একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
১৯৯৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমি ‘একুশে ফেব্রুয়ারি সকল মানুষের কথা কয়’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখি। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার একটি ছোট প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থের আমি নাম দিয়েছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা কয়।
জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির ২৭ ধারায় বলা হয়েছে—যদি কোনো দেশে আঞ্চলিক ভাষাভিত্তিক বা ধর্মীয় এমন জনগোষ্ঠী থাকে, যারা ওই দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ, তাদের ক্ষেত্রে এই অধিকার অস্বীকার করা যাবে না, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংগতি রেখে তাদেরও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি উপভোগ, তাদের নিজস্ব ধর্ম অবলম্বন, প্রচার এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের অধিকার দিতে হবে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের জনাব রফিকুল ইসলাম ১৯৯৮ সালের ৮ জানুয়ারি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের কাছে একটা আবেদন করেন। জাতিসংঘের অফিস থেকে বিষয়টি ইউনেসকোর কাছে একটি সংস্থার পক্ষ থেকে উত্থাপন করার কথা বলা হয়। জনাব রফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী আবদুস সালাম মাদার ল্যাঙ্গোয়েজেস অব দ্য ওয়ার্ল্ড—বিশ্বের মাতৃভাষা নামের একটি সমিতি গঠন করেন। সমিতির পক্ষ থেকে ১০ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর-সংবলিত সাতটি ভাষায় লিখিত একটি আবেদন ইউনেসকোর শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মিসেস আনা মারিয়ার কাছে পেশ করা হলে তিনি ওই সমিতিকে জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়, তবে যদি কোনো সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়, তাহলে ব্যাপারটি বিবেচনা করা যেতে পারে। এরপর রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষাসচিব কাজী রকীবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক সাহেবের মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে তিনি তৎক্ষণাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তা উত্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে বেশ উৎসাহ বোধ করেন। সময় বাড়ন্ত থাকায় মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের অপেক্ষা না করে প্রস্তাবটি প্যারিসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যথাসময়ে শিক্ষামন্ত্রী প্যারিসে পৌঁছে ইউনেসকোর কাছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য প্রস্তাব পেশ করেন।
বাংলাদেশসহ মোট ২৭টি দেশ সেই প্রস্তাবে শরিক হয়। অন্য দেশগুলো হচ্ছে—ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ওমান, কমোরো দ্বীপপুঞ্জ, কোৎ দ্য ইভোয়ার, গাম্বিয়া, ডোমিনিকান রিপাবলিক, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, প্যারাগুয়ে, ফিলিপাইন, বাহামা, বেনিন, বেলারুশ, ভানুয়াতু, ভারত, মাইক্রোনেশিয়ান ফেডারেশন, মালয়েশিয়া, মিসর, রাশিয়া, লিথুয়ানিয়া, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, সিরিয়া ও হন্ডুরাস। যে দিনটি বিশেষ করে শুধু বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেই দিনটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের তেমন কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। তারা প্রস্তাবের পক্ষে প্রথমে সায় দেয়নি। পরে ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরে শ্রমিক-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে যে সারা পৃথিবীতে মে দিবস পালিত হচ্ছে, তার নজির উত্থাপন করা হলে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ক্ষীণ আপত্তিটুকু আর তেমন জোর পায় না। আলাপ-আলোচনা ও বৈঠক-সংলাপের পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সর্বসম্মতভাবে ইউনেসকোর প্রথম ও দ্বিতীয় কমিশন বাংলাদেশের প্রস্তাব মেনে নেয়।
প্রকাশভঙ্গি ও প্রকাশের বিষয়বস্তুর সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক এমনই গভীর যে সত্যিকার অর্থে বাকস্বাধীনতা বিপন্ন বা বিনষ্ট হয়, যদি কাউকে তার ইচ্ছামতো ভাষা ব্যবহার করতে দেওয়া না হয়। ভাষা একটি কেবল প্রকাশমাধ্যম নয়। প্রকাশের বিষয় ও বক্তব্যকে ভাষা রূপ, রস ও রঙ্গে অর্থবহ করে তোলে। ভাষা একটি জাতির সাংস্কৃতিক স্বারূপ্যের নিদর্শন। ভাষা একজন মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিমানসের পরিচয় দেয়।
জগৎসভায় একুশে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য একটি অহঙ্কারের বিষয়, একটি বড় আত্মপ্রসাদের কথা। বহু দেশে মাতৃভাষার জন্য বহু মানুষকে নানা লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। সারা বিশ্বের মাতৃভাষার সঙ্গে জগৎসভার যে যোগসূত্র হলো, তার পেছনে রয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের আত্মদান। আমরা এ প্রসঙ্গে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে যে বাঙালিরা বিশ্বের মাতৃভাষার পক্ষে প্রথমে সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তাঁদের অভিনন্দন জানাই।
একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ফলে আমাদের দায়িত্ব গেল বেড়ে। নিজের মাতৃভাষার উন্নয়নে আমাদের সর্ববিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মাতৃভাষার দৈন্য মোচন করতে হবে, যাতে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে এবং আমরা বিশ্বের দরবারে নিজেদের জানান দিতে পারি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মাতৃভাষার ব্যবহার ও স্বীকৃতির জন্য যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কর্মকাণ্ডে আমরা সহযোগিতা করব এক গভীর ঐকাত্ম্যবোধে।
