স্বর্গের রানী...

গল্পটির খোঁজ পাওয়া যায় একটা প্রত্নতাত্তি্বক অভিযানের মাধ্যমে। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার নানা দিক সম্পর্কে জানতে গিয়ে সন্ধান মেলে প্রাচীন এক লিপিচিত্রের। এ লিপির বয়স চার হাজার বছর। সেটিরই কিছু অংশজুড়ে লেখা ছিল একটা কবিতা। সেখানে উল্লেখ আছে, শাসনকর্তা হয়ে পৃথিবীকে শান্তির পথ দেখাতে চেয়েছিলেন দেবী ইনান্না। স্বর্গ থেকে আইন আর ঐশ্বরিক শক্তি নিয়ে এসে তিনি তা পুরো পৃথিবী ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।


ইনান্নাকে বলা হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবী। তার আরেকটি নাম এসথার। পুরাণের ধারায় এসথারকে ভালোবাসার দেবী