিল ৬৭.৪১, এ বছর তা দাঁড়িয়েছে ৮৬.৩২ ভাগে [ডেইলি স্টার ৭.১.১২] গত ছয় বছরে ১৬১২টি স্কুলকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে।
সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব রেজিস্ট্রিকৃত প্রাইমারি স্কুলের জাতীয়করণ। প্রায় ৪০ বছর পর ২৬,২৮৪টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছে। এসব স্কুলের শিক্ষকরা এখন নির্দিষ্ট দিনে বেতন পাবেন, ক্লাসের শিক্ষকতায় আরও মনোযোগী হবেন। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে প্রায় কয়েক লাখ প্রান্তিক মানুষ উপকৃত হবেন।
এতসব সাফল্য সত্ত্বেও একটি প্রশ্ন শুধু আমার নয়, অনেকের মনেই জাগছে শিক্ষা ক্ষেত্রে এই বিনিয়োগ কী দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা মানবিক বা সমাজবিজ্ঞান অনুষদে যেসব ছাত্রছাত্রী পাই, তারা এত দুর্বল কেন? বিজ্ঞান বা বাণিজ্য অনুষদে আমি পড়াই না ফলে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা ছাত্ররা পড়তে আসে। তারা যদি দুর্বল হয় তা হলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী অবস্থা? শুধু তাই নয়, তাদের জগত-দেশ সম্পর্কে কৌতূহল কম, মনোজগতে প্রগতির আধিপত্য কম। প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে যদি ছাত্রের ভিত্তি শক্ত হয় তা হলে উচ্চ পর্যায়ে অবস্থা কেন এমন?
গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা খুব ভাল নয়। অবকাঠামো দুর্বল, শিক্ষকদের মান সব ক্ষেত্রে যথাযথ এমন বলা যাবে না। প্রাথমিক শিক্ষকরা সবাই কি যথাযথ প্রশিক্ষণ পান? প্রাথমিক স্কুলগুলো মনিটরিং ঠিকমতো করা হয় বলে মনে হয় না। আমি অনেক এলাকায়, স্কুল দেখেছি, ছাত্র বা শিক্ষকের উপস্থিতি তেমন নজরে পড়েনি। উপজেলা শিক্ষা অফিসার সব জায়গায় আছেন। তিনি তার কাজ নিয়মিত করেন কিনা সন্দেহ। উপজেলা পর্যায়ে সবকিছুর ওপর কেন্দ্রের প্রতিনিধির যথাযথ কর্তৃত্ব নেই।
মাধ্যমিক স্কুলগুলোর অবস্থা ভাল, কিন্তু কলেজগুলোর অবস্থা, বিশেষ করে বেসরকারী কলেজের অবস্থা শোচনীয়। আমি আমার উপজেলার সবচেয়ে বড় কলেজের গবর্নিং বডির দায়িত্ব পেয়ে দেখি, কলেজের অবকাঠামো বলতে কিছু নেই। ক্লাসরুমের দরজা-জানালা নেই। শিক্ষকরা নিয়মিত আসেন না। ছাত্রছাত্রীদের অবস্থাও তথৈবচ। সরকার শিক্ষকদের প্রতি মাসের বেতন দেয়। ছাত্রবেতন থেকে পুরনো বেতন শোধ করতে হয়। এ শোধ কতদিনে শেষ হবে বলা যায় না। এসব দেখার দায়িত্ব অবশ্য গবর্নিং বডির। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই নজরদারি আছে। সরকারী কলেজের অবকাঠামো ভাল। কিন্তু শিক্ষকস্বল্পতা চোখে পড়ার মতো। যেসব কলেজে স্নাতক সম্মান কোর্স আছে সেগুলোতে পড়াবার মতো পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। শিক্ষকদের একটা বড় অংশ প্রেষণে শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত। এ বিষয়টি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। যারা শিক্ষা প্রশাসনে যাবেন তাদের জন্য আলাদা ক্যাডার হবে কিনা সেটাও ভাবা দরকার। কলেজ শিক্ষক নিয়োগের জন্য আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন জরুরী হয়ে পড়েছে। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু মনে হয়েছে, কলেজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।
পাসের হার বাড়ছে দেখে তাই খুশি হওয়ার কিছু নেই। পাসের হার বাড়ানো যেতে পারে, কমানোও যেতে পারে। আমি সে বিতর্কে যাব না। কিন্তু এত জিপিএ-৫ ছাত্রছাত্রীরা কেন ওপরে ওঠার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে?
