ঢাকায় লারা- ‘ক্রিকেটের কোনো সংস্করণই হারিয়ে যাবে না’

কোচ খালেদ মাহমুদ ঢুকলেন সংবাদ সম্মেলন কক্ষে, একটু পর অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, নাঈম-আফতাব-মার্শালরা। রবি বোপারা, ব্রেন্ডন টেলর, কেভন কুপার, জেসন রয়রাও এলেন। কিন্তু এক মহাতারকার জ্যোতিতে ম্লান ওই সব তারা।
তিনি ঢুকতেই হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি। ক্যামেরার শাটারে চাপ পড়ছে ক্রমাগত। চিটাগং কিংসের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলালেন তিনি, একেকজনের চোখে-মুখে সে কী মুগ্ধতা! এই মহাতারকার নাম—ব্রায়ান চার্লস লারা! সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়ক হিসাবে। বাংলাদেশ তখন টেস্ট স্ট্যাটাসও পায়নি! ১৯৯৮ সালের আইসিসি নকআউট বিশ্বকাপ, ১৯৯৯ সালে দুই ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ—এই ছিল লারার বাংলাদেশ-অধ্যায়। এবার এলেন চিটাগং কিংসের শুভেচ্ছা দূত হয়ে। কিংসের লোগো ও জার্সি উন্মোচন অনুষ্ঠানে মূল আকর্ষণও ছিলেন তিনিই। লারার সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য বিপিএল থাকল সামান্যই, তা ছড়িয়ে গেল ক্রিকেটের অনেক দিকে

বিপিএলে আগ্রহের কারণ
ব্রায়ান লারা: ফ্র্যাঞ্চাইজি দলের এই উদ্ভাবনটাই আমার খুব ভালো লাগে। আমার ধারণা, খেলাটার ওপর ক্রিকেট বোর্ডগুলোর নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয় এটা। ফুটবলে দেখুন, বেশির ভাগ দলই ব্যক্তিমালিকানাধীন। ক্রিকেটার, মালিকদের মোটা অঙ্কের অর্থের উৎস এটা। অনেক দর্শক হয়, এটাও বড় একটা সুফল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় এটা। আশা করি, তৃণমূল পর্যায় থেকে অনেক ক্রিকেটার উঠে আসবে এখানে। ক্যারিবিয়ানে আমরা টিনএজারদের ক্রিকেটে সেভাবে টানতে পারছি না। এ জন্যই আমাদের নিজস্ব টি-টোয়েন্টি লিগ চালু করতে যাচ্ছি আমরা।
জিম্বাবুয়েতে খেলার পর বিপিএলে দূতের ভূমিকা
লারা: সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে খেলাটাকেও কিছু ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। (২০১০ সালে) আমি জিম্বাবুয়েতে গিয়েছিলাম ওদের খেলার মানে উন্নতিতে সাহায্য করতে। ওদের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগে খেলেছিলামও। পুরো ব্যাপারটাই আসলে খেলায় ফিরতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। সম্প্রতি ভিভ রিচার্ডসকে আপনারা দেখেছেন অস্ট্রেলিয়ায় (বিগ ব্যাশে মেলবোর্ন স্টার্সের পরামর্শক)। আরও অনেকেই এসব করছে। আমারও ভালো লাগছে এমন কিছু করতে। তরুণ ক্রিকেটারদের সাহায্য করতে পারা, সত্যিকার অর্থেই প্রয়োজন এমন একটা দলের পাশে থাকতে পারাটাই আমাকে অনেক তৃপ্তি দেয়।
ওয়ানডের ভবিষ্যৎ হুমকিতে কি না
