রাজকুমারী রাত কাটাবেন চরের কুঁড়েঘরে- গাইবান্ধায় ব্যাপক কৌতূহল by আবু জাফর সাবু

ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী বালুময় রুক্ষ্ম, ধূসর চরাঞ্চলের কুঁড়েঘরে গ্রামীণ পরিবেশে জ্যোৎস্নাস্নাত দু'টি রাত কাটাতে থাইল্যান্ড থেকে উড়ে আসছেন সেদেশের রাজকুমারী মাহা চাকরি সিরিনধর্নও।
একটি দাতা সংস্থার উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হিসেবে গাইবান্ধার গ্রামগঞ্জে জীবিতা বাংলাদেশ নামের একটি সংস্থায় বাসত্মবায়িত প্রকল্প পরিদর্শন করতেই মূলত তার আসা। সেই সঙ্গে নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের কুঁড়েঘরে রাতযাপনের লালিত স্বপ্ন বাসত্মবায়নেই থাই রাজকুমারী এই প্রত্যনত্ম গ্রামে রাত কাটাবেন। সে জন্য গাইবান্ধা জেলা শহরের ৮ কি: মি: পূর্বে ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসীঘাট সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপারে বালুকাময় একটি চরে নতুন আঙ্গিকে বিশেষভাবে কুঁড়েঘর বেষ্টিত একটি পরিকল্পিত সুদৃশ্য গ্রাম তৈরি করা হয়েছে। ঘোড়ার খুরাকৃতির স্বপ্নময় এই গ্রামে ছনের চালা ও বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে স্বল্প পরিসরে বসবাসের জন্য ৩৫টি কুঁড়েঘর। এই কুঁড়েঘরগুলোর মাঝামাঝি রয়েছে গোলাকৃতির একটি বৈঠকখানা ঘর। এর পাশে পিঠাঘর সেই সঙ্গে রয়েছে গোয়াল ঘর। প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর দু'মাস খেটে ঢাকার সিনঅফসিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান অত্যনত্ম সুপরিকল্পিতভাবে ছনের খর এবং বাঁশ দিয়ে এসব ঘরগুলো নির্মাণ করেছে। প্রতিটি ঘরেই রয়েছে বাঁশের তৈরি ড্রেসিং টেবিল এবং খাট। বারান্দায় পাতা হয়েছে খেজুর পাতার তৈরি নকশি পাঠি। ঘরের সম্মুখের বারান্দাজুড়েই টাঙ্গানো হারিকেন এবং পাটের তৈরি নকশি সিকায় ঝুলানো রয়েছে নানা গ্রামীণ কারম্ন শিল্প। গোটা গ্রামটি জুড়েই বালুর ওপর পলিমাটি কেটে এনে বসানো হয়েছে এবং সেই মাটিতে ঘাসের আসত্মরণে সুদৃশ্য ফুলের বাগানও নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় গ্রামীণ পরিবেশ বজায় রাখতে বাঁশের জাংলায় লাউ শিমের গাছ ও সরিষাসহ বিভিন্ন সবজি তেও সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে। রাজকুমারী এবং তার সফর সঙ্গীদের বসবাসের উপযোগী করে নির্মিত প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই সংযুক্ত রয়েছে টয়লেট এবং বেসিন। বরিশাল, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকার কুঠির শিল্পের কারিগররা ছবির মতো এই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছে।
রাজকুমারীর বাসযোগ্য এই গ্রাম নির্মাণ করতে সময় লেগেছে প্রায় দু'মাস। স্থানীয় চাষীদের কাছ থেকে এজন্য ৩০ বিঘা জমি লিজ নেয়া হয়েছে। এই গ্রামে বিদু্যত সরবরাহের জন্য ২৫ মেগাওয়াট মতাসম্পন্ন একটি জেনারেটর বসানো হয়েছে। এর পাশাপাশি সৌর বিদু্যত সরবরাহেরও ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে কখনই বিদু্যত সরবরাহ বিঘি্নত না হয়। আর এ নিয়ে এ অঞ্চলে ব্যাপক উৎসাহ ও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্নুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেল্থ এর হেল্থ উপদেষ্টা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়টির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত জীবিতা বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গাইবান্ধা ও রংপুর জেলার ১৯ টি