ডিসনির মেলব্যাগ- দূর দেশেও উজ্জ্বল ফেব্রুয়ারি- অজয় দাশগুপ্ত
ফেব্রুয়ারিকে আমরা ভাষার মাস বলি। কোন্ ভাষার? বাংলা ভাষার মাস হলে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এখন তার ব্যাপ্তি বিশ্বময়। আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘই এখন অবধি সর্বজন, সর্বদেশ, সর্বজাতি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সংস্থা। যুদ্ধবাজ জর্জ বুশ তার ডেপুটি ইংল্যান্ডের ব্লেয়ারের মতো বেহায়ারা এর ধার বা আধিপত্য না মানলেও জাতিসংঘই বিশ্বের ভরসাস্থল। যে কোন বড় দেশ যে কোন আধিপত্যকামী জাতি বা শাসক যেন অন্যের ওপর চড়াও হতে না পারে সে জন্যেই এর জন্ম। দু'দুটো বিশ্বযুদ্ধের করুণ ইতিহাস ও ভয়াবহতার প্রত্যদশর্ীরা জাতিসংঘ গড়েছিলেন, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ যেন অসহায় ও বিপন্নবোধ না করে, যেন পায় স্বস্তি ও নিরাপত্তার স্বাদ। সে জাতিসংঘই ফেব্রুয়ারিকে ভাষার জন্য বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। সময় কথা বলে। সময়ের স্রোত আবর্জনা সরিয়ে যা কিছু সার, যা কিছু পবিত্র তাকে ধারণ করে। আমাদের ভাষা সৈনিকরা জীবন উৎসর্গে যে ইতিহাস রচনা করেছেন আজ তা বিশ্বনন্দিত পৃথিবীর বহু দেশ ও জাতির জন্য প্রেরণার উৎস।অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসও ধোয়া তুলসীপাতা কিছু নয়। বেঁচে থাকা আদিবাসীরা ভাষাগতভাবে মূক। নিজেদের ভাষা হারিয়ে তারা এখন তোতা পাখির মতো ইংরেজী বুলিতে চোস্ত। কিন্তু এর প্রোপট বা সঠিক কারণ জানলে বেদনার অন্ত থাকে না। আগ্রাসন বা আধিপত্য বিস্তারের প্রথম লণ হচ্ছে ভাষা কেড়ে নেয়া অথবা সংস্কৃতি ধ্বংস করা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু লেখায় এই সাবধানতার কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন। একবার তাঁর পিতা ঘরোয়া সভায় তাঁকে একটি চেক উপহার দিয়ে বলেছিলেন, 'দেশের রাজা যখন আমাদের ভাষা বোঝে না, রবির তখন পুরস্কার লাভের কোনই আশা নেই। ফলে এ কাজটি আমাকেই করতে হচ্ছে।' বেদনার্ত রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য ভাষা সাম্প্রদায়িকতা ও ভাষা আগ্রাসনের ভয় কাটানোর জন্য প্রচুর শক্তিময়ী বাণী রেখে গেছেন। তাঁর কথায়, 'ভাষা হারা মম বিজন বেদনা/প্রকাশের তরে করিছে রোদনা'। অভয় দিয়েছেন এই বলে 'দুর্বলেরে রা করো। দুর্জনেরে হানো/নিজেরা দীন, নিঃস্ব হয়ে/যেন কভু না জানো' বাঙালী মানবিক বা মানসিকভাবে দুর্বল কিনা এ তর্ক থাকলেও সম্মিলিত প্রতিরোধে তার ভূমিকা সবল ও উজ্জ্বল। একুশের অর্জনও সে জাতীয় এক উজ্জ্বল ইতিহাস, যা এখন আপন আলোয় বিশ্ব করছে জয়।
ফেব্রুয়ারি তাই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল পেরিয়ে প্রশান্ত পারেও জীবন্ত। এক যুগ ছোঁয়া বই মেলাটিকে গোড়া থেকেই প্রত্য করছি। একক চেষ্টায় বলতে গেলে বইপ্রেমী এক বাঙালী নেহাল নেয়ামুল বারীর উদ্যোগ ও স্থানীয় বাঙালীর সমর্থনেই এর শুরু। গোটা দুই মণ্ডপ বা স্টল। অনেকেই ভেবেছেন শুরুতেই সমাপ্তি টানতে হবে। একে বিদেশ বিভূঁই, তার ওপর বসতিও মাত্র অল্পকালের। অস্ট্রেলিয়া এমনিতেই নিঃসঙ্গ এক দেশ। সমুদ্রবেষ্টিত বলে লাগোয়া কোন প্রতিবেশী নেই। আমাদের যেমন পা ফেললে ভারত, নৌকায় চড়লে মিয়ানমার বা কাছে-দূরে অনেক রাষ্ট্র, এখানে তেমনটি নয়। ফলে সিডনিভিত্তিক বাঙালীই ভরসা। অন্য রাজ্যগুলো এত দূরে যে ইচ্ছে থাকলেও বাঙালীদের প েআসাটা সম্ভব বা যৌক্তিক হয়ে ওঠে না। তাই ভয় ছিল ফেব্রুয়ারির সিডনি বইমেলাটি দাঁড়াবে তো!