লারা: ওয়ানডের জনপ্রিয়তা বাড়ার সময়ও লোকে ভেবেছিল, টেস্ট ক্রিকেট খুব বেশি দিন টিকবে না। এসব কথা হবেই। টি-টোয়েন্টি দারুণ একটা উদ্ভাবন। ক্রিকেট খেলাটাকেই একসময় মনে হচ্ছিল যেন দিশাহীন। অর্থহীন অনেক টেস্ট সিরিজ। মাত্রই ক্যারিবিয়ান থেকে এলাম আমি, যেখানে গত সপ্তাহেই এক ম্যাচে ২০ হাজারের মতো লোক হয়েছে (ক্যারিবিয়ান টি-টোয়েন্টিতে)। ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর হয়ে এত দর্শকের সামনে খেলার কথা আমি ভাবতেও পারতাম না। শুধু মনে রাখবেন, আমরা সবাই বিনোদনদানকারী। একটা নতুন সংস্করণ যদি এত দর্শক মাঠে আনে, সমস্যাটা কোথায়! কর্তাব্যক্তিদের উচিত টেস্ট ও ওয়ানডেকেও আরও আকর্ষণীয় করা। আমার আশা, কোনো সংস্করণের ক্রিকেটই হারিয়ে যাবে না। তিনটিই একসঙ্গে চলতে পারে। টেস্ট ক্রিকেট অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ওয়ানডেও অনেক রোমাঞ্চকর।
শচীন টেন্ডুলকারের অবসর প্রসঙ্গে
লারা: কখন অবসর নেবে, সিদ্ধান্তটা শচীনের নিজেরই। ওর সিদ্ধান্তটাকেই আমাদের সবার সম্মান করা উচিত। আমি নিশ্চিত, শচীন মাথা উঁচু করেই বিদায় নিতে চাইবে। অবসরের ব্যাপারটা ওর ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। টি-টোয়েন্টি অনেক দিন ধরেই খেলছে না, এখন ওয়ানডেও ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো এটা টেস্ট ক্রিকেটে ওকে বাড়তি একটা প্রেরণা জোগাবে। ও জানে, শেষ খুব কাছেই। সবাই চায়, মাথা উঁচু করে বিদায় নিতে।
সমবয়সী শেন ওয়ার্নকে (৪৩ বছর বয়স) বিগ ব্যাশ খেলতে দেখে নিজেরও খেলতে ইচ্ছা হয় কি না
লারা: আমার মনে হয় না, এখনো খেলতে পারি। খেলাটা থেকে দূরে আছি প্রায় ছয় বছর। এখন আমার ভূমিকা তরুণদের দিকনির্দেশনা দেওয়া। কোর্টনি ওয়ালশ ও ম্যালকম মার্শালদের সঙ্গে খেলেছি, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সাবেক অধিনায়ক ও ক্রিকেটার হিসেবে মনে করি আমার যা অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান, এখন তরুণদের সহায়তা করাই আমার কাজ হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ক্রিকেট সঠিক পথে আছে কি না
লারা: অবশ্যই, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাফল্যই এটা অনেকটা প্রমাণ করে। শেষ ম্যাচে ওভাবে সিরিজ জয় ফুটিয়ে তুলেছে দলের চরিত্র। তবে দেশের বাইরে বাংলাদেশকে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে দেখলে ভালো লাগবে আমার। আমি যত দূর জানি ও বুঝি, বাংলাদেশ দল সঠিক পথেই আছে।
টি-টোয়েন্টি টেস্টে বাজে প্রভাব ফেলবে কি না
লারা: আমার তো মনে হয়, শুধু ইতিবাচক প্রভাবই ফেলবে। লোকে যেমন আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, আমার রেকর্ড (৪০০*) ভাঙবে কি না? আমার ধারণা, অবশ্যই ভাঙবে। দু-একজন ব্যাটসম্যানের দিকে তাকান—অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার, ক্রিস গেইল বা বীরেন্দর শেবাগদের কাছে রেকর্ডটা সব সময়ই হুমকিতে আছে। টি-টোয়েন্টির কারণে রান তোলার গতি বেড়ে গেছে। আমি যেটা খেয়াল করছি, অনেক বোলার টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে শারীরিক চাপের তুলনায় আয়ের তুলনা করে। তারা টি-টোয়েন্টির দিকে ঝুঁকছে। তবে সব মিলিয়ে আমার ধারণা, টেস্ট ক্রিকেট অনেক শক্তিশালী। এই ধরনের টুর্নামেন্ট বা এই সংস্করণ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে খেলাটায় আরও বেশি উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ নিয়ে আসবে। আমার তো মনে হয়, টি-টোয়েন্টি আসার পর টেস্ট ক্রিকেটেও আগের চেয়ে বেশি ফল হচ্ছে। খেলাটা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.