বাংলাদেশে ২০টা ভাষায় মানুষ কথা বলে। সারা দেশে পাঁচটি লিপি ব্যবহার হচ্ছে। আদিবাসী ও উপজাতিদের ভাষা সংরক্ষণ করার জন্য ইউনেসকোর ভাষাবিষয়ক প্রকল্প ও পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের জনাব রফিকুল ইসলাম ১৯৯৮ সালের ৮ জানুয়ারি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের কাছে একটা আবেদন করেন। জাতিসংঘের অফিস থেকে বিষয়টি ইউনেসকোর কাছে একটি সংস্থার পক্ষ থেকে উত্থাপন করার কথা বলা হয়। জনাব রফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী আবদুস সালাম মাদার ল্যাঙ্গোয়েজেস অব দ্য ওয়ার্ল্ড—বিশ্বের মাতৃভাষা নামের একটি সমিতি গঠন করেন। সমিতির পক্ষ থেকে ১০ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর-সংবলিত সাতটি ভাষায় লিখিত একটি আবেদন ইউনেসকোর শিক্ষাবিষয়ক প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মিসেস আনা মারিয়ার কাছে পেশ করা হলে তিনি ওই সমিতিকে জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়, তবে যদি কোনো সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়, তাহলে ব্যাপারটি বিবেচনা করা যেতে পারে। এরপর রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষাসচিব কাজী রকীবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেক সাহেবের মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে তিনি তৎক্ষণাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তা উত্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে বেশ উৎসাহ বোধ করেন। সময় বাড়ন্ত থাকায় মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের অপেক্ষা না করে প্রস্তাবটি প্যারিসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যথাসময়ে শিক্ষামন্ত্রী প্যারিসে পৌঁছে ইউনেসকোর কাছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য প্রস্তাব পেশ করেন।
বাংলাদেশসহ মোট ২৭টি দেশ সেই প্রস্তাবে শরিক হয়। অন্য দেশগুলো হচ্ছে—ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ওমান, কমোরো দ্বীপপুঞ্জ, কোৎ দ্য ইভোয়ার, গাম্বিয়া, ডোমিনিকান রিপাবলিক, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, প্যারাগুয়ে, ফিলিপাইন, বাহামা, বেনিন, বেলারুশ, ভানুয়াতু, ভারত, মাইক্রোনেশিয়ান ফেডারেশন, মালয়েশিয়া, মিসর, রাশিয়া, লিথুয়ানিয়া, শ্রীলঙ্কা, সৌদি আরব, সিরিয়া ও হন্ডুরাস। যে দিনটি বিশেষ করে শুধু বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেই দিনটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের তেমন কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। তারা প্রস্তাবের পক্ষে প্রথমে সায় দেয়নি। পরে ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরে শ্রমিক-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা প্রাণোৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশে যে সারা পৃথিবীতে মে দিবস পালিত হচ্ছে, তার নজির উত্থাপন করা হলে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ক্ষীণ আপত্তিটুকু আর তেমন জোর পায় না। আলাপ-আলোচনা ও বৈঠক-সংলাপের পর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সর্বসম্মতভাবে ইউনেসকোর প্রথম ও দ্বিতীয় কমিশন বাংলাদেশের প্রস্তাব মেনে নেয়।
প্রকাশভঙ্গি ও প্রকাশের বিষয়বস্তুর সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক এমনই গভীর যে সত্যিকার অর্থে বাকস্বাধীনতা বিপন্ন বা বিনষ্ট হয়, যদি কাউকে তার ইচ্ছামতো ভাষা ব্যবহার করতে দেওয়া না হয়। ভাষা একটি কেবল প্রকাশমাধ্যম নয়। প্রকাশের বিষয় ও বক্তব্যকে ভাষা রূপ, রস ও রঙ্গে অর্থবহ করে তোলে। ভাষা একটি জাতির সাংস্কৃতিক স্বারূপ্যের নিদর্শন। ভাষা একজন মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিমানসের পরিচয় দেয়।
জগৎসভায় একুশে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য একটি অহঙ্কারের বিষয়, একটি বড় আত্মপ্রসাদের কথা। বহু দেশে মাতৃভাষার জন্য বহু মানুষকে নানা লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। সারা বিশ্বের মাতৃভাষার সঙ্গে জগৎসভার যে যোগসূত্র হলো, তার পেছনে রয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের আত্মদান। আমরা এ প্রসঙ্গে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে যে বাঙালিরা বিশ্বের মাতৃভাষার পক্ষে প্রথমে সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তাঁদের অভিনন্দন জানাই।
একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ফলে আমাদের দায়িত্ব গেল বেড়ে। নিজের মাতৃভাষার উন্নয়নে আমাদের সর্ববিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মাতৃভাষার দৈন্য মোচন করতে হবে, যাতে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে এবং আমরা বিশ্বের দরবারে নিজেদের জানান দিতে পারি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মাতৃভাষার ব্যবহার ও স্বীকৃতির জন্য যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কর্মকাণ্ডে আমরা সহযোগিতা করব এক গভীর ঐকাত্ম্যবোধে।
বাংলাদেশে ২০টা ভাষায় মানুষ কথা বলে। সারা দেশে পাঁচটি লিপি ব্যবহার হচ্ছে। আদিবাসী ও উপজাতিদের ভাষা সংরক্ষণ করার জন্য ইউনেসকোর ভাষাবিষয়ক প্রকল্প ও পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে।
No comments