কলোনি বাজারের জামালপুরী নারী দোকানির কথা by ড. আর এম দেবনাথ
জামালপুরের মেয়ে। বয়স কত হবে? ত্রিশের কোঠায় হবে। দৃশ্যত বেশ বুদ্ধিমতী। মতিঝিল কলোনি বাজারের দোকানি। না, কোন নির্দিষ্ট দোকান নয়। বরাদ্দপ্রাপ্ত কোন জায়গায় তার দোকান নয়। ফুটপাথের দোকানি।
নাকে-মুখে কথা বলে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মেয়ে বলে মনে হয় না। কারণ বৃহত্তর মযমনসিংহের মেয়ে কেন পুরুষরাও এত চালাক-চতুর হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা হয় ‘পেট-বেক্কল’ (আমার ভাষায় নয়, ময়মনসিংহের ভাষায়)। এই ধরনের বেয়াক্কলরা দুটো ভাত পেলেই সারাদিন কাজ করতে রাজি। টাকার চিন্তা তাদের মাথায় নেই। এই অবস্থাই ছিল আগে। এখন হয়ত কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তা না হলে জামালপুর শেরপুর কেন কাছেধারের কিশোরগঞ্জের লোকেরাও ঢাকায় আসত না। আজকাল আসে। আসে বলেই মেয়েটির সঙ্গে আমার কথা হয়। ও কি বিক্রি করে? দেশি হাসের ডিম, ডাব, দেশী পুঁইশাক, ছোট ছোট পেঁপে, দেশী মোরগ-মুরগি। মেয়েটি চাষের কোন জিনিস বিক্রি করে না। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। বাজারে তো আজকাল বড় বড় আকারের শাকসবজি পাওয়া যায়। ও এসব জিনিস বিক্রি করে না। কোন দিন আনে নিমপাতা, কোন দিন কামরাঙা। এ ধরনের মাল আনে বলেই কিছু খরিদ্দার ও পায়, যারা অনেক সময় চাষের জিনিস কিনতে চায় না। ঘিমাশাক আনে, আনে ‘গুয়া’ (সুপারি)। আনে দেশী ছোট ছোট কচ্।ু এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই মাঝে মাঝে আমি তার দোকানে যাই। এই বুদ্ধি সে কোথায় পেল? জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি বলল, এটা সে পেয়েছে তার মায়ের কাছ থেকে। মা এই ব্যবসাটা করত। ফুটপাথের দোকান। পুলিশ বাবাজিকে দিনে দশ টাকা দেিত হয়। অবশ্য টহল পুলিশ বদল হলে অন্য দলকেও দিতে হয় দশ টাকা। মাঝে মাঝেই দোকান বন্ধ করতে হয় পুলিশী অভিযান থেকে বাঁচার জন্য। এটা তাদের দৈনন্দিন সংগ্রাম। এই অভিযানে দোকান ওঠে, আবার পুলিশ গেলে ধীরে ধীরে আবার বসে। এ এক খেলা। নিত্যদিনের সঙ্গী। পান খেতে খেতে দোকানী মেয়েটি বলে স্যার, আমার সংসার চলে যায়। এখন শীত চলছে। দেশি হাঁসের বড় চাহিদা। দুটো বড় হাঁসের দাম ৮০০ টাকা। কিনে ৫৫০-৬০০ টাকা দিয়ে। গাড়ি নিয়ে ভদ্রলোকরা আসে। ভাই, আব্বা, মামা ডেকে দুটো পয়সা বেশি নেয়া যায়। মেয়েটি বলে, স্যার, ব্যবহার ভাল করলে লোকেরা এমনিতেই ১০-২০ টাকা বেশি খুশি হয়ে দিয়ে দেয়। বাজে লোকও আছে। কিন্তু এটা স্বাভাবিক। সব মানুষ সমান হয় না। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার স্বামী কী করে। হেসে হেসে দেখাল তার স্বামীকে। স্বাস্থ্যবান যুবক। সঙ্গে একটা ভ্যানগাড়ি। গাড়িভর্তি ক্যান, ক্যানে পানীয় জল। জিজ্ঞেস করলাম এই জল কী কর? বলল, এই জল দোকানে দোকানে সরবরাহ করে। খাবার জল। কলোনির ভেতর থেকে এই জল তুলে আনে সে। ওয়াসার খোলা লাইন আছে। লাইন আছে রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়িতে। সেখান থেকে শত শত লোক বিনাপয়সায় খাবার জল নেয়। এই খোলা লাইন রাস্তার ওপর। পুলিশ বিজ্ঞাপন দিয়ে ঐ জল মানুষকে দেয়। ওখান থেকে সে এই জল আনে। শুধু দোকানে দোকানে নয়। অনেক সময় মতিঝিল কলোনিতে কোথাও কোথাও খাবার জলের অভাব হয়। তখন তার কদর খুব বেশি। দোতলা, তিনতলা, চারতলায় জল তুলে দিতে পয়সা নেয় অনেক বেশি। তখন রোজগার বাড়ে। একা এ কাজ পারে না। তখন ‘হেলপার’ নেয় সে। ছেলেটি বলল, সারা দিনের কাজ নয়। ৪-৫টার দিকে কাজ শেষ। থাক কোথায় তোমরা? থাকি কাছেই। