নারী ও শিশু ধর্ষণ ॥ এর শেষ কোথায়?
নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার মাত্রা যে দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে; গত পনেরো দিনের জাতীয় দৈনিকগুলোর চিত্র থেকে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। শুধু ধর্ষণ ও নির্যাতন করাই নয়, নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করার ঘটনাও ঘটছে।
অহরহ তা না ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরম নির্যাতনের ফলে নির্যাতিতকে মানসিক ভারসাম্য হারাতেও হচ্ছে। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে গণধর্ষণের ঘটনায় কয়েকদিন আগেও ভারত ছিল উত্তাল। এরপরও ভারতে থেমে থাকেনি ধর্ষণ ও নির্যাতন। দিল্লীর পর রাজস্থানে- পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনা। শুধু প্রতিবেশী দেশ ভারতেই নয়, আমাদের দেশেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে আশঙ্কাজনক হারে।টাঙ্গাইলের মধুপুরের এক স্কুলছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়। গত ৬ ডিসেম্বর মেয়েটিকে তার বান্ধবীর সহায়তায় আটক করা হয়। টানা তিনদিন নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের পর ধর্ষকরা রেললাইনের পাশে ফেলে যায় মেয়েটিকে। ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের ফলে শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের শিকারই হয়নি, মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলে সে। ঘটনার ২২ দিন পর ওই স্কুলছাত্রীর চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসাধীন মেয়েটি।
৭ জানুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে ১০ বছরের শিশু চাঁদনী ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটে। মুন্সীগঞ্জে ৭ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকার পাতায় ছাপা হয় ৭ জানুয়ারি। সাভারে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ধারণের অভিযোগ পাওয়া যায় গত ৫ জানুয়ারি। নীলফামারীতে বিয়েবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় এক কিশোরীকে। ১২ জানুয়ারি শুক্রবার রাতে বিয়েবাড়িতে ওই ঘটনা ঘটে। ১৪ জানুয়ারি লালমনিরহাটে ধর্ষণের শিকার হয় আরেক শিশু। লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামের ডাউকিপাড়া গ্রামের ৭ বছরের শিশুও নির্মম ঘটনার শিকার হয়। এ তো গেল কয়েকটি ঘটনার খবরমাত্র। প্রতিদিন এ রকম অসংখ্য ঘটনার কথা পত্রিকা মারফত জানতে পারি আমরা। এ সকল ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে পালিত হয় মানববন্ধন ও প্রতিবাদসভা। দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়ত এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নরপশুদের নগ্ন ছোবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক তরুণী ও শিশু। সম্প্রতি দেশে যে হারে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই আমাদের সমাজে আর নিরাপদ নয়। এ সকল ঘটনা থেকে এখন তাই শুধু মনে হয়। নারী ও শিশুর প্রতি পুরুষের আচরণ কখন সহিংসতায় রূপ নেবে তা কিছুতেই বলার উপায় নেই।
নারী ও শিশু নির্যাতন কমছে না বরং দিন দিন বাড়ছে। গত এক বছরের নির্যাতনের ঘটনা থেকেই তা বোঝা যায়। ধর্ষণের পর হত্যা ও লাশ গুম করার মতো ঘটনাও এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতেই শেষ নয়। নির্যাতিতের পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে তাকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। জোরপূর্বক আপত্তিকর ছবি তোলা হচ্ছে। মোবাইল ও ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করা হচ্ছে ধর্ষণের চিত্র। এ রকম অজস্র ঘটনায় অজস্র পুরুষ প্রতিদিন শতশত শিশু-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সী নারীর ওপর নির্যাতন চলছে। ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে, পরিবহনে দিন দিন বেড়েই চলছে নারী নির্যাতন ও সহিংসতা। এসব ঘটনার খুব অল্পই হয় সংবাদ শিরোণাম। তার চেয়েও কম পরিমাণে হয় অভিযোগের মামলা। আর বিচার বা দ-ের খবর প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে। অন্য সকল অপরাধের মামলার শুনানি কিংবা অগ্রগতির কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ এসব মামলার কোন অগ্রগতি হয় না। এসব ঘটনা আমাদের সমাজে সহানুভূতি পায় না। নির্যাতকের দল এসব জানে বলে এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলছে দিনকে দিন। নির্যাতিতরা সম্মানহানির ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে এ সকল ঘটনা প্রকাশ করে না। টাঙ্গাইলে নির্যাতনের শিকার ঐ মেয়েটির পরিবারও তাই করেছে। নির্যাতনের বেশ কয়েকদিন পর তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি চিকিৎসকদের কাছেও প্রথমে তার দুর্ভোগের আসল কারণ গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়। অবশেষে চিকিৎসার স্বার্থে চিকিৎসকদের প্রকৃত ঘটনা জানানো হয়।
আমাদের সমাজে নির্যাতিতরা প্রতিবাদ করতেও সাহস পান না। বরং তথাকথিত লোকলজ্জা ও সম্মানহানির কথা ভেবে তারা ন্যায্যবিচার চাইতেও ভয় পান। এহেন চিন্তা ও মানসিকতার ফলেই অনেক অপরাধী শাস্তি কিংবা বিচারের আওতার বাইরে থেকে যায়। ফলে বিচার না হওয়া কিংবা শাস্তি না পাওয়ার দরুন এ ধরনের অপরাধকে আরও উৎসাহিত করা হচ্ছে। নির্যাতিত নারীর প্রতি সহানুভূতির অভাব এবং প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগীয় শিথিলতা নারীকে আরও অনিরাপদ ও ধর্ষণের হুমকিতে রাখে। পাশাপাশি পুরুষবান্ধব সামাজিক বিধিবিধান ও শাসনব্যবস্থাও এক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী বলা যায়। (চলবে)
সাবিনা ইয়াসমিন
No comments