২০১২-এর জ্বালানি খাতের শীর্ষ পাঁচ কাহিনী by এনামুল হক

২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি খাতে একটা বড় ধরনের লড়াই হয়ে গেছে ট্রান্সকানাডা কীস্টোন এক্সএল পাইপলাইন নিয়ে। সেই লড়াইয়ের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হলো নেক্সাস্কার ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্র যার মধ্যে কোর্ট নিওব্রারা ন্যাশনাল ওয়াইল্ড লাইফ রিফিউজ বা অভয়ারণ্যের তৃণভূমিতে বিচরণরত বাইসন এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে।
তেল কোম্পানি ট্রান্সকানাডা ১৭০০ মাইল দীর্ঘ এই পাইপলাইন কানাডার এলবার্টা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেক্সাস্কা হয়ে টেক্সাসের তেল শোধনাগারগুলোতে নেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। এর মাধ্যমে কানাডার অয়েল স্যান্ড থেকে আহৃত অশোধিত তেল যুক্তরাষ্ট্রের শোধনাগারগুলোতে নিয়ে পরিশোধন করার কথা। কিন্তু মাঝখানে স্যান্ডহিল্্স নামে নেক্সাস্কার ১৯৬০০ বর্গমাইলের এক অনন্য ইকোসিস্টেম পড়ে গেছে। এই ইকোসিস্টেম নিয়ে উদ্বেগকে কেন্দ্র করে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি হয় যে কারণে ওবামা প্রশাসন প্রস্তাবিত পাইপলাইনের রুটটি বন্ধ করে দেয়। ট্রান্সকাডানা তখন সংশোধিত পরিকল্পনা পেশ করে। ওয়াশিংটন এই পরিকল্পনার ওপর সিদ্ধান্ত নেবে ২০১৩ সালের প্রথম দিকে। তবে ঐ পাইপলাইন যে আপাতত বন্ধ হয়ে আছে সেটাই পরিবেশবাদী ও অন্যদের প্রতিরোধের এক উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
পরিবেশবাদীদের বক্তব্য হলো এই পাইপলাইনের কারণে বন্যপ্রাণী বিশেষত বাইসনরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের আরও আশঙ্কা কার্বনঘন অয়েল স্যান্ড থেকে আহৃত তেল নিয়ে। এই তেল পরিশোধনের কারণে বায়ুম-লে আরও বেশি মাত্রার কার্বন গিয়ে মিশবে। নেক্সাস্কার বাইসন ও অন্যান্য প্রাণীকুল বিপন্ন হওয়া ছাড়াও স্যান্ড হিনসের নিচে ওগাল্লায়ালা এ্যাকুইফারও ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা আছে। এই এ্যাকুইফার থেকে নেক্সাস্কা ও আরও ৭ রাজ্যের ২০ লাখ লোককে খাবার পানি জোগানো হয়। এসব কারণে নেক্সাস্কার বাইসন ও এ্যাকুইফারকে রক্ষার প্রয়োজনে পাইপলাইনের বিরুদ্ধে চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বের আরেক প্রান্তেও এ জাতীয় আরেক ঘটনা লক্ষ করা যেতে পারে। সেটা হলো মালয়েশিয়ার সাবাহ। এ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্থান এই সাবাহতে কয়লাচালিত একটি বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এমন বিদ্যুতকেন্দ্রের কারণে গুরুতর রূপে বিপন্ন প্রজাতি সুমাত্রার গ-ার ও প্রবাল প্রাচীর হুমকির সম্মুখীন হতে পারে ভেবেই কয়লাচালিত একটি বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়েছে। তাহলে সাবাহ অঞ্চলের যে বিদ্যুতের চাহিদা সেটা পূরণ হবে কি দিয়ে? স্বল্প মেয়াদী চাহিদা মেটানোর জন্য তাই নেয়া হয়েছে ৩শ’ মেগাওয়াটের প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র যা কয়লার তুলনায় অনেক বিশুদ্ধতর বিকল্প। পরিবেশবাদীরা আশা করেন ভবিষ্যতে সাবাহতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসব খুঁজে পাওয়া যাবে।