'সময় বহিয়া যায়' বাঙালী বাড়ে বসবাসে, সচ্ছলতায়, জীবনাচরণে প্রতিষ্ঠা পায় আমাদের জাতিসত্তা। বইমেলাটিও পল্লবিত। গাছে ফুল ধরলে মৌমাছি যেমন আসে, তেমনি পোকাও। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা, স্বার্থপরতা, ব্যক্তিত্বের লড়াই_ তারপরও বইমেলা বহমান। চাহিদা দাঁড়াল স্থায়ী কিছু করার। বইমেলাটির নামেও এলো পরিবর্তন। যদিও গবেষণা বা তথ্যসমৃদ্ধ হবার মতো কাজ চোখে পড়ে না, তবু এর নাম এখন একুশে একাডেমী। প্রবাসী বাঙালী দেশজ ঐতিহ্য আর অতীতের প্রতি অনুগত থাকতে গিয়ে প্রায়শই স্পর্শকাতর আর বল্গাহীন হয়ে পড়ে। দেশপ্রেমের অন্ধত্ব তাই কোনকালেই সমর্থন পায়নি। দেশাত্মবোধ উগ্র হলে জাতীয়তাবোধের সঙ্কীর্ণতাও মাথাচাড়া দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এর প্রভাব কোন সময়ই সুখকর ছিল না। উগ্রতা এড়িয়ে, আতিশয্য এড়িয়ে, সীমাবদ্ধতা মেনে চললে এত তাড়াতাড়ি একাডেমী হবার কারণও হয়ত ঘটত না। তবু এটাই বাস্তবতা। এই একাডেমীর সবচেয়ে চমক লাগানো কাজটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সে এক ধুন্দুমার সময়। অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত তখনকার হাই কমিশনার আশরাফ উদ দৌলাও ছিলেন পুরোভাগে। জোট সরকারের জবরদস্তি জামায়াতপ্রীতি আর বাঙালী রুচির বিরুদ্ধতায় দেশের মতো প্রবাসেও গড়ে উঠেছিল বিুব্ধ জনমত। একাডেমী অর্থাৎ স্থানীয় বইমেলার মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ স্থাপনের বিষয়টি তাই অবিমিশ্র আনন্দদায়ক ছিল না। নক্শা স্থাপনা, জোট সরকারের অনুদান নেয়া-না নেয়া_ সরকারী হস্তপে সব মিলিয়ে বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। কিন্তু তখনকার সভাপতি, সম্পাদক ও পরিষদের ঐকান্তিক চেষ্টা আর বইপ্রেমী মানুষের সমর্থনে বিরোধিতা টেকেনি। সব বাধা উজিয়ে স্থানীয় এ্যাশফিল্ড পার্কে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ। ফেব্রুয়ারির আরেক বিস্তৃতি। একাত্তরে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম না হলে বাংলাদেশ হতো না। আর বাংলাদেশ না হলে একুশে থাকত না। অভ্রভেদী শহীদ মিনার ও তার দু্যতি অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পেঁৗছতে পারত না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা'। সে ধ্রুবতারা যদি বাংলাদেশ হয় তো তার আকাশ আমার জনক, জাতির জনকের মুখ। ফেব্রুয়ারির এই আন্তর্জাতিক অর্জনও মূলত তাঁরই দান। এ লেখাটি যেদিন বেরুবে আমি তখন সিডনি থেকে অনেক দূরে। নীল আকাশে ডানা মেলা উড্ডীন বিহঙ্গের জানালা থেকে প্রণতি জানাই, হে স্মৃতিসৌধ, দুনিয়া জোড়া ভাষাবঞ্চিত, ভাষাহারা, ভাষার বিপাকে থাকা মানুষকে শক্তি যোগাও। জয় হোক একুশের, জয় হোক ফেব্রুয়ারির।
ফধংমঁঢ়ঃধধলড়ু@যড়ঃসধরষ.পড়স
No comments