সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ- সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ- * ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে দেড় লাখের বেশি- * ৫০ হাজারের বেশি মৃতু্য হয়েছে- * ২২ ভাগ শিশু মারা যায়

 সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। গত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। সরকারী হিসেবে মৃতু্যর সংখ্যা ৫০ হাজার। বেসরকারী পরিসংখ্যানে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৩০ জনের বেশি মানুষ।
অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিবছর দুর্ঘটনার কারণে ৰতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা; যা জিডিপির দুই ভাগ। একটি উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নে অন্যতম অনত্মরায় হিসেবে কাজ করছে সড়ক দুর্ঘটনা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দুর্ঘটনায় আক্রানত্মদের মধ্যে ২২ ভাগ শিশু। দুর্ঘটনার দিক থেকে পথচারী ও রিকশা আরোহীরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, সব বয়সী মানুষের মৃতু্যর জন্য সড়ক দুর্ঘটনা ষষ্ঠতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা এড়াতে জরম্নরী ভিত্তিতে সারাদেশে রোড সেফটি কাউন্সিল অত্যাবশ্যক । সেই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রধান আটটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত সপ্তাহের বুধবার হামিম, পরদিন সুমী। পর পর দু'দিনের সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে নিভে গেছে ছোট্ট দুই শিশুর জীবনপ্রদীপ। দুই পরিবারে চলছে এখন শোকের মাতম। কান্নার রোল। আহাজারি। সনত্মান হারানোর শোকে পাথর দুই পরিবারের মানুষ। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ের সামনে আরও একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখানেই শেষ নয়, গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রায় ২০০ মানুষ। শুধু দুই শিশুর পরিবারের স্বজনরাই নয়, মৃতু্যশোকে পাথর দেশের ২০০ পরিবারের হাজারও মানুষ। সব মিলিয়ে রাসত্মায় চলতে এখন আর নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। ঘর থেকে বের হলেই মৃতু্য তাড়া করে ফিরছে মানুষকে। যখন-তখন, যে কারও প্রাণ যেতে পারে সড়ক দুর্ঘটনায়। হাঁটা কিংবা গাড়িতে থাকা অবস্থায় এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সম্প্রতি খোদ রাজধানী ঢাকায় কয়েক দফা দুর্ঘটনার কারণে আবারও এ বিষয়টি আলোচনায়। বিশেষ করে দফায় দফায় শিশুমৃতু্য! কোনভাবেই মানুষ তা গ্রহণ করতে পারছে না। তাই দুর্ঘটনা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। কেন এত দুর্ঘটনা?
বিআরটিত্র সূত্রে জানা গেছে, গড়ে প্রতিবছর যানবাহন বাড়ছে ১৫ ভাগ। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় প্রতিমাসে যোগ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ২০০ যানবাহন। সর্বশেষ ২০০৭ সালে ৪১ হাজার নতুন মোটরযান নিবন্ধিত হয়েছে সারাদেশে। পুলিশ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে চার হাজার মানুষ। গবেষকরা বলছেন, সঠিক প্রতিবেদনের অভাব এবং ভুল ব্যাখ্যার কারণে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ১০ থেকে ১২ হাজার। অর্থনৈতিক হিসেবে প্রতিবছর ৰতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা; যা জিডিপির দুই ভাগ। দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরযানে ১০০টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এক হাজার মোটরযানে দুই দশমিক পাঁচ ভাগ থেকে তিন দশমিক পাঁচ ভাগ। অন্যদিকে আমাদের বেশিরভাগ ৰেত্রে প্রতি এক হাজার যানবাহনে ১৬৩ জন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
আমাদের দেশে দুর্ঘটনার দিক থেকে পথচারী ও রিকশা আরোহীরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। মোট দুর্ঘটনায় আক্রানত্মদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি পথচারী। পথচারীদের মধ্যে ৭০ ভাগ ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার, ২৬ ভাগ আঘাত এবং ৪৩ ভাগ মোট দুর্ঘটনার শিকার হন। গ্রামীণ অঞ্চলে মহাসড়কে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪১ ভাগ পথচারী। ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের দুর্ঘটনার হার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি। পথচারী শিশুদের মধ্যে বিশেষ করে বালকদের চাইতে বালিকাদের মৃতু্যহার সব চাইতে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ ৰেত্রে ৰতিগ্রস্থ হয় মধ্য বয়সী এবং যুবক ও শিশুরা। স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, সব বয়সী মানুষের মৃতু্যর জন্য সড়ক দুর্ঘটনা ষষ্ঠতম কারণ। ১৫-২৯ এবং ৩০-৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃতু্যর প্রথম ও তৃতীয় কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। কিন্তু এই বয়সে সড়ক দুর্ঘটনা একটি দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক উন্নয়নে অনত্মরায় হিসেবে কাজ করে। কারণ, যে বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের বেশি মৃতু্যর ঘটনা ঘটছে, সে বয়সে একটি দেশের মানুষ অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সর্বাধিক ভূমিকা রাখে।