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের পেছনে এক ভদ্রলোকের বাড়ির পরিত্যক্ত গ্যারেজে। এই বাড়ির কর্তার দৈনন্দিন কাজও করে দেয়। তারা তাতে দারুণ খুশি। কাঁচা বাজার, মাছ, দুধ ইত্যাদি ক্রয়ে সাহায্য করা, বিল দিতে সাহায্য করাও তার কাজ। সে বিনাপয়সায় এসব করে। বিনিময়ে অল্প টাকায় স্বামী-স্ত্রী ঐ বাড়িতে থাকে। তার মানে? তোমাদের ছেলেমেয়ে নেই? স্যার আছে। আমাদের ৪ ছেলেমেয়ে। এরা কোথায়? এরা সবাই জামালপুরের চরের বাড়িতে। থাকে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে। তারাই ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করে। দুটো স্কুলে পড়ে। বাকি দুটো ছোট। এখনও স্কুলের সময় হয়নি। জামালপুরের সংসার চলে কী করে? যুবকটি বলল, আব্বা কিছু কাজ করেন। তবে সব সময় কাজ থাকে না। মাসে মাসে ৫-৭ হাজার টাকা পাঠাই। দুই-তিন মাস পর পর বাড়ি যাই। বাজারসওদা করে দিয়ে আসি। ছেলেমেয়ের খোঁজ নিয়ে আসি। গৃহশিক্ষক রেখে দিয়েছি। মাসে হাজার টাকা যায়। জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেমেয়েকে লেখাপ[ড়া করার চিন্তা কোথায় পেলে? ও বলল, তার বাড়িওয়ালা এসব ব্যাপারে উৎসাহ দেয়। আর আমিও দেখি লেখাপড়া করা লোকদের কত আনন্দ, ইজ্জত। মেয়েটি তো লেখাপড়ার ব্যাপারে আরও উৎসাহী। ও বলল, আমার ছেলেমেয়েকে ফুটপাথের ব্যবসা করতে দেব না। বললাম, দেশে জমিজমা আছে? না, দেশে আমাদের কোন জমিজমা নেই। একথা বলেই মেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্যার, আমার স্বপ্ন একটু জমি করার। আমরা বানভাসি লোক। চরে থাকি। শাক-সবজি করা, শস্য করা, গরু পালন করা কিছুই সম্ভব হয় না। আমাদের জমি নেই। আমরা স্যার ছিন্নমূল। তাই স্বপ্ন দেখি একটু জমির, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিভাবে করবে? তোমাদের দিনে রোজগার কত? যুবক ও মেয়েটি একযোগে বলল, স্যার, রোজগার ভালই। নিমপাতা, দেশী হাঁসের ডিম, দেশী মুরগির ডিম, ডাব, দেশী হাঁস, দেশী মোরগ-মুরগি, দেশী কচু থেকে শুরু করে দেশী শাকসবজি জাতীয় জিনিস বিক্রি করে মেয়েটি দিনে ৩০০-৪০০ টাকা রোজগার করে, সকল খরচ বাদে। আমার খটকা লাগে। আবার প্রশ্ন করি, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দেখলাম ৩০০-৪০০ টাকাই হবে। সঙ্গে যোগ হয় তার স্বামীর রোজগার। তার শ্রম বেশি। রোজগারও বেশি। তার রোজগার দিনে পাঁচ শ’ টাকার কম নয়। মাঝেমাঝে বিশ্রাম নেয়। জামালপুরেরই অন্য লোক দিয়ে টাকার বিনিময়ে সে কাজগুলো সেরে নেয়। সবকিছুর পর দিনে তাদের রোজগার ৭০০-৯০০ টাকার কম নয়। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে তো মাসে তোমাদের সর্বনিম্ন রোজগার ২০-৩০ হাজার টাকা। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনেই হয়। কিন্তু তাদের স্বীকারোক্তিতে অবিশ্বাস কিভাবে করি? জিজ্ঞেস করি, এই টাকা কিভাবে খরচ কর? তোমাদের তো সঞ্চয় থাকার কথা। ওরা বলল সঞ্চয় তারা করে। বলল একটা ‘মাসিক’ আছে। আমি আঁৎকে উঠি। না জানি ঐ টাকা কোন্ মাল্টিলেভেল কোম্পানিতে রয়েছে? না, আমি স্বস্তি পেলাম যখন ও বলল তারা টাকা জমায় সরকারী ‘জনতা ব্যাংকে’। সেখানে মাসিক প্রকল্প আছে। মাসে মাসে জমায় ৪০০০ টাকা। জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে তারা জনতা ব্যাংকের নাম শুনল। বলল, তাদের বাড়িওয়ালা বলেছে। তার কথাতেই তারা এই প্রকল্পে টাকা রাখছে। এ ছাড়া কিছু টাকা ঢাকাতেই পরিচিতদের মধ্যে সুদে খাটায়।