চলে যাওয়া ও রয়ে যাওয়া by আফজাল হোসেন

বন্ধু আরেফীন প্রথমে খবরটা জানায়। জানিয়েই শেষ নয়, মিনিট দশেকের মধ্যে সে বাসায় এসে হাজির। বোধ হয় নিজের চোখে দেখতে আসা, ঠিকঠাক আছি কি না। আমি শক্ত মনের মানুষ, এমন দাবি করার মতো যুক্তি হাতে নেই; কিন্তু এমন অনাকাঙ্ক্ষিত খবরটা কানে আসার পর মনে তেমন পরিবর্তন অনুভূত হয় না।


ফোনে নৈঃশব্দ্যের মধ্যে খানিকক্ষণ ডুবে যাওয়া, ব্যস ওইটুকুই।
সকাল থেকে ছবি আঁকছিলাম। খবরটা জেনে আবার আঁকতে বসে গেছি। আঁকা ঠিকঠাকমতো হচ্ছে দেখেই একসময় থেমেছি, এমন তো হওয়ার কথা নয়। চেয়েচিন্তে শোকগ্রস্ত হওয়া যায় না, আবার প্রিয় মানুষটা নেই, এমন দুঃসংবাদে স্বাভাবিক থাকাটা বেজায় অস্বাভাবিক।
এমন মনে হওয়ার পর রঙে গোলমাল হলো, হঠাৎ বেসামাল হয়ে গেল তুলি। ঠিক এ সময়ে ‘কই, কোথায় তুই?’ খুঁজতে খুঁজতে ঘরে ঢুকে গেল আরেফীন।
যাবি? উত্তরটা তার জানা, তবু প্রশ্ন করে।
সে চলে গেলে আমি এঘর-ওঘর করি। ওখান থেকে সেখানে, বসি, দাঁড়াই, হাঁটি। কত কী যে মনে হয়। শেষ দেখায় একটা মনে কষ্ট পাওয়া ঘটনা ঘটেছিল। সেটা মনে করে নিজেকে দোষ দিই, কেন কষ্ট পেয়েছিলাম?
একটা ঘটনার নানান দিক থাকে। নিজে যেমন করে ভাবতে চাই, তেমন ভাবা যায়, আবার চেষ্টা করলে, ইচ্ছে হলে অন্য রকম করেও ভাবা সম্ভব হয়। মানুষের বাঁধা স্বভাব, নিজের মতো করে ভেবে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হওয়া।
আমার স্ত্রী মনা ছিল উত্তরায়। তার কানে খবরটা গেলে, ফোন আসে। ফোনে কথা নেই, শুধু ক্রন্দন। আমার কিছু করার থাকে না। সম্পর্ক নিয়ে ভাবি। কোনো সম্পর্ক এমন করে কাঁদায়, কোনো সম্পর্কের ইতি ঘটলে সামান্য সময়ের বিরতি দিয়ে দিয়ে শুধু আসে দীর্ঘশ্বাস। ব্যস, রোজকার জীবনে আর কোনো পরিবর্তন আসে না।
দুপুরে সময়মতো খিদে পেয়েছে। খাওয়ার টেবিলে পছন্দের কী আছে খুঁজেছি। অকারণে একবার টেলিভিশন অন করেছি। দেখেছি, একটা চ্যানেলে পর্দার নিচে দৌড়াদৌড়ি করছে বিশিষ্ট অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির মৃত্যুর খবর। খবরের পাশে ইন্না লিল্লাহি...। উপরে দেখতে পাই, পণ্যের বিজ্ঞাপনে সুন্দরী মডেল-কন্যা নৃত্যানন্দে টেলিভিশন পর্দা রেখেছেন মুখর করে।
মনস্থির করি, কোথাও যাব না। একা থাকি, ওকে নিয়ে ভাবি। অজস্রের মধ্যে ঢুকে বন্ধুকে নিয়ে নিজের মতো ভাবা হবে না। কোথাও না গিয়ে ঘরে বসেই তো দেখা যায়, কোথায় কী ঘটছে। কী বলাবলি হচ্ছে।
একজন অসাধারণ অভিনেতাকে হারালাম কিংবা এমন অভিনেতাকে হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল—শুনব বা বলে যাব এসব কথা। এসব উচ্চারণ সময় উপযোগী কিন্তু সময় গেলে ভেবে দেখা আরও জরুরি, যে জীবন আছে তার যথার্থ মূল্য দিতে আমরা সচেষ্ট হব কি না।
যে মৃত্যুতে দাফনের প্রয়োজন পড়ে, তারও আগে মানুষের মৃত্যু ঘটে। সে মৃত্যু প্রকাশ্য নয় বলে আমাদের টের পাওয়া হয় না। মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না, যদি বলি যে মানুষ সৃজনশীল, কৃতী, অসাধারণ—তার নকল মৃত্যুকে নিয়ে আমাদের যত শোক, ছোটাছুটি, আহাজারি। তেমন মানুষের আসল মৃত্যু ঘটে তিলে তিলে দীর্ঘদিনে। তার আসল মৃত্যু ঘটে অবহেলায়, সময়ের নির্মমতায়, মনুষ্য জীবনের প্রতি মানুষের দায়িত্বহীনতায়।
