বঙ্গবন্ধুর একটা ইন্টারভিউ তো নিতে পারতাম by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
আজ
১৫ই আগস্ট, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী। এই
মহান নেতা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন
অধ্যাপক, বিশিষ্ট গল্পকার ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়—বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শৈশব কিংবা কৈশোরের স্মৃতি।
১৯৬৬ সালের পর আমি প্রথম বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনেছি যখন উনি ছয় দফা’র সমর্থনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ কিংবা মিটিং করেছেন, ঠিক সেই সময়েই। তিনি গিয়েছিলেন সিলেটে। সিলেটে সেই রেজিস্ট্রি—রেজিস্ট্রি বলতে যেখানে আইনের কিছু বিষয় থাকে। সেই রেজিস্ট্রার মাঠে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই প্রথম তাঁর বাগ্মিতার সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হলো। আমরা মাঠ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু চাইতেন না যে, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা, বিশেষ করে ছাত্ররা এতে অংশগ্রহণ করুক। এখন যে রকম পাড়ায় পাড়ায় মন্ত্রিরা গেলে স্কুল-কলেজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, বঙ্গবন্ধু তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। ছাত্ররা গেলে তিনি খুবই বিরক্ত হতেন। তাঁর কথা ছিল যে, এ বয়সে ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে থাকবে, পড়ালেখা করবে। আর যারা ছাত্র রাজনীতি করে তারা কিছুটা বয়স হলে তারপর আসতে পারে। এজন্য একটু ভয়ে ভয়ে আমরা একটু দূরেই ছিলাম এবং আমাদের বলেই দেয়া হয়েছিল যে, আমরা যেন একেবারে সামনে না যাই। তাই আমরা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তখন এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি। তখন আমার মনে হয়েছিল, অসাধারণ একটি বক্তৃতা শুনলাম। সেখানে তিনি হাস্য-রসেরও কিছু জোগান দিয়েছিলেন। কিছুটা কৌতুক, সরস কথাবার্তা কিন্তু মূল বক্তব্যটা খুবই প্রায়োগিক ছিল। তাঁর একটি কথা এখনও আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন—‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে, আঙ্গুল ত্যাড়া করতে হয়’। এই কথায় আমরা খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন। আমার মনে আছে, জোরে জোরে হাততালিও দিয়েছিলাম। তারপর বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনেছি কয়েকটি। কিন্তু আমার কানে লেগে থাকা এবং আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ শোনা ভাষণ হলো ৭ই মার্চের ভাষণ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসেই সেই ভাষণ শুনেছিলাম। বিদেশি এক রেডিওর সাংবাদিক এসেছিল। তিনি একজন দো-ভাষী খুঁজছিলেন। তার সঙ্গেই আমি গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সাংবাদিকদের যেহেতু আলাদা একটা বসার জায়গা ছিলো, আমাকে তাই সেখানে নিয়েই তিনি বসালেন। বলতে গেলে অনেকটা সামনেই ছিলাম। সেখান থেকেই আমি শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর সেই কাব্যিক ভাষণ। সেই সাংবাদিক একটা রেডিও বোধহয় মঞ্চে রেখে এসেছিলেন রেকর্ড করার জন্য। খাতা ছিল আমার কাছে। তিনি আমাকে বললেন, তুমি শুধু অনুবাদটা করো আমার জন্য। দুই মিনিট পর বললেন, ‘তুমি শুধু ‘কি ওয়ার্ড’ লিখে রাখো’। আমি শুধু ওই ‘কি ওয়ার্ডগুলো’ লিখে রেখেছি। প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনেছি। কিন্তু আমার শুধু মনে হচ্ছিলো এমন একটি ভাষণ আমি সারা পৃথিবীতে শুনিনি। আসলে ওই সময়টায় একটা জাদু ছিল বাতাসে। আমরা