সরকারের জনপ্রিয়তা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে? by মেজর (অব.) সুধীর সাহা

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ভালো করবে, এমন ধারণা সবারই ছিল।
কেননা সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত আওয়ামী লীগের সহায়ক ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, অরাজকতা, অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সহিংস রাজনৈতিক অবস্থান- সব কিছুই জনগণকে বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঠিক আগের সরকারই ছিল বিএনপি সরকার, তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবিষ্কৃত দুর্নীতির সিংহভাগই ছিল বিএনপির নেতা-নেত্রীদের দ্বারা পরিচালিত। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাসে বড় রকম কাজ করেছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপেক্ষাকৃত ভালো একটি নির্বাচনী ইশতেহার উপহার দিয়েছিল। সেখানে তাদের অঙ্গীকারের প্রতি অপেক্ষাকৃত তরুণ ভোটাররা আগ্রহী হয়েছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ঘরে ঘরে চাকরি প্রদান, দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি, পদ্মা সেতুসহ অবকাঠামোর উন্নয়নসহ ভালো ভালো অঙ্গীকার ছিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে। সব কিছু মিলিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন তুঙ্গে ছিল।
বছরখানেক পর আবার সাধারণ নির্বাচন। এই চার বছরে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ভালো কাজ করেছে। কৃষি ও খাদ্যের ক্ষেত্রে তাদের অর্জন অনেক। শিক্ষায় তাদের অর্জন আছে, নারী অধিকার সংরক্ষণে তাদের পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে। বিদ্যুৎ সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বিদ্যুৎশক্তি বৃদ্ধিতে সরকারের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। কুইক রেন্টাল নিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকলেও এই কুইক রেন্টাল পদ্ধতির কারণেই সরকার দেশে বিদ্যুৎ সমস্যার অনেকখানিই সমাধান করতে পেরেছে। নারীশিক্ষার প্রসার, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, শ্রমবাজারে নারীর প্রবেশ, মানব উন্নয়নে বিশেষ অবদান ইত্যাদি বিষয় বর্তমান সরকারের ভালো কাজের সরাসরি ফসল না হলেও অন্তত যেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে এই সরকারের সময়ই এগুলো ধরা পড়েছে, তাই স্বভাবতই এই সরকার এসব সুফলের অংশীদার দাবি করার যুক্তি রাখে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকখানিই ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই সরকারের সময়। বিশ্ব অর্থনীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়েছে এই সরকারের শাসনামলে। এই সরকারের সময়ই বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, তারা একদিন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের হিসাবে সামনে যেসব দেশ উন্নতির পথে বিশেষ অবদান রাখবে, বাংলাদেশ সে ধরনের ১১টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। সরকার মানুষের চাহিদার আরেকটি বড় ধাপ পূরণ করার পথে এবং তা হলো একাত্তর সালের মানবতাবিরোধী অন্যায়ের বিচার সম্পন্ন করা। সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাতীয় চেতনায় রূপ দিতে অনেক কাজ করেছে। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুদেশ ও ব্যক্তিদের সম্মাননা দিয়ে সরকার অনেক মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে। ২ জানুয়ারি হাতিরঝিলের শুভ উদ্বোধন করে সরকার গণমানুষের জন্য ভালো কাজের অন্যতম স্বাক্ষর রেখেছে।
এত কিছুর পরও সরকারের জনপ্রিয়তার অবস্থাটা এখন ভালো নেই। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ২০০৮ সালের মতো তো নয়ই; বরং সামনের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের মতো অবস্থানেও নেই এখন। কেন এমন হলো? এত ভালো কাজ করেও এবং প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার পরও তাদের জনপ্রিয়তা তারা ধরে রাখতে পারছে না কেন? এই 'কেন'র উত্তর খুঁজতে ব্যর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগ। সরকারের জনপ্রিয়তা যে কমে গেছে, তা সরকার কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে। তাই নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা বা ধীরে চলার নীতি সরকারের। সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের বেশ কিছু বাস্তব প্রমাণ মিলেছে বিগত অনেক নির্বাচনে। দলে ঠাঁই পাওয়া অনভিজ্ঞ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও বিশেষ করে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাওয়া অনভিজ্ঞ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ঠিক দলকে চাঙ্গা করার কাজে ততটা সক্রিয় ছিলেন না এই সরকারের আমলে। দলের মধ্যে সাধারণ সম্পাদকের অলস ভূমিকা নিয়ে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা হলেও বিগত কাউন্সিলে দেখা গেল তিনিই রয়ে গেলেন। এবারও সভাপতি তাঁর জন্য নিরাপদ জায়গাগুলোই হয়তো খুঁজেছেন।