এবার নিজেদের অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতে হয়। আমরা স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার করে প্রায় এক নৈরাজ্যমূলক অবস্থার সৃষ্টি করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় আইনগুলো নিয়ে আবার ভাববার সময় এসেছে। ছাত্র ভর্তির যে পদ্ধতি আমরা এখন ব্যবহার করছি তাতেও বোধহয় ভুল আছে। যে ছাত্র যে বিষয় পড়তে চায় খুব কম ক্ষেত্রেই সে তা পড়তে পারছে। ফলে ক্লাসে আমরা অনিচ্ছুক ছাত্র পাচ্ছি। তার ওপর এখন কলা ও মানবিকে মাদ্রাসা পাস করে আসা ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সেক্যুলার কলেজ থেকে পাস করা ছাত্ররা মার খাচ্ছে। মাদ্রাসা থেকে সরাসরি যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে তারা এক নতুন জগতে প্রবেশ করে, যেখানে তার খাপ খাওয়ানো কঠিন। এ অবস্থা কেন হচ্ছে? কারণ, মাদ্রাসায় প্রতিটি পর্যায়ে ছাত্রদের অধিক নম্বর দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরের গড় করা হয়। তাতে মাদ্রাসা জিতে যায়। অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক ধরনের মাদ্রাসায় পরিণত হয়ে যাবে।
মনোজগতের কথা বলেছিলাম। ছাত্র যারা বেরোচ্ছে তাদের মনোজগতে এখন প্রগতির আধিপত্য কম। দেশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা কম। একটাই লক্ষ্য থাকে কীভাবে বিদেশ, বিশেষ করে আমেরিকা চলে যাওয়া যায়। এ অবস্থাটা কিন্তু আগে ছিল না। আজ যে ছাত্ররাজনীতিতে আদর্শ নেই, টেন্ডার আর খুন খারাবি আছে তার কারণ এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র এখন আর ভাল অর্থে রাজনীতি-সচেতন নয়। এ অবস্থা তো আগে ছিল না; এখন কেন হচ্ছে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এর একটা কারণ হতে পারে পাঠ্যবই। গত তিন দশকে পাঠ্যবইয়ে প্রগতির চিন্তা ছিল না; ইতিহাসের বিকৃতায়ন হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, বিশ্ববিদ্যালয় পাস একটি ছেলে বিএনপি-আওয়ামী লীগের কথা জানে কিন্তু দেশের কথা জানে না, এর ইতিহাস জানে না। ইতিহাস জানলে তো দেশপ্রেম জাগবে, কৌতূহলী হবে। ইতিহাস না জানলে তো আর দেশে শেকড় গাড়বে না। বর্তমানের ভিত্তি তো অতীত, আর ভবিষ্যতের ভিত্তি বর্তমান।
মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য জরুরী মানবিক বিদ্যা। এক সময়ে পাশ্চাত্যে মানবিক বিদ্যার ওপর থেকে গুরুত্ব হ্রাস করা হয়। ফলে শিক্ষাবিদরা অনুভব করেন, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মানবিকতা হ্রাস পাচ্ছে। তারপর, যে শিক্ষার্থী যে শাখাতেই পড়ুক না কেন মানবিক বিদ্যার একটি কোর্স তাকে করতেই হয় বিশেষ করে নিজের দেশের ইতিহাস পড়াটা বাধ্যতামূলক।
আমাদের দেশে কি সব পর্যায়ে সব শাখায় নিজের দেশের ইতিহাস পড়ানো হয়? এর উত্তর না। পাকিস্তানে ইতিহাস পড়ানোটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে শুনেছি, বদলে পাকিস্তান স্টাডিজ চালু করা হয়েছে। এর কারণ, গত তিন দশকে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা যেন অজানা থাকে। তাহলে, যে প্রজন্ম বেড়ে উঠবে তার পক্ষে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার সুযোগ হবে না। হরপ্পা মহেঞ্জোদারো, সুফিবাদের কথা না জানলে দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সে জানবে না। ফলে, বর্তমান শাসনই দেখবে, তুলনা করতে শিখবে না, বিদ্যমান ব্যবস্থাই তার মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করে থাকবে, বিদ্রোহী হবে না। পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের পর যে প্রজন্ম গড়ে উঠছে তাদের মনোজগতে এখন আধিপত্য বিস্তার করে আছে ধর্ম, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, প্রতিক্রিয়াশীলতা ইত্যাদি।