উন্নয়নশীল বিশ্বের জ্বালানি সমাধান
উন্নয়নশীল বিশ্বে এখন সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার উত্তরোত্তর বাড়ছে। আফ্রিকার বেনিনে সোলার প্যানেল বসিয়ে সেচপাম্প চালানো হচ্ছে। সোলার ইলেকট্রিক লাইট ফাণ্ড বা সংক্ষেপে সেলফ নামে একটি প্রকল্প আছে, যার লক্ষ্যই হলো গ্রামাঞ্চলে পানি, বিদ্যুত ও আশা পৌঁছে দেয়া। বেনিনের গ্রামাঞ্চল সেই প্রকল্পের একটি ক্ষেত্র। যেসব উষর অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি ও অপুষ্টি একটানা লেগেই আছে, সেখানে সৌরশক্তিচালিত সেচপাম্প দিয়ে পানি তুলে ফসল ফলানো হচ্ছে।
বিশ্বের ১৬০ কোটি মানুষ বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য সরবরাহের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এদেরকে বিশুদ্ধ জ্বালানি পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে যে অসংখ্য প্রকল্পের কাজ চলছে সেলফ প্রকল্পটি তার অন্যতম। জাতিসংঘ ২০১২ সালকে সকলের জন্য টেকসই জ্বালানির বছর হিসেবে ঘোষণা করে এ সমস্যার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে।
জ্বালানি সমস্যার অতি ক্ষুদ্র পরিসরের সমাধান আছে যা থেকে বিপুল সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। যেমন একটি হলো অতি সহজ সাধারণ সোলার ল্যাম্প বা সৌর লণ্ঠন। দাম পড়বে ১০ থেকে ২০ ডলার। উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্ধকার ঘরগুলো এ দিয়ে আলোকিত হবে।
সেলফের বেনিন সেচ প্রকল্পে আর্থিক সাহায্য যোগাচ্ছে গ্রেট এনার্জি চ্যালেঞ্জ নামে একটি সংস্থা। এই সংস্থা কোস্টারিকা থেকে ভারত ও ওয়াশিংটন ডিসি পর্যন্ত সারা বিশ্বে জ্বালানি সমস্যার অন্যান্য উদ্ভাবনীমূলক সমাধানে অর্থ জোগাচ্ছে।
কি ধরনের উদ্ভাবনীমূলক সমাধান? সেটা দেখার জন্য যেতে হবে কলম্বিয়া।

মেডেলিনের কেবল কার
কলম্বিয়ার মেডেলিনের নতুন আকাশ ট্রামওয়েকে যত না শহরের পরিবহন ব্যবস্থার মতো দেখাবে তার চেয়ে বেশি মনে হবে স্কী লিফটের মতো। সারা বিশ্বের নগরীগুলোতে জ্বালানিকে উদ্ভাবনীমূলক কাজে ব্যবহারের সৃজনশীল কৌশল হিসেবে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে তার মধ্যে এই প্রকল্পটি অন্যতম। পাহাড়ী এলাকায় আঁকাবাঁকা পথে এবং স্বল্প আয়ের জনপদে চলা ট্রাম কার ইনস্টিটিউট ফর ট্রান্সপোর্টেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পলিসির (আইটিডিপি) টেকসই পরিবহন পুরস্কার পেয়েছে।
অন্যান্য নগরীতে ড্রাইভাররা যানজট লাগব এবং গাড়ির মালিকানার আর্থিক বোঝা কমানোর জন্য কার শেয়ারিং ব্যবস্থা করেছে। সিঙ্গাপুর ও ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যামফোর্ডের মতো জায়গায় যানজট এড়িয়ে চলতে ড্রাইভারদের সামনে নগদ পুরস্কারের টোপ ফেলা হয়েছে।
সব নগরীতেই আজ যানজট একটা সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সেই সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের প্রকল্পও নেয়া হয়েছে। আবার এমনও প্রকল্প আছে যেগুলোর দৃষ্টি রাস্তার নিচে। সেসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যতিক্রমী ধরনের জ্বালানি উৎসকে কাজে লাগানো। যেমন স্নান করা, থালা-বাসন ধোয়া ও কাপড় কাঁচা এবং আরও নানা কাজে ব্যবহৃত যে গরম পানি প্রতিবছর নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে যায়। কোন কোন হিসাব থেকে দেখা গেছে, আমেরিকায় বর্জ্য পানির মধ্যে যে শক্তি লুকিয়ে আছে তা দিয়ে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের ৩ কোটি বাড়িঘরে বিদ্যুত শক্তি জোগানো যেতে পারে। ইতোমধ্যে ভ্যাঙ্কুভার ও শিকাগোয় কিছু কিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যার লক্ষ্য হলো তাপ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সম্পদটি আহরণ করা ও কাজে লাগানো।