উপরের বর্ণনা থেকে একটা কথা বোঝা যাচ্ছে জামালপুর, শেরপুর প্রভৃতি অঞ্চলের ছিন্নমূল লোকেরা ঢাকায় এসে বিচিত্রভাবে জীবন-যাপন করছে। কেউ একটু ভাল আছে, কেউ একটু খারাপ। কিন্তু মোটের ওপর খেয়ে-পরে আছে বলেই প্রতীয়মান। এই যেমন এই শীতকালে মতিঝিল, শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী, পুরানা পল্টনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনেক মেয়ে-পুরুষকে পাওয়া যাবে, যারা ভাঁপাপিঠা থেকে শুরু করে নানা ধরনের পিঠা তৈরি করে বিক্রি করে। অনেকেই ভ্যানগাড়িতে সবজি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করে। কেউ পাড়ায় মুরগি বিক্রি করে, হাঁস বিক্রি করে। ইলিশ, চিংড়িমাছ ইত্যাদি তো নিয়মিত ব্যাপার। বিচিত্র সব পেশা এদের। আমার ধারণা, যে-ই একটা কোন কাজ নিয়ে ফুটপাথেত বসেছে সে-ই দিনে ২০০, ৩০০, ৪০০ টাকা রোজগার করতে পারছে। আমি রিক্সাওয়ালাদের কথা বলছি না। এই রিক্সাচালনা ছাড়াও শত বকমের পেশা আছে, যা দিয়ে ঢাকা শহরে লাখ লাখ লোক চলছে। এতে সরকারের কোন সাহায্য নেই। এতে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক বিশ্বখ্যাত সংগঠনগুলোর কোন যোগাযোগ নেই। এখন কি সেই দেশীয় ব্যাংকগুলোর যোগাযোগ। ঢাকায় হাজার হাজার, লাখ লাখ লোক নানা পেশায় জড়িত হয়ে জীবন চালাচ্ছে। এই যেমন পুরনো ঢাকার শ্যামবাজার, রায়সাহেবের বাজার, সূত্রাপুর বাজার, ধোলাই খাল বাজারের অনেক মহিলা দোকানী আছে যারা ফুল বিক্রি করে, ধান-দূর্বা, আম্রপাতা বিক্রি করে। বিক্রি করে আতপ চাল যা দিয়ে অনেক শৌখিন লোক সকালবেলা ‘জাউভাত’ খায়। বেলপাতা ইত্যাদি জোগান দেয় শত শত মহিলা। এরা নদীপারের মহিলা। ভোরবেলায় ঢাকায় আসে পসরা নিয়ে। দুপুরের মধ্যে বাজার শেষ। তারা বাড়ি চলে যায়। দিনে তাদের রোজগারও খুব কম নয়। যেমন আতপ চাল বিক্রি করে এক মহিলা। তার দোকান ফুটপাথে রায়সাহেবের বাজারে। প্রতিদিন উনি ২০-৩০ কেজি চাল বিক্রি করেন। এটা কমপক্ষে। এতে তার ১৫০-২৫০ টাকা থাকে। এই চাল বাজারের দোকানে পাওয়া যায় না। এই মহিলাই পুজোয় ফুলও বিক্রি করে। পুরনো ঢাকা হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। তাদের পুজোয় প্রতিদিন লাগে ফুল, ধান-দূর্বা, আমপাতা, বেলপাতাসহ নানা ধরনের কৃষিসামগ্রী। তারা এসব সরবরাহ করে। তারা তেতো জিনিসও বিক্রি করে। নিমপাতা, ঘিমা শাক ইত্যাদি তাদের কাছেই পাওয়া যায়। এই মহিলারা বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক। তারা যুগযুগ ধরে এই কাজ করে আসছে। এই বৃত্তি থেকে তাদের নিষ্কৃতি নেই। আমি এক মহিলাকে জানি যে এই করে একটি ছেলে ‘গ্র্যাজুয়েট’ করিয়েছে। কম কি? রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মাথায় বোঝা বহন করে, পায়ে চলে চলে পসরা বিক্রি করে সংসার চালানো, তার ওপর এক ছেলেকে ‘গ্র্যাজুয়েট’ করা এটা কি কম কথা। এ ধরনের কত সাফল্যের কাহিনী ঢাকায় ফুটপাথের বাজারে বাজারে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে তার খবর কে রাখে? এনজিওরা রাখে? গ্রামীণ ব্যাংক রাখে? ব্র্যাক রাখে? সরকারী ব্যাংক রাখে? রাখে কী?
লেখক : সাবেক অধ্যাপক বিআইবিএম
No comments