শিল্পী বেঁচে থাকেন সৃজনশীল কর্মে। ধর্মহীন কর্মে আভিজাত্যের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, শিল্পীর বেঁচে থাকার সুযোগ তাহলে কোথায়?
সেই হাঁসফাঁস করে বেঁচেবর্তে থাকাকে আমরা নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করি। প্রকৃত শিল্পীকে দোষারোপ করার জন্য অসংখ্য যুক্তি, উদাহরণ আমরা হাতের কাছে পেয়েও যাই। মৃতকে নিয়ে, মৃতদেহের প্রতি আমাদের কর্তব্যে সামান্য অবহেলা থাকে না, অবহেলা শুধু জীবিতের প্রতি জীবিতদের। সংবেদনশীল মন উপেক্ষায় জীর্ণ হয়, শীর্ণ হতেই থাকে। আমরা কেবল দৃশ্যমান দেহের শীর্ণতায় চমকে উঠি।
ফরীদি হাসপাতালে, এ খবর জানার তিন দিন পর দেখতে যাওয়ার সময় হয় আমার। তবু দাবি করব, সে খুবই প্রিয় বন্ধু। দাবি করেই যাব, ফরীদি আমাকে বিশেষ মাত্রায় ভালোবাসে।
বন্ধুত্ব, শুধু এই দায়ে দারুণ একরোখা, বেয়াড়া মানুষটা আমার সঙ্গে আচরণে ছিল অন্য রকম। সিগারেট ছাড়া চলত না, তবু আমার ছায়া দেখলে লুকিয়ে ফেলত সিগারেট। অল্পবয়সীদের মতো হাত দিয়ে বাতাস করে ধোঁয়া মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত। এটাই বোধ করি সম্পর্কের শিল্পরূপ, সম্পর্কের অহংকার।
হাসপাতালে তার ৩০৭ নম্বর কেবিনে ঢুকে দেখি চেয়ারে বসা। শীর্ণ দেহ, অবিরাম কাঁশছে। হাতে সিগারেট জ্বলছে। সামনের ছোট টেবিলে কাঠের অ্যাশট্রে। এমন দৃশ্যে আমি অভ্যস্ত নই। এই প্রথম ফরীদি নির্বিকার। সিগারেট লুকানোর কোনো চেষ্টাই করেনি।
বসতে বলে, বসি। সিগারেটে একটা টানও দেয়। ওর কষ্ট পাওয়ার মতো চেহারা দেখে নয়, কষ্ট হয় সিগারেটটা সে লুকালো না এ নতুন দৃশ্য দেখে। ওর শরীর বিষয়ে শঙ্কা নয়, মনের ভেতর শঙ্কা জেগে ওঠে, আমার সঙ্গে ওর বিশেষ সম্পর্কটা কি ও গুটিয়ে ফেলেছে? শঙ্কার সঙ্গে খুব স্বার্থপরের মতো এই প্রশ্নটাও মনকে ভোগায়।
এই মর্মান্তিক অনুভব থেকে বাঁচিয়ে দিল সে, একটু পরই। মনা সঙ্গে ছিল, তার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করল ‘সরি!’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ফরীদি ফরীদির মতো করেই প্রশ্ন করে, ভাবিকে সঙ্গে এনেছিস কেন?
হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। মনে হয় সিগারেট জাহান্নামে যাক। আমরা রয়ে গেছি আমাদের মতোই।
ফিরে আসার সময় বলল, একটা নেইল কাটার পাঠিয়ে দিস তো।
বললাম, আচ্ছা। পাঠাইনি। এমন অনেক কিছুই সে বলে। বলার জন্য বলা ভেবেছি, ভাবা হয়নি, ওই নেইল কাটার ছিল আসলে অজুহাত। হয়তো ভেবেছে পরদিন নেইল কাটার নিয়ে আবার আসব। যাওয়া হয়নি।
একদিন পর ওর ফোন আসে। বিষয় নেইল কাটার নয়, ক্রিকেট। ক্রিকেট নিয়ে আমার সঙ্গে ওর কস্মিনকালেও কথা হয়নি। অবাক হই। প্রসঙ্গ দীর্ঘ হওয়ার মতো নয়। জানতে চাই, শরীর ভালো?
উত্তর আসে, আমার তো কোনো সমস্যা নেই, ভালো আছি বন্ধু। ভালো থেকো।
কথা শেষ হলো। এত অল্পে ওর সঙ্গে আগে কোনো দিনই কথা শেষ হয়নি।
খুব সামান্যে ফরীদির সঙ্গে কথা চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেল। শেষ হলে অনেক কিছু ভাবা যায়, ভাবা হয়। এই যেমন এখন ঘুরে-ফিরে মনে হচ্ছে নেইল কাটার বা ক্রিকেটের সংকেত আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বুঝতে পারলে চলে যাওয়ার আগে আমাদের শেষ দেখাটা হতো।

No comments

Powered by Blogger.