ইউনিয়নে ১৯৯৯ সাল থেকে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি বিষয়ক একটি গবেষণা প্রকল্প বাসত্মবায়ন করছে। এই প্রকল্পের আওতায় কিভাবে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নতি এবং তাদের মৃতু্যর হার কমানো যায় সেই উপায় খুঁজে বের করাই এই গবেষণা প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য। জীবিতা বাংলাদেশের এই প্রকল্পটি ২০০৭ সালে সমাপ্ত হয় এবং প্রকল্পের গবেষণায় দেখা যায় যে, জন্মের পরপরই শিশুকে ১ ডোজ ভিটামিন (৫০,০০০ আই ইউ) খাওয়ালে ৬ মাস বয়স পর্যনত্ম শতকরা ১৫ ভাগ কমে যায়।
এই প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্নুুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্যবৃন্দ ৫ দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন ১৫ ফেব্রম্নয়ারি। এই উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্যবৃন্দ প্রকল্প কার্যক্রম পরিদর্শনের পাশাপাশি বাংলদেশের গ্রামীণ জীবন দেখতে এবং মা ও শিশুদের সম্পর্কে জানতে বিশেষভাবে আগ্রহী। থাইল্যান্ডের রাজকুমারী মহা চাকরি সিরিনধর্নও এই হেলথ এডভাইজরি বোর্ডের অন্যতম সদস্য হিসেবেই এই পরিদর্শনে আসছেন। এছাড়া রাজকুমারী অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, জীবিতা প্রকল্পটি পরিদর্শন এবং চরাঞ্চলের রাত যাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছিলেন। রাজকুমারী স্বপ্নপূরণেই ওই দাতা সংস্থার প থেকে এই চরাঞ্চলে বসবাসের সমসত্ম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
জীবিতা বাংলাদেশ গাইবান্ধা'র প থেকে জানানো হয়েছে, ৩০ সদস্য বিশিষ্ট এই উপদেষ্টা দলের সঙ্গে থাই রাজকুমারী ঢাকা থেকে ১৬ ফেব্রম্নয়ারি রংপুরে আসবেন। সেখানকার পীরগঞ্জ এবং তাজহাটের মাহিগঞ্জ এলাকার প্রকল্পসমূহ পরিদর্শন শেষে রংপুর থেকে সড়কপথে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা, সদর উপজেলার কুপতলা গ্রামের প্রকল্প পরিদর্শন শেষে বালাসীঘাটের সেই চরাঞ্চলে রাত যাপন করবেন। নদীর পার থেকে নৌকায় তাকে সেই চরে পৌঁছানো হবে। পরদিন ১৭ ফেব্রম্নয়ারি গাইবান্ধার সার্কিট হাউসে তিনি এবং উপদেষ্টা বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরা একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগদান এবং বিভিন্ন এলাকায় প্রকল্প পরিদর্শন করবেন। পরে ১৭ ফেব্রম্নয়ারি রাতেও তিনি চরে অবস্থান করবেন। চরের ওই বিশেষ গ্রামটির পিঠাঘরে স্থানীয় গ্রামীণ নারীরা তাদের তৈরি নানা নকশি পিঠা সেখানে তৈরি করবেন এবং রাজকুমারী ও তার সফর সঙ্গীদের খাওয়াবেন। গোয়ালঘরে রাখা হবে দুধেল গাই। সেখানে গরম্নর দুধ দোয়ানো রাজকুমারী প্রত্য করবেন এবং সেই দুধ জ্বাল দিয়ে তা পরিবেশন করা হবে। আর সুদৃশ্য বৈঠকখানা ঘরে রাজকুমারী গ্রামের নারী ও শিশুদের কথা শুনবেন।
এর আগে থাই রাজকুমারী মাহা নেপাল সফরকালে প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকনের জন্য তাঁবুতে রাত যাপন করেছিলেন। উলেস্নখ্য, তিনি থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল ও রানী সিরিকিটের ২য় কন্যা ও তৃতীয় সসত্মান। রাজকন্যা মাহার জন্ম ১৯৫৫ সালের ২ এপ্রিল ব্যাংককে। তিনি এখনও বিয়ে করেননি।
থাইল্যান্ডের রানীর গাইবান্ধা আগমন উপল েইতোপূর্বে থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও গাইবান্ধার বালাসীঘাটে এ এলাকাটি পরিদর্শন করে গেছেন। রানীর আগমন উপল েচরাঞ্চলে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.