যা চাচ্ছিলাম তাই তিনি বলেছিলেন। শুধু তাই নয়, আমরা যা আশা করছিলাম আর প্রতিফলন ছিল সেই ভাষণে। এবং আমরা পরে বুঝেছি, কেন তিনি সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি। এতো বড় দায়িত্ব নিয়ে এতো বড় বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন। যা হোক, তারপর আবার যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে, ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে এলেন। ওইদিনও আমি ঢাকাতেই ছিলাম। কিন্তু একটু দেরি করে যাওয়ার ফলে পুরো বক্তৃতাটি শুনতে পারি নি। তবে যেটুকু শুনেছিলাম, তাতে মনে হয়েছে, ভাষণটি ৭ই মার্চের ভাষণ এর ধারে কাছে আসতে পারে। এটি মূলত তাঁর একটি দিক নির্দেশনামূলক বক্তৃতা ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। আর উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা তো আলাদা জিনিস। তারপর বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর দালানের উপর। আবার, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যখন আলোচনা চলছে তখন আমরা শেরাটন হোটেলের আশেপাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। কারণ তিনি মূলত এই রাস্তা ধরেই তাঁকে চলাফেরা করতে দেখতাম—৭২, ৭৩ কিংবা ৭০ সালের আগেও দেখতাম। বঙ্গবন্ধু যখন জননেতা ছিলেন, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো পদে বহাল ছিলেন না তখন তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়াটা সহজ ছিল। তাঁর ৩২ নম্বর বাসার সামনে গেলে এবং ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলে তাঁকে দেখা যেতো। কারণ তিনি বাসায় থাকলে বারান্দায় আসতেন অথবা যখন তিনি বের হতেন তখন মানুষের মাথায় হাত দিতেন। এক কথায় ভয়ানকভাবে মানুষকে ভালোবাসতেন। তাঁর চেহারার মধ্যেই একটি অন্য রকমের আকর্ষণ ছিল—গম্ভীর একজন গলার মানুষ এবং যাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই প্রখর। মানুষের জন্য তাঁর অসীম ভালোবাসা ছিলো। অনেকের নাম মনে রাখতেন। আমার খুব কষ্ট লাগে যে, আমার সমবয়সী অনেকের নাম বঙ্গবন্ধু জানতেন। কিন্তু আমি তো কখনো সামনে যাইনি তাই হয়তো আমার নাম তিনি জানতেন না। সেই অর্থে বঙ্গবন্ধুর সাথে সামনে থেকে কথাবার্তা বলার সুযোগ আমার হয়নি। অনেকের সঙ্গেই তাঁর সামনে গিয়েছি, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে কিন্তু আমার সঙ্গে হয়নি। এখন ঐ বন্ধুরা যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের স্মৃতিকথা লেখেন তখন আমার খুবই মন খারাপ হয়। মনে মনে আক্ষেপ করে বলি, বঙ্গবন্ধু’র একটা ইন্টারভিউ তো নিতে পারতাম!
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর দায়িত্ব এবং নিরাপত্তা দুইই বেড়ে গেল। সুতরাং আগের মতো সহজেই তাঁকে পাওয়া বা দেখা যেতো না। বাড়ির সামনে গেলেই পুলিশ সরিয়ে দিতো। আর তখন মানুষের মধ্যে উৎসাহও অনেকটা কমে গিয়েছিল। কারণ স্বাধীন তো হয়েই গেছি আর বঙ্গবন্ধু তো আছেন-ই। ১০ই জানুয়ারির পর তাঁর আর কোনো বক্তৃতা আমার শোনা হয়নি। এর আগে যখন ’৬৯-এ তিনি আগরতলা মামলা থেকে বেরিয়ে আসলেন তখন তাঁর বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। অনেক ভিড় ছিল। আর আমি একটু ভিড়-টিড় এড়িয়ে চলি তো! ঠ্যেলে ঠ্যেলে সামনে যাওয়ার মানুষ আমি না। যারা সামনে গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে এবং তারা যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছে এবং হাত মিলিয়েছে সে কথাও আমি শুনেছি পরে। এই তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার স্মৃতি। বঙ্গবন্ধু সবসময় আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। এটাই