আমাদের দেশেও সেই প্রবণতা দেখা দিয়েছে। গত দু’দশক আমরা অনেকে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ, ঐতিহাসিক, পেশাজীবী সংস্থার কাছে আবেদন করেছি বিষয়টি বিবেচনার জন্য। কিছু হয়নি। কলেজে কলেজে ইসলামী ইতিহাস খোলার আগ্রহ বরং দেখেছি প্রবল। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যতটুকু ইতিহাস পড়ানো হয় তা ১৯৭১ পর্যন্ত। এরপর পড়াতে দেয়া হয় না; কেননা, তা হলে জিয়া ও এরশাদের নষ্টামির কথা পড়াতে হবে। ছাত্ররা জানবে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বদলে জিয়া আদর্শ মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করানো হয়েছে এবং তা যেন অটুট থাকে সেই প্রচেষ্টাই অব্যাহত এবং দুঃখের বিষয়, এই সরকারও সেই ধারা অনুসরণ করছে।
মানবিক বিদ্যার অন্যতম বিষয় ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ক’টি বিভাগ নিয়ে খোলা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন আর ইতিহাস; আর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপকদের এই তিন বিভাগে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল। অমর্ত্য সেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন এবং যে ক’টি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা করছে তার মধ্যে ইতিহাস অন্যতম। আজকের বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০০-এর ওপরে। এর মধ্যে পুরনো ৪-৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ইতিহাস বিভাগ নেই। বাংলার অবস্থাও অনুরূপ। বাংলা তো সব বিভাগে থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়, আইন করে হলেও। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববিদ্যার বিষয়াবলী অনুপস্থিত।
এবার দেখা যাক কলেজের অবস্থা। ঢাকা শহরে মাত্র ৪টি সরকারী কলেজে ইতিহাস পড়ানো হয়। ৮টি জেলার ৩০টি সরকারী কলেজের কোনটিতে ইতিহাস বিভাগ নেই। কোন সরকারী মাদ্রাসায় ইতিহাস পড়ানো হয় না। দেশের ৪ হাজার ৭৫৭টি বেসরকারী কলেজ ও মাদ্রাসায় ইতিহাস পড়ানো হয় না। ইতিহাস বাদ দিই, চাকরির ক্ষেত্রে আজকাল মানবিক বিভাগের কোন শাখাকে যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
বর্তমান সরকারের সাফল্য হিসেবে নতুন কারিকুলাম চালুকে বিবেচনা করা হয়। বিএনপি-জামায়াত আমলের পাঠ্যবই বিকৃতায়নের পর এই প্রচেষ্টা প্রশংসার্হ। ১৭ বছর পর সরকার এ বছর ১১১টি পাঠ্যবই প্রকাশ করেছে। আমাদের আপত্তি, এই পাঠ্যক্রমে ইচ্ছাপূর্বক ইতিহাসকে বাদ দেয়া হয়েছে। কেননা, যারা পাঠ্যক্রম কমিটিতে ছিলেন তারা দেশের বরেণ্য ব্যক্তি শুধু নন, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। তারা যদি এটি করে থাকেন তাহলে জেনেশুনেই করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির সভাপতি। এর সদস্য ২০ জন সংখ্যাগরিষ্ঠ পদাধিকার বলে। বরেণ্য শিক্ষাবিদদের মধ্যে আছেন ড. কাজী শহীদুল্লাহ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাসের ড. মুহাম্মদ আখতারুজ্জামান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহীন মাহবুবা কবির।
তারা যে পাঠক্রম তৈরি করেছেন তাতে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম পর্যন্ত থাকছে বাংলাদেশ ও বিশ্ব-পরিচয় (এর সম্পাদকম-লীতে আমি ছিলাম)। এখানে ৬টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত তার মধ্যে ইতিহাস একটি। এখানে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা আছে ১০০ নম্বরের। ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে আবশ্যিক বিষয়ের অন্যতম ১০০ নম্বরের ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা (১০০ নম্বর) ও ১০০ নম্বরের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। ইতিহাস আবশ্যিক নয়। ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর তিনটি শাখা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা। বিজ্ঞান শাখার জন্য ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ আবিশ্যক বিষয়। কিন্তু ব্যবসায় শিক্ষার জন্য ‘বিজ্ঞান’ পাঠ আবশ্যিক হলেও ইতিহাস পড়তে হবে না। এমনকি ঐচ্ছিক হিসেবেও নেই। তবে, মানবিক শাখা থেকে ইতিহাস একেবারে বাদ দেয়া যায়নি।