পদ্মা সেতু নিয়ে যতটা দুর্নীতি হয়েছিল, তার থেকেও বেশি ক্ষতিকর কাজ হয়েছে এই দুর্নীতি নিয়ে সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের কথোপকথন ও কার্যাবলি। বিশ্বব্যাংককে গুরুত্ব না দিয়ে প্রথম একবার সরকার ভুল করেছিল। পরে সেই বিশ্বব্যাংকের সব অন্যায় দাবি পূরণের আপ্রাণ চেষ্টা করে সরকার মূলত পদ্মা সেতু নিয়ে একেবারেই লেজেগোবরে করে ফেলেছে। পদ্মা সেতু এখন বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে হোক বা না হোক, দুভাবেই সরকার জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। আগামী নির্বাচনে পদ্মা সেতু তাই বিরোধীদের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অন্যতম প্রধান ইস্যু হিসেবে কাজ করবে।
শেয়ারবাজার সরকারের জন্য একটি নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সরকার কিছু লোকের অপরাধ ঢাকতে গিয়ে এই বিষয়টিতে ব্যাপক সমালোচনার পাত্র হয়েছে। শেয়ারবাজারে সরকার যতটা না দায়ী, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়েছে সরকারের জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারি- এই দুটি বিষয়ও অযথাই সরকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করার পরিবর্তে জনপ্রিয়তা হ্রাস করেছে। এ দুটি কেলেঙ্কারি সরকার কখনো পরিষ্কার করে জনগণকে বোঝাতে সমর্থ হয়নি।
দলীয়করণ, দুর্নীতি, সংঘাতময় রাজনীতি ও সুশাসনের ঘাটতি- এ চারটি বিষয় হাতে হাত ধরে এগিয়েছে অনেকটাই। ফলে জনগণের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম নিয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া গত ২০ বছরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অর্জনের প্রশংসা করেছে এবং অন্যদিকে জাতীয় ক্ষেত্রে নানা সমস্যার আবির্ভাব হওয়ায় পুরো বিষয়টির সুফল সরকার ঘরে তুলতে পারেনি। অসহিষ্ণু রাজনীতির কারণে বিরোধী দল সম্পর্কে যেকোনো বক্তৃতা বা আলোচনায় যেসব অসৌজন্যমূলক কথা বলেন, তা সরাসরি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। সরকারের দুর্নীতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে জনগণের মধ্যে এক ধরনের বিরূপ ধারণা বিদ্যমান। বিচার ও নির্বাহী বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি নিয়ে সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের মুখে আছে বর্তমান সরকার। সরকার নিজের লোক খুঁজতে গিয়ে দক্ষতার সঙ্গে আপস করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সরকার অদক্ষ লোক দিয়ে প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও মন্ত্রী-এমপিদের পেটোয়া বাহিনী সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। স্কুল-কলেজ, প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার- সব কিছুই দলীয় দৃষ্টিতে দেখার ফলে গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি ভালোবাসা হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যা, শীর্ষসন্ত্রাসী বিকাশকে মুক্তি দেওয়া সরকারের জনপ্রিয়তায় আরো ধস নামাতে সাহায্য করেছে। সৌদি আরবের কূটনীতিক হত্যার ব্যাপারে দ্রুত তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন হলেও সাগর-রুনির মতো এত বড় একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো ঝুলে আছে। তবে সরকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে আগামী নির্বাচনটি কিভাবে হবে এই বিষয়টিতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে না নিলে একটি রাজনৈতিক সংঘাত প্রায় অনিবার্য। কেননা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, তা প্রায় নিশ্চিত। বিএনপিকে ছাড়া সাধারণ নির্বাচন এ দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সমাজ মেনে নেবে কি না তা বড় প্রশ্নের দাবি রাখে। এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দল যতই হার্ডলাইনে যাবে, ততই জনগণের কাছে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে। এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা।
কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার সফলতার দাবি রাখার জায়গাটিতে নেই। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো তারা সমাধান করতে পারেনি। প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে কূটনৈতিক সমাধান করতে পারেনি সরকার। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস নিয়ে অযথাই সরকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে একটি শীতল সম্পর্কের জন্ম দিয়েছে। শক্ত হাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ এগিয়ে নেওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নেওয়া, রাজনৈতিক সহিংসতা রোধের ব্যাপারে সহনশীল হওয়া, বিরোধী দলের প্রতি গঠনমূলক আলোচনায় মূল ভূমিকা পালন করা, দ্রুত পদ্মা সেতু ইস্যুকে একটি গতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, শেষের বছরটি দলীয়করণ না করে সুশাসনের স্বার্থে সব ক্ষেত্রে দলীয় নীতির পরিবর্তে জননীতির বিকাশ হতে দেওয়া, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য দেওয়া, অসমাপ্ত কর্মকাণ্ড দ্রুত শেষ করা, সহিংসতা পরিহার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন করায় প্রকাশ্য ভূমিকা গ্রহণ করা, ভারত-মিয়ানমার ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরো গতিশীল কূটনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি করা, একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন কার্যকলাপের চিত্র জনগণের কাছে তুলে ধরা ও মিডিয়ার প্রতি বিরূপ না হয়ে বন্ধু ভেবে সরকারি নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে সরকার এখনো পারে তার হারানো জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে।

লেখক : কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.