ছিলো আমাদের দেশের মানুষের জন্য বিশাল একটা পাওয়া বা প্রেরণা। এমনকি ’৭১ সালে তিনি যখন পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, তখনও আমি দেখেছি মুক্তিযোদ্ধরা তাঁর নামে যুদ্ধ করেছেন, আমাদের সবারই মনে হয়েছে তিনি আমাদের মাঝে আছেন। তিনি ছিলেন অসম্ভব অনুপ্রেরণাদায়ী একজন মানুষ; যাঁর গলার স্বর থেকে হাতের আঙ্গুল বা হাত উত্তোলনের ভঙ্গি সবই তাঁর নিজস্ব। এসব কিছুই খুবই আকর্ষণীয় ছিল। আমি এ জীবনে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিকে দেখছি, তারা কেউই তার মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারী নন। তিনি একেবারে সবার অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। এসব কারণে তাঁর জন্য আমাদের হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো। আমি মনে করি তিনি একজন ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ নেতা ছিলেন, মানুষ ছিলেন। সব সময় মাথাটা উঁচু করে চলতেন। যখন তাঁর বাড়ির সামনে গিয়েছি—বিশেষ করে ’৭০-এর শেষের দিকে কিংবা ’৭১-এর মার্চে, তিনি মানুষের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েছেন। প্রায় সবসময়ই মানুষ তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো তাঁকে দেখার জন্য। আর সবার আশা ছিল বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতে পারলে হয়তো কিছু দিক নির্দেশনা পাওয়া যাবে। তখন তো এই মোবাইল একেবারেই ছিল না। বলতে গেলে এই রেডিও, টেলিভিশন সবই ছিল পাকিস্তানিদের দখলে। আর পত্র-পত্রিকায় যেগুলো বের হতো, এই ব্রেকিং নিউজ বলতে কিছুই ছিল না। খবর জোগাড় করতে হতো। আর আমাদের সুবিধা ছিল, হলে থাকার ফলে অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যেত। বঙ্গবন্ধু কোথায় যাচ্ছেন, যখন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মিটিং তখন আমরা হল থেকে বের হতাম। মনে হয় পনেরো-কুড়ি মিনিট হাঁটলেই সেখানে চলে যেতে পারতাম। সেইজন্য সুযোগগুলো আমরা বাদ দেইনি। যখন বঙ্গবন্ধু ভিতরে আলোচনা করছেন, আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি— মনে হচ্ছে আমরা আছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এই অনুভূতিটা ঠিক বোঝানো মুশকিল। এখন কোনো রাজনৈতিক নেতার সাথে ছাত্ররা এভাবে থাকে, এরকম দাবি করতে পারবেন বলে মনে হয় না আমার।
যা হোক, এই হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার স্মৃতি।
তবে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে আমার কিছুটা দূরের মানুষ মনে হয়েছে। সেটা সবসময়ই হয়। কারণ একজন মাঠের মানুষ যখন ঘরের মধ্যে (গণভবনে) চলে গেলেন তখন মনে হলো যে, এখন তো আর সেই বঙ্গবন্ধুকে পাবো না, কারণ তিনি এখন সরকার পরিচালনা করছেন, তবে তখন দেশ নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো দুশ্চিন্তা ছিলো না, কারণ দেশের ভার তিনি গ্রহণ করেছেন। এরপর যখন তাঁকে হত্যা করা হলো তখন যে শূন্যতা অনুভব করেছিলাম তার কোনো তুলনা নেই। একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো, বিমূঢ় হয়ে যাওয়ার মতো। ওইদিনটা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। যা হোক, আনন্দ এখানে যে, তাঁকে যে একসময় অস্বীকার করার চেষ্টা করা হচ্ছিল, তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার যে চেষ্টা করা হচ্ছিল সেটা ব্যর্থ হয়েছে। আমি আগে থেকেই জানতাম যে, সেটা কখনই সম্ভব নয়। এখন তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে চিনছে, তাঁর আদর্শকে ধারণ করার চেষ্টা করছে, আমার কাছে এগুলো খুবই ভালো লাগছে। আর আরেকটা আনন্দের ব্যাপার হলো, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বেরিয়েছে, আমি মনে করি এটা জাতিকে বিভিন্ন অপ্রকাশিত ঘটনা জানাবে এবং দিক নির্দেশনা দেবে। পুনর্মুদ্রণ