একাদশ ও দ্বাদশ পর্যায়ে ৬টি শাখার জন্য আবশ্যিক হলো বাংলা, ইংরেজী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। এ পর্যায়ে শাখা ৬টি মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসা, ইসলাম শিক্ষা, গার্হস্থ্য ও সঙ্গীত। এসব শাখার কোনটিতে ইতিহাস বাধ্যতামূলক নয়। মানবিক শাখায় আছে ইতিহাস/ইসামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি/ইসলাম শিক্ষা; অন্য দুটি শাখায় ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে হিউম্যান রাইটস ও জেন্ডার স্টাডিজ রাখা হয়েছে।
এর অর্থ হচ্ছে শিশু অবস্থা থেকে জোর দেয়া হচ্ছে নৈতিক ও ধর্ম শিক্ষা, ইসলাম শিক্ষা ও ইসলামের ইতিহাসের ওপর। এই কারিকুলাম তৈরির ভিত্তি হিসাবে যে ওয়ার্কশপ ও গবেষণা করা হয়েছে সেখানে শিক্ষাক্রম উন্নয়নের নীতিমালা হিসেবে প্রথমেই ঘোষণা করা হয়েছে ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশপ্রেম বিকাশে সৃষ্টি।”
সেই পরিপত্রে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২-এর বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ১ নম্বরে ‘ধর্ম শিক্ষাসহ সকল বিষয়ে নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব প্রদান’। ২ নম্বরে ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের মাধ্যমে দেশাত্মবোধ ও জাতীয় ঐক্য বিকাশের ওপর গুরুত্ব প্রদান। দেশাত্মবোধ বিকাশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবোধ প্রয়াস।’ ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে আছে ৩ ও ৪ নম্বরে “মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষার্থীর মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং সম্ভাবনাময় নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা।
৪. শিক্ষার্থীর মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে সুসংহত জ্ঞানের ভিত রচনা তথা এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার প্রতি আগ্রহ ও যোগ্যতা সৃষ্টির মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের প্রগতি ও উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম করে গড়ে তোলা।”
ধর্ম, নৈতিক, ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী শিক্ষা এবং ধর্মশিক্ষা দিয়ে যদি এই বুদ্ধিজীবীবৃন্দ ও সরকারী কর্তারা মনে করেন উপযুক্ত আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব তা হলে বলতে বাধা হচ্ছি আমরা হবুচন্দ্র রাজার রাজত্বে বাস করছি।
বাধ্যতামূলকভাবে এসব পড়ে আর যাই হোক ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ’, ‘দেশপ্রেম’ এবং ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা’ বোধ জাগবে না। তবে হ্যাঁ, জিয়া চেতনা, সাম্প্রদায়িকতা বোধ, শেকড়হীনতা ও জঙ্গী মৌলবাদের চেতনা জাগ্রতকরণে সহায়ক হবে। দেশপ্রেমহীন জিয়া ও এরশাদ, নিজামী এবং খালেদা মনোজগতে যে আধিপত্য বিস্তার করে গেছেন বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে এই সরকার তার পাল্টা কোন ব্যবস্থাই নেয়নি গলাবাজি করা ছাড়া। এইবারের সুযোগটিও তারা হারাচ্ছে।
কয়েকদিন আগে কমিউনিস্ট নেতা মঞ্জুরুল আহসান খান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের গৌরবময় দিনের সঙ্গে বর্তমানে ছাত্রদের তুলনা করে বলছিলেন মুনতাসীর, আমরা হটে যাচ্ছি ; কারণ মনোজগতে আমরা আধিপত্যহীন। অন্য রাজনৈতিক নেতারা যদি গভীরভাবে এটি চিন্তা করতে পারতেন তাহলে তো রাজনীতির মান উন্নত হতো, আমাদের এসব লিখতে হতো না। গত তিন দশকে আমরা হটে গেছি এবং এখন আরও হটে যাচ্ছি। আজ ছাত্রদের টেন্ডারবাজি, রাজনৈতিক বোধহীনতা, আলু-পটোলের মতো চিন্তা, শৃঙ্খলাহীনতা দেখে আপনারা দুঃখবোধ করেন কেন? রাজনৈতিক নেতারা তাদের মনোজগত এভাবে নির্মাণে সহায়তা করেছেন। এই সরকারও তাতে সহায়তা করেছে।
শুরুতে যেসব সাফল্যের কথা উল্লেখ করেছি এগুলো স্থায়ী হবে না, ফলদায়কও হবে না; যদি না মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করা যায়। আর মানবিক শাখা বিশেষ করে নিজের দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে যদি বোধ না জন্মানো যায় তা হলে দেশপ্রেমিক মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.