পুলিশ দিয়ে শিক্ষক পেটানোর ফল কিন্তু ভালো হয় না by মোফাজ্জল করিম

শুরুতেই গোস্তাকি মাফ চেয়ে নিচ্ছি, এই লেখায় যদি আমার আবেগ-উচ্ছ্বাসের মাত্রা কারো কাছে বেশি মনে হয় সে জন্য। এর অবশ্য একটা কারণ আছে। আমি নিজে জীবন শুরু করেছিলাম শিক্ষক হিসেবে, আমার পিতাও দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছিলেন।
শিক্ষক ও শিক্ষকতার জন্য আমার আবেগ, দুর্বলতা ও সংবেদনশীলতা তাই থাকবেই, এবং তাতে দোষের কিছু নেই মনে করি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, অত্যন্ত প্রতিভাবান, প্রাণবন্ত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ড. শামসুজ্জোহাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিনা উস্কানিতে গুলি করে হত্যা করেছিল। উস্কানি দেওয়া বা অন্য কোনো প্রকার অন্যায় আচরণের তো প্রশ্নই আসে না; বরং এই অত্যন্ত দায়িত্বশীল শিক্ষক ছাত্রদের মধ্যে বিরাজিত উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে নাকি তাদেরকে ক্যাম্পাসের ভেতর ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলেন। তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রক্টর হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে কথা জেনেশুনেই পাকিস্তানি আর্মি তাঁকে গুলি করে। এর নতিজা কী হয়েছিল? ছাত্রদের আন্দোলন তথা ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কি থেমে গিয়েছিল? পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের বিক্ষোভ-বিস্ফোরণ কি দমন করতে পেরেছিল আইউব খাঁ-এহিয়া খাঁরা তাদের নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিমরোলার চালিয়ে? এখন পাঠশালা স্কুলের শিশুটিও জানে_পারেনি। জানেন না কেবল আমাদের দেশের শাসকবর্গ, যাঁরা নিজেদেরকে এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটির মালিক-মোখতার ভাবতেই বোধ হয়ে বেশি ভালোবাসেন। অবশ্য তাঁদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। এক শ্রেণীর সুযোগসন্ধানী চাটুকার কানের কাছে অহর্নিশ 'হুজুর মাই-বাপ, আমরা তো কুত্তার বাচ্চা'_এই বলে বলে বীণাতে ঝঙ্কার তুললে কেউ নিজেকে 'সামওয়ান নেঙ্ট্ টু গড' মনে করলেও করতে পারে।
কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, এইসব মেধাবী ব্যক্তির স্মরণশক্তি এত দুর্বল হয় কী করে। আচ্ছা, প্রফেসর জোহার সেই মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি না হয় সংঘটিত হয়েছে আজ থেকে চার দশকেরও বেশি আগে, প্রাকস্বাধীনতা আমলে, সেই স্মৃতিতে না হয় ছাতলা পড়েছে আপনাদের, মানলাম; কিন্তু এই সেদিন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সামরিক বাহিনীর লোকজন কতিপয় সম্মানিত শিক্ষককে তৎকালীন শাসকবর্গের ছত্রচ্ছায়ায় বেধড়ক পেটাল, সেই ঘটনাও কি ভুলে গেলেন? এরপর কি সেই সময়ের দুই বছর বয়সী নাবালক সরকারের হায়াত আরো বেড়েছিল? বাড়েনি। নাকি এর আগে পাকিস্তান আমলে, বাংলাদেশ আমলে শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলে কেউ বহাল তবিয়তে থাকতে পেরেছে? পারেনি। পারবেও না। কারণ জনমত জরিপ করে দেখুন, এ দেশের শতকরা পঞ্চাশজন মানুষ জীবনে কোনো দিন প্রাইমারি-সেকেন্ডারি স্কুলের ছায়া না মাড়ালেও তাদের বুকের ভেতর শিক্ষার জন্য, শিক্ষাদাতা গুরুর জন্য অপরিসীম শ্রদ্ধা, এক