>>>শ্রুতিগ্রহণ ও শ্রুতিলিখন : আমিনুল ইসলাম
১৯৬৬ সালের পর আমি প্রথম বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনেছি যখন উনি ছয় দফা’র সমর্থনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ কিংবা মিটিং করেছেন, ঠিক সেই সময়েই। তিনি গিয়েছিলেন সিলেটে। সিলেটে সেই রেজিস্ট্রি—রেজিস্ট্রি বলতে যেখানে আইনের কিছু বিষয় থাকে। সেই রেজিস্ট্রার মাঠে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই প্রথম তাঁর বাগ্মিতার সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হলো। আমরা মাঠ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। ঐ সময়ে বঙ্গবন্ধু চাইতেন না যে, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা, বিশেষ করে ছাত্ররা এতে অংশগ্রহণ করুক। এখন যে রকম পাড়ায় পাড়ায় মন্ত্রিরা গেলে স্কুল-কলেজ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, বঙ্গবন্ধু তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। ছাত্ররা গেলে তিনি খুবই বিরক্ত হতেন। তাঁর কথা ছিল যে, এ বয়সে ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে থাকবে, পড়ালেখা করবে। আর যারা ছাত্র রাজনীতি করে তারা কিছুটা বয়স হলে তারপর আসতে পারে। এজন্য একটু ভয়ে ভয়ে আমরা একটু দূরেই ছিলাম এবং আমাদের বলেই দেয়া হয়েছিল যে, আমরা যেন একেবারে সামনে না যাই। তাই আমরা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তখন এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি। তখন আমার মনে হয়েছিল, অসাধারণ একটি বক্তৃতা শুনলাম। সেখানে তিনি হাস্য-রসেরও কিছু জোগান দিয়েছিলেন। কিছুটা কৌতুক, সরস কথাবার্তা কিন্তু মূল বক্তব্যটা খুবই প্রায়োগিক ছিল। তাঁর একটি কথা এখনও আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন—‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে, আঙ্গুল ত্যাড়া করতে হয়’। এই কথায় আমরা খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন। আমার মনে আছে, জোরে জোরে হাততালিও দিয়েছিলাম। তারপর বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য শুনেছি কয়েকটি। কিন্তু আমার কানে লেগে থাকা এবং আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ শোনা ভাষণ হলো ৭ই মার্চের ভাষণ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসেই সেই ভাষণ শুনেছিলাম। বিদেশি এক রেডিওর সাংবাদিক এসেছিল। তিনি একজন দো-ভাষী খুঁজছিলেন। তার সঙ্গেই আমি গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সাংবাদিকদের যেহেতু আলাদা একটা বসার জায়গা ছিলো, আমাকে তাই সেখানে নিয়েই তিনি বসালেন। বলতে গেলে অনেকটা সামনেই ছিলাম। সেখান থেকেই আমি শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধুর সেই কাব্যিক ভাষণ। সেই সাংবাদিক একটা রেডিও বোধহয় মঞ্চে রেখে এসেছিলেন রেকর্ড করার জন্য। খাতা ছিল আমার কাছে। তিনি আমাকে বললেন, তুমি শুধু অনুবাদটা করো আমার জন্য। দুই মিনিট পর বললেন, ‘তুমি শুধু ‘কি ওয়ার্ড’ লিখে রাখো’। আমি শুধু ওই ‘কি ওয়ার্ডগুলো’ লিখে রেখেছি। প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনেছি। কিন্তু আমার শুধু মনে হচ্ছিলো এমন একটি ভাষণ আমি সারা পৃথিবীতে শুনিনি। আসলে ওই সময়টায় একটা জাদু ছিল বাতাসে। আমরা যা চাচ্ছিলাম তাই তিনি বলেছিলেন। শুধু তাই নয়, আমরা যা আশা করছিলাম আর প্রতিফলন ছিল সেই ভাষণে। এবং আমরা পরে বুঝেছি, কেন তিনি সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা করেননি। এতো বড় দায়িত্ব নিয়ে এতো