দুর্ঘটনার প্রধান আট কারণ
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশে সড়ক নিরাপত্তার সার্বিক অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। গবেষণায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নেপথ্যে আটটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্রম্নত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মোটরযানের সংখ্যা দ্রম্নত বেড়ে যাওয়া, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে অতিসামান্য বিনিয়োগ, অপর্যাপ্ত সচেতনতামূলক কর্মসূচী, পর্যাপ্ত প্রশিৰণের অভাব, মোটযানের ত্রম্নটি, সড়ক নির্মাণ ও মেরামতে ত্রম্নটি।

১৫ বছরের দুর্ঘটনার চিত্র
পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯৪-২০০৮ সাল পর্যনত্ম ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। মৃতু্যর ঘটনা প্রায় অর্ধলাখ। বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার জরিপে গত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা এক লাখ ৮০ হাজারের বেশি। সেই সঙ্গে সরকারী হিসেবের চেয়ে মৃতু্যর ঘটনাও অনেক বেশি। পুলিশ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯৪ সালে সারাদেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনা তিন হাজার ১৩। এর মধ্যে মৃতু্যর ঘটনা এক হাজার ৫৯৭। ১৯৯৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা তিন হাজার ৩৪৬, মৃতু্যর ঘটনা দুই হাজার ৯৪। ১৯৯৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা তিন হাজার ৭২৭। মৃতু্যর ঘটনা দুই হাজার ৪১। ১৯৯৭ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনা পাঁচ হাজার ৪৪৫, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ১৬২। ১৯৯৮ সালে মোট দুর্ঘটনা চার হাজার ৭৬৯, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ৮৫। ১৯৯৯ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনা চার হাজার ৯১৬, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ৩১৪। ২০০০ সালে মোট সড়ক দুর্ঘটনা চার হাজার ৩৫৭, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ৪৩০। ২০০১ সালে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ চার হাজার ৯১, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ১০৯। ২০০২ সালে মোট দুর্ঘটনা চার হাজার ৯১৮, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ৩৯৮। ২০০৩ সালে দুর্ঘটনা চার হাজার ৭৪৯, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ২৮৯। ২০০৪ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা তিন হাজার ৮২৮, মৃতু্যর ঘটনা দুই হাজার ৭৪৮। ২০০৫ সালে মোট দুর্ঘটনা তিন হাজার ৯৫৪, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ১৮৭, ২০০৬ সালে মোট দুর্ঘটনা তিন হজার ৭৯৪, মৃতু্যর ঘটনা তিন হাজার ১৯৩। ২০০৭ সালে মোট দুর্ঘটনা চার হাজার ৮৬৯, মৃতু্য তিন হাজার ৭৪৯।

করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রত সময়ের মধ্যে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদৰেপ নেয়া জরম্নরী; নইলে আগামীতে এ পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশকে দুর্ঘটনার রেকর্ড দেশের তালিকার প্রথম থেকে কোনভাবেই নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এ জন্য সরকার কতর্ৃক গঠিত রোড সেফটি কাউন্সিলকে কার্যকর ফোরাম হিসেবে গড়ে তোলা, জাতীয় রোড সেফটি কাউন্সিল সচিবালয় তৈরি, বিআরটিএতে রোড সেফটি ডাটাবেজ তৈরির ব্যবস্থা করা, জাতীয় রোড সেফটি এ্যাকশন পস্ন্যান বাসত্মবায়ন, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের রোড সেফটি ডিজাইন ইউনিট তৈরি, বুয়েটের দুর্ঘটনা সংক্রানত্ম গবেষণা সেন্টারকে আরও শক্তিশালী করা, সড়ক ও জনপথের জন্য রোড সেফটি ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড ম্যানুয়েল তৈরি, বিআরটিএ কতর্ৃক রোড ট্রাফিক সাইন ম্যানুয়েল তৈরি, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর কতর্ৃক রোড সেফটি এ্যাকশন পলিসি তৈরি, মেট্রোপলিটন রোড সেফটি কাউন্সিল গঠন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রোড সেফটি কাউন্সিল গঠন। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব আবু বকর মোঃ শাহজাহান লিখিত প্রবন্ধে বলেন, গাড়িচালক, হেলপার ও পথচারীদের মধ্যে জ্ঞান, স্বাভাবিক দৰতা ও ব্যবহারের পরিবর্তন আনার মাধ্যমে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লৰ্যে সংশিস্নষ্ট সবাই আনত্মরিকতার সঙ্গে উদ্যোগ নিলে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ দুর্ঘটনার হাত থেকে রৰা পাবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাবে দেশের হাজারও পরিবার।

No comments

Powered by Blogger.