আকাশ ভালোবাসা। কাজেই শিক্ষকের গায়ে কেউ হাত তুলুক, সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তারা তা কিছুতেই বরদাশত করবে না। চিরকাল তারা গাছের লাউটি মসজিদের ইমাম, মক্তবের মৌলবী, গ্রামের পাঠশালার শিক্ষক সাহেবকে না খাইয়ে খায় না। ছেলেমেয়ের বিয়েশাদী চূড়ান্ত করতে, জায়গা-সম্পত্তির বায়নামা করতে, সব ধরনের আপদে-বিপদে, এঁদের পরামর্শ না নিয়ে চলে না। এঁদের জন্য তাদের ভালোবাসা অন্তরের ভালোবাসা, ভাড়াটে বাসের ছাদ থেকে উড়ে আসা আগুনের ফুলকির মতো ভালোবাসা সেটা নয়। আপনার-আমার দেশের সেই শতকরা নব্বই জন মানুষ যারা গ্রামে থাকে, শিক্ষকের যারা প্রতিবেশী_কেউ তাঁর ভাই, কেউ চাচা, কেউ ভাতিজা_তাদের হৃদয় উৎসারিত শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা ঢাল হয়ে ঘিরে রাখে শিক্ষককে। তাঁদের অভিশাপের আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয় অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ। আসুন না, আমরা দেশের সেই শতকরা নব্বই জনকে জিজ্ঞেস করে দেখি, পুলিশ দিয়ে শিক্ষক পেটানো তারা সমর্থন করে কি না?
আচ্ছা, এই শিক্ষকরা, এরা কারা? আপনারা ত্বরিত জবাব দেবেন : এরা আন্দোলনকারী, আইন অমান্যকারী, উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসী চরিত্রের লোক, এরা দুষ্কৃতকারী। তাই? তাহলে তো বলতে হয়, আপনার-আমার বাপ-চাচা, ভাই-বেরাদর_সবাই সন্ত্রাসী, সবাই দুষ্কৃতকারী। কারণ আপনি-আমি শহরে এসে বড় বড় পদে বসে, বিরাট বিরাট দালানকোঠায় বাস করে, বিশাল গাড়ি হাঁকিয়ে (এর কোনো কোনোটা জনগণের প্রাপ্য শুল্কের টাকা না দিয়ে, অর্থাৎ জনগণের পকেট কেটে কেনা, আর না হয় সরকারি মালিকানার গাড়ি) এদের পরিচয় ভুলে গেছি। কিন্তু যাদের আপনি আইন অমান্যকারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসী বলে লাঠিপেটা করছেন, মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে চোখ কানা করে দিচ্ছেন, খোঁজ নিয়ে দেখুন, এরা আপনার-আমারই আত্মীয়। আপনার না হলে আমার, আমার না হলে আপনার। এদের কাঁধে সওয়ার হয়ে আপনারা স্বপ্ন দেখছেন আগামী দিনের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কারিগর সৃষ্টি করবেন। কিন্তু এভারেস্ট আরোহীর প্রথম পদচ্ছাপটি যেমন হিমালয় পর্বতের পাদদেশে রাখতে হয়, তেমনি মন্ত্রী-এমপি, আমলা-কামলা, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, শিল্পী-সাহিত্যিক-পণ্ডিত প্রভৃতি সবার হাতেখড়িটা ওই পাঠশালা বা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হতে হয়। ওখানেই ক আর র কর, ধ আর র ধর শিখে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এভারেস্ট-চূড়ায় ওঠার পথ ধরতে হয়। আপনারা বলবেন, হুঁ, ভারী তো একটা স্কুল, তার না আছে একটা দরজা, না আছে জানালা। না আছে বসার একটা বেঞ্চ, না বই-খাতা রাখার একটা ডেস্ক। এর মাস্টারেরই বা কী বিদ্যা আছে যে তিনি শিশুদের শেখাবেন। ঠিক, ঠিক। আপনার সব অভিযোগ একেবারে দিনের আলোর মতো ঠিক। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, এই ঘর নেই, দরজা নেই, বেঞ্চ নেই, চেয়ার নেই_এ রকম অবস্থার জন্য দায়ী কি ওই লাঠিপেটা খাওয়া মাস্টার সাহেব? নাকি আপনি-আমি? সত্যি বলুন তো, ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া দু শ বছরের পুরনো প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার কি আসলে কোনো পরিবর্তন আমরা করেছি? একেকটা পাঁচশালা-দশশালা (না, না, ব্রাদার-ইন-ল' অর্থে নয়!) কল্পনার ডানাকাটা পরীর মতো পরিকল্পনা আসে, আর তাতে করে ভেসে আসে আকাশে-বাতাসে হিল্লোল জাগানো সব গোলাপি স্বপ্ন। দেশবাসী আশায় বুক বাঁধে, এবার আর টিটি পাস (টেনেটুনে পাস) মাস্টার নয়, ভাইয়েরা আমার, এবার আমাদের বাচ্চাদের পড়াবে এমন সব শিক্ষক-শিক্ষিকারা যারা জজ-ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা কলেজের অধ্যাপক না হয়ে একই বেতন, একই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে, সরকারি বাড়িতে থেকে, সরকারি গাড়ি চড়ে এসে ব আর হ্রস্ব ই বই, ক আর হ্রস্ব ই কই পড়াবে। তারপর সেই আশা-স্বপ্নের গোলাপ যখন কলি মেলে তখন দেখা যায়, ধুত্তোরি, এটা গোলাপ কোথায়, এটা তো সেই আগের ধুতুরা ফুলই বটে। আর শিক্ষক মহোদয়ের মাসিক বেতন সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের সেই পণ্ডিত মশাই_যাঁর বেতন, ইংরেজ স্কুল পরিদর্শকের তিন-ঠ্যাঙ্গা কুকুরের মাসিক ভরণপোষণের খরচের তিন ভাগের এক ভাগেরও কম ছিল, সেই তুলনায় অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, তবে সেই আমল থেকে তৈলতণ্ডুলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক শ গুণ বেশি। এখন তাঁর নুন আনতে শুধু পান্তা নয়, চাল-ডাল-পিঁয়াজ-হলুদ সবই ফুরায়।
এরি ভেতর যখন দেখি সরকারি চেষ্টায় গত বিশ বছরে গ্রামের স্কুলগুলোতে ছাত্রভর্তি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, 'ড্রপ আউট' কমেছে, মেয়েরা এক লাফে ছেলেদের এক শ হাত পেছনে ফেলে লেখাপড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে, গ্রামের বিদ্যালয় ভবনগুলোর চেহারা-ছবিও মোটামুটি ভদ্রসম্মত হয়েছে, তখন এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিশ্চয়ই তৃপ্তিবোধ করি। এখন পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার আগে-পরে শিশুদের উৎসাহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। সরকার থেকে বছরের শুরুতেই বিনা মূল্যে পাঠ্য বই পেয়ে তারা সত্যি দারুণ খুশি। আমাদের আমলে তো এগুলো আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। ওপরের ক্লাসের বড় ভাইদের পুরনো বইগুলো অর্ধেক দামে জোগাড় করার জন্য আমরা হা-পিত্যেশ করতাম।
এখন একেকটা পরীক্ষায় পাসের হার গগনচুম্বী। কদিন পরে, বোধ করি, পাসের হার ঘোষণা না করে ফেলের হার ঘোষণা করতে হবে। ফেল্টুদের নাম-রোল নম্বর ছাপা হবে পত্র-পত্রিকায়, ওয়েবসাইটে। তাতে সময় ও খরচ দুটোই বাঁচবে। আর জিপিএ-৫, এ-প্লাস, এ-মাইনাস ইত্যাদি সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হবে পড়ুয়াকে।
সবই মানলাম। সবই খুশির খবর। তবে নির্ভর করে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি তার ওপর। আসলে আমরা কী চাই? শিক্ষিত, না বিদ্বান? 