বড় বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন। যা হোক, তারপর আবার যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে, ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে এলেন। ওইদিনও আমি ঢাকাতেই ছিলাম। কিন্তু একটু দেরি করে যাওয়ার ফলে পুরো বক্তৃতাটি শুনতে পারি নি। তবে যেটুকু শুনেছিলাম, তাতে মনে হয়েছে, ভাষণটি ৭ই মার্চের ভাষণ এর ধারে কাছে আসতে পারে। এটি মূলত তাঁর একটি দিক নির্দেশনামূলক বক্তৃতা ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। আর উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা তো আলাদা জিনিস। তারপর বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর দালানের উপর। আবার, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যখন আলোচনা চলছে তখন আমরা শেরাটন হোটেলের আশেপাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। কারণ তিনি মূলত এই রাস্তা ধরেই তাঁকে চলাফেরা করতে দেখতাম—৭২, ৭৩ কিংবা ৭০ সালের আগেও দেখতাম। বঙ্গবন্ধু যখন জননেতা ছিলেন, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো পদে বহাল ছিলেন না তখন তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়াটা সহজ ছিল। তাঁর ৩২ নম্বর বাসার সামনে গেলে এবং ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলে তাঁকে দেখা যেতো। কারণ তিনি বাসায় থাকলে বারান্দায় আসতেন অথবা যখন তিনি বের হতেন তখন মানুষের মাথায় হাত দিতেন। এক কথায় ভয়ানকভাবে মানুষকে ভালোবাসতেন। তাঁর চেহারার মধ্যেই একটি অন্য রকমের আকর্ষণ ছিল—গম্ভীর একজন গলার মানুষ এবং যাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই প্রখর। মানুষের জন্য তাঁর অসীম ভালোবাসা ছিলো। অনেকের নাম মনে রাখতেন। আমার খুব কষ্ট লাগে যে, আমার সমবয়সী অনেকের নাম বঙ্গবন্ধু জানতেন। কিন্তু আমি তো কখনো সামনে যাইনি তাই হয়তো আমার নাম তিনি জানতেন না। সেই অর্থে বঙ্গবন্ধুর সাথে সামনে থেকে কথাবার্তা বলার সুযোগ আমার হয়নি। অনেকের সঙ্গেই তাঁর সামনে গিয়েছি, তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে কিন্তু আমার সঙ্গে হয়নি। এখন ঐ বন্ধুরা যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের স্মৃতিকথা লেখেন তখন আমার খুবই মন খারাপ হয়। মনে মনে আক্ষেপ করে বলি, বঙ্গবন্ধু’র একটা ইন্টারভিউ তো নিতে পারতাম!
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর দায়িত্ব এবং নিরাপত্তা দুইই বেড়ে গেল। সুতরাং আগের মতো সহজেই তাঁকে পাওয়া বা দেখা যেতো না। বাড়ির সামনে গেলেই পুলিশ সরিয়ে দিতো। আর তখন মানুষের মধ্যে উৎসাহও অনেকটা কমে গিয়েছিল। কারণ স্বাধীন তো হয়েই গেছি আর বঙ্গবন্ধু তো আছেন-ই। ১০ই জানুয়ারির পর তাঁর আর কোনো বক্তৃতা আমার শোনা হয়নি। এর আগে যখন ’৬৯-এ তিনি আগরতলা মামলা থেকে বেরিয়ে আসলেন তখন তাঁর বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। অনেক ভিড় ছিল। আর আমি একটু ভিড়-টিড় এড়িয়ে চলি তো! ঠ্যেলে ঠ্যেলে সামনে যাওয়ার মানুষ আমি না। যারা সামনে গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে এবং তারা যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছে এবং হাত মিলিয়েছে সে কথাও আমি শুনেছি পরে। এই তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার স্মৃতি। বঙ্গবন্ধু সবসময় আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। এটাই ছিলো আমাদের দেশের মানুষের জন্য বিশাল একটা পাওয়া বা প্রেরণা। এমনকি ’৭১ সালে তিনি যখন পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, তখনও আমি দেখেছি মুক্তিযোদ্ধরা তাঁর নামে যুদ্ধ করেছেন, আমাদের সবারই