কার্বনের জন্য মাসুল
ক্যালিফোর্নিয়ার রেডিওতে একটি তেল শোধনাগার আছে। এমনি শোধনাগার তো বিশ্বের আরও কত জায়গাতেই রয়েছে। এই তেল শোধনাগারের কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এখন এগুলোর পরিবেশ দূষণের মাসুল পরিশোধনের সময় এসে গেছে। গত নবেম্বরে অনলাইনে নিলাম করে ক্যালিফোর্নিয়া তার নিজস্ব ক্যাপ এন্ড ট্রেড সিস্টেম চালু করেছে যার লক্ষ্য হচ্ছে আগামী আট বছর ধরে কার্বনডাই অক্সাইডের নির্গমন ২০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা। আশা করা হচ্ছে যে কার্বন হ্রাসের এই মডেলটি যুক্তরাষ্ট্র তথা গোটা বিশ্বে ব্যাপক পরিসরে কাজে লাগানো হবে। এ বছরের প্রথম দিকে অস্ট্রেলিয়া কার্বন ট্যাক্সের তার নিজস্ব সংস্করণ চালু করেছে। কয়লানির্ভর অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে বিশ্বের সেইসব দেশের অন্যতম, যার অর্থনীতি সর্বাধিক কার্বন নিবিড়। অর্থাৎ দেশটি এমন জ্বালানি ব্যবহার করে, যা থেকে সর্বাধিক মাত্রায় কার্বন নির্গত হয়। তবে দেশটাতে ঘন ঘন খরা ও দাবানল ঘটছে এবং পর্যটকদের আকর্ষণ গ্রেট ব্যারিয়ার রীফের অবক্ষয় ঘটেছে বলে আবহাওয়া পরিবর্তনঘটিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো নিয়ে অস্ট্রেলিয়াবাসী দারুণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। তাই তারা কার্বন নির্গমন কমাতে ব্যগ্র হয়ে পড়েছে।

উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যের দ্বীপ
ব্রিটেনের একটি দ্বীপের নাম আইল অব ওয়াইট। এটিকে এখন উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যের দ্বীপ আখ্যায়িত করা যেতে পারে। কারণ এই দ্বীপটি ঝঞ্ঝাময়। এর বায়ুর গতি তীব্র। সেজন্য অনেক কোম্পানি এর বায়ুশক্তিকে কাজে লাগাতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছে। বাতাসের মধ্যে যে শক্তি লুকিয়ে আছে নাবিকরা তা অনেক আগেই ব্যবহার করে আসছে। এখন ইকোআইল্যান্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই দ্বীপকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন, মজুদ ও সরবরাহের একটি আদর্শ দ্বীপে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
ইকোআইল্যান্ড প্রকল্পে ৭০টিরও বেশি কর্পোরেট স্পন্সর পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, ভিক্টোরিয়ান যুগের অবকাশ বিনোদন কেন্দ্র আইল অব ওয়াইটকে ২০২০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা। ওই সময়ের মধ্যে দ্বীপটি গ্রীন এনার্জিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। ইকোআইল্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেভিড গ্রীন বলেন, দ্বীপটি হবে একটা জীবন্ত ল্যাবরেটরি। গ্রীন সমুদ্রচারী নাবিকদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। যারা একটানা কয়েক সপ্তাহ ও কয়েক মাস জাহাজের বুকে কাটিয়ে দিত এবং এই দীর্ঘসময় ধরে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকার কৌশল উদ্ভাবন করেছিল। গ্রীন জানান, সবকিছু পরিকল্পনামতো চললে এই দ্বীপের বিদ্যুত সৌর, তরঙ্গ, বায়ু ও ভূগর্ভস্থ তাপের দ্বারা উৎপাদিত হবে। খাদ্য ও পানি সরবরাহের টেকসই ব্যবস্থাও থাকবে।
বিশ্বব্যাপী আরও অসংখ্য দ্বীপে এই জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে অথবা পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেমন উত্তর সাগরে ডেনমার্কের সামসো দ্বীপ ইতোমধ্যে জ্বালানি শক্তিতে এত স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে যে, উদ্বৃত্ত বিদ্যুত মূল ভূখ-কেও জোগাতে পারছে।

No comments

Powered by Blogger.