'এডুকেটেড' না 'লার্নেড'? আমাদের এখন যা অবস্থা, আরো খোলাসা করে বলা যায়, যে শূন্য অবস্থা থেকে আমরা শুরু করেছিলাম (কল্পনা করুন সেইসব দিনের কথা, যখন একটা চিঠি পড়িয়ে শোনানোর জন্য গ্রামের দশ বাড়ির দরজায় দরজায় ধর্ণা দিতে হতো), সেখান থেকে এক উল্লম্ফনে বিদ্যার মগডালে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আমাদের 'অ্যাপ্রোচ,' আমি মনে করি, ঠিকই ছিল; চাল-গম-টাকা-পয়সা দিয়ে সর্বপ্রথম বাচ্চাদের স্কুলমুখী করাটা জরুরি ছিল। গ্রামীণ মা-বাবা যখন দেখত, তাদের ছয়-সাত বছরের হালের খুঁটি ধরতে বা গরু চরাতে সক্ষম শিশুটি স্কুলে যাওয়ার কারণে সংসারে আয় কমে যাচ্ছে, তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশুটিকে স্কুলে যেতে দিত না। কিন্তু সেই শিশুই যখন স্কুলে গিয়ে শুধু লেখাপড়াই শিখতে লাগল না, দুটো কাঁচা পয়সা বা দু'মুঠো চাল-গমও আনতে লাগল সংসারের জন্য, তখন তারা তাকে স্কুলেই পাঠাতে লাগল। ফলে একরকম রাতারাতি বাংলাদেশে 'শিক্ষিতের' হার বাড়তে লাগল।
হার বাড়ুক, এ তো আনন্দের কথা। কিন্তু স্কুলে গিয়ে ৪/৫ ঘণ্টা থেকে সে কী শিখল, সেটাও অবশ্যই দেখতে হবে। বিদ্বান না হোক- সেটা হতে হলে তাকে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে; কিন্তু যা শিখে শিশুটি শিক্ষিতের খাতায় নাম লেখাচ্ছে, তার জীবনঘনিষ্ঠতা, প্রায়োগিক দিক, গুণগত মান- এগুলো তো অবশ্যই দেখতে হবে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে প্রাইমারি স্কুল থেকে বের হওয়ার পর যদি দেখা যায়, সে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর মানই ভালোভাবে অর্জন করতে পারেনি, তাহলে হাজার হাজার জিপিএ-৫ আর এ-প্লাস ইত্যাদি বেকার। শতকরা ৯০ জনের পরীক্ষা বৈতরণী পার হওয়া হয়তো হবে; কিন্তু জীবন-সায়রে তার তরুণী সখাত সলিলে ডুবে যাবে।
একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি যদি অনুমতি দেন। চাকরি-জীবনে নিয়মিত, এবং ইদানীং মাঝে মাঝে, আমি সুযোগ পেলেই প্রাইমারি স্কুল দেখতে যাই। না, পরিদর্শন নয়, সে ক্ষমতা এখন আর নেই। তবে এমনিতে শিক্ষকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করা, বাচ্চাদের লেখাপড়ার খোঁজ নেওয়া, বিশেষ করে (সবিনয়ে বলছি) আমার নিজের প্রতিষ্ঠিত আমার মায়ের নামের সরকারি রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলটি কেমন চলছে ইত্যাদি জানার জন্য মাসে, দু'মাসে গ্রামে গেলেই স্কুলে যাই। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, প্লিজ শুনে রাখুন, আপনার একান্ত সদিচ্ছা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাসের হার শতকরা নব্বই বা তার বেশি হতে চললেও, শিক্ষার মান যে হাঁটু বরাবর ছিল সেখানেই আছে। বিশ বছর আগে গ্রামের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যে ভুল উত্তর পেতাম বা পেতাম যে শূন্য চাহনি, তার কোনো উন্নতি হয়নি। তাহলে? তাহলে এই শতকরা ৯০/৯৫ দিয়ে কী হবে? এতে তো অদূর ভবিষ্যতে দেশে কেবল পঙ্গপালের মতো শিক্ষিত বেকাররা গিজগিজ করবে।
কেউ কারো রুটি-রুজির সংগ্রামে যদি পথে নামে, তাহলে অন্যায়টা কোথায়? বিশেষ করে সে যদি দেখে, সে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হচ্ছে তাহলে সে তো অবশ্যই তার অস্তিত্বের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেই। পুরো বিষয়টি নিষ্ঠুরতার সঙ্গে সামাল দিতে চেষ্টা না করে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।
শেষ করার আগে সংক্ষেপে আমার সুপারিশগুলো বলি। (১) শিক্ষকদের পুলিশ দিয়ে, জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে, রাজনৈতিক ক্যাডার দিয়ে পেটানো বন্ধ করতে হবে। (২) তেঁতুলের চারা রুয়ে যে গাছ হবে তাতে তেঁতুলই ফলবে, ফজলি আম পাবেন না। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক-নিয়োগের 'ক্রাইটেরিয়া' পুরোপুরি বদলাতে হবে। কোথাও কোনো চাকরি না পেয়ে, মাপ করবেন, এমনকি কোনো অফিসে পিয়নের পদও না পেয়ে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হওয়া চলবে না। (৩) প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি করতে হবে, যেমন : শিক্ষা ক্যাডার (প্রাথমিক)। সেখানে পিএসসি'র মাধ্যমে অন্যান্য চাকরির (যেমন : ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাজিস্ট্রেট, অধ্যাপক ইত্যাদি) ন্যায় প্রাথমিক স্কুলের জন্য যোগ্য, মেধাবী প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে। (৪) এদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বেতন-ভাতা, বাসস্থান ইত্যাদি হতে হবে অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের সমতুল্য। সেই সঙ্গে যেহেতু গ্রামেই তাদের প্রায় সারাজীবন চাকরি করতে হবে, সেই জন্য আকর্ষণীয় হারে বিশেষ ভাতা দিতে হবে। (৫) স্কুল পরিদর্শনের বর্তমান ফাঁকিজুকি ও চুরিচামারির পথ বন্ধ করতে হবে। পরিদর্শকরাও হতে হবে যোগ্য, দক্ষ ও সৎ। তাঁদের কাজকর্ম নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা রাখতে হবে। (৬) সব ক'টি স্কুলে খেলাধুলা, কাবিং ও দুপুরে হাল্কা নাশতা/খাবারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। (৭) সর্বোপরি, এই ঢেলে সাজানোর কাজটি সব ক'টি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদে আইন পাস করে চালু করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এতে যে বিশাল আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে, তা হবে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের সর্বোত্তম বিনিয়োগ। এ ব্যাপারে কার্পণ্য করা হবে আত্মঘাতী। বরং দু-চারটা হলমার্ক-ডেসটিনি শক্ত করে পাকড়াও করুন, দেখবেন, টাকা-পয়সা সুড়সুড় করে আসতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে চেষ্টা করুন, বিশ্বব্যাংকসহ সব দাতাগোষ্ঠীর অটুট আস্থা অর্জনের।
শিক্ষক পেটানো, তাঁদের সামাজিকভাবে হেয় করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বন্ধ করুন। তা না হলে আপনার-আমার শিশুরা তাদের শিক্ষককে সম্মান করা তো দূরের কথা, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যখন আপনারা শিক্ষকের হাত থেকে যে বেত কেড়ে নিয়েছেন, খোদা না করুক, শিশুরা সেই বেত তাদের শিক্ষকের... (তওবা, তওবা)। মাননীয় নেতৃবৃন্দ, দেশে সেই কিয়ামত নাযিল হোক, আপনারা কি তা-ই চান? উন্নত বিশ্বের লোকেরা এমনিতে আমাদের অনেক কিছু নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে, দূর-দূর, ছি ছি করে, এখন বাকি ছিল এটা বলার যে, এই অর্বাচীনগুলো স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক শাস্তিব্যবস্থা রহিত করে এখন সেটা প্রয়োগ করছে শিক্ষকদের ওপর, এটাও বলার সুযোগ করে দিতে চান?
যেসব সম্মানিত শিক্ষক সম্প্রতি পুলিশের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা ও অশেষ শ্রদ্ধা। আল্লাহ আপনাদের-আমাদের সবার সহায় হোন। আমিন।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলামিস্ট
mkarim06@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.