মনে হয়েছে তিনি আমাদের মাঝে আছেন। তিনি ছিলেন অসম্ভব অনুপ্রেরণাদায়ী একজন মানুষ; যাঁর গলার স্বর থেকে হাতের আঙ্গুল বা হাত উত্তোলনের ভঙ্গি সবই তাঁর নিজস্ব। এসব কিছুই খুবই আকর্ষণীয় ছিল। আমি এ জীবনে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিকে দেখছি, তারা কেউই তার মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারী নন। তিনি একেবারে সবার অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। এসব কারণে তাঁর জন্য আমাদের হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো। আমি মনে করি তিনি একজন ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ নেতা ছিলেন, মানুষ ছিলেন। সব সময় মাথাটা উঁচু করে চলতেন। যখন তাঁর বাড়ির সামনে গিয়েছি—বিশেষ করে ’৭০-এর শেষের দিকে কিংবা ’৭১-এর মার্চে, তিনি মানুষের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়েছেন। প্রায় সবসময়ই মানুষ তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো তাঁকে দেখার জন্য। আর সবার আশা ছিল বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতে পারলে হয়তো কিছু দিক নির্দেশনা পাওয়া যাবে। তখন তো এই মোবাইল একেবারেই ছিল না। বলতে গেলে এই রেডিও, টেলিভিশন সবই ছিল পাকিস্তানিদের দখলে। আর পত্র-পত্রিকায় যেগুলো বের হতো, এই ব্রেকিং নিউজ বলতে কিছুই ছিল না। খবর জোগাড় করতে হতো। আর আমাদের সুবিধা ছিল, হলে থাকার ফলে অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যেত। বঙ্গবন্ধু কোথায় যাচ্ছেন, যখন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মিটিং তখন আমরা হল থেকে বের হতাম। মনে হয় পনেরো-কুড়ি মিনিট হাঁটলেই সেখানে চলে যেতে পারতাম। সেইজন্য সুযোগগুলো আমরা বাদ দেইনি। যখন বঙ্গবন্ধু ভিতরে আলোচনা করছেন, আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি— মনে হচ্ছে আমরা আছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এই অনুভূতিটা ঠিক বোঝানো মুশকিল। এখন কোনো রাজনৈতিক নেতার সাথে ছাত্ররা এভাবে থাকে, এরকম দাবি করতে পারবেন বলে মনে হয় না আমার।
যা হোক, এই হলো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার স্মৃতি।
তবে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে আমার কিছুটা দূরের মানুষ মনে হয়েছে। সেটা সবসময়ই হয়। কারণ একজন মাঠের মানুষ যখন ঘরের মধ্যে (গণভবনে) চলে গেলেন তখন মনে হলো যে, এখন তো আর সেই বঙ্গবন্ধুকে পাবো না, কারণ তিনি এখন সরকার পরিচালনা করছেন, তবে তখন দেশ নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো দুশ্চিন্তা ছিলো না, কারণ দেশের ভার তিনি গ্রহণ করেছেন। এরপর যখন তাঁকে হত্যা করা হলো তখন যে শূন্যতা অনুভব করেছিলাম তার কোনো তুলনা নেই। একেবারে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো, বিমূঢ় হয়ে যাওয়ার মতো। ওইদিনটা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। যা হোক, আনন্দ এখানে যে, তাঁকে যে একসময় অস্বীকার করার চেষ্টা করা হচ্ছিল, তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার যে চেষ্টা করা হচ্ছিল সেটা ব্যর্থ হয়েছে। আমি আগে থেকেই জানতাম যে, সেটা কখনই সম্ভব নয়। এখন তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে চিনছে, তাঁর আদর্শকে ধারণ করার চেষ্টা করছে, আমার কাছে এগুলো খুবই ভালো লাগছে। আর আরেকটা আনন্দের ব্যাপার হলো, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বেরিয়েছে, আমি মনে করি এটা জাতিকে বিভিন্ন অপ্রকাশিত ঘটনা জানাবে এবং দিক নির্দেশনা দেবে। পুনর্মুদ্রণ
>>>শ্রুতিগ্রহণ ও শ্রুতিলিখন : আমিনুল ইসলাম
>>বাংলা ট্রিবিউন, আগস্ট ১৫ , ২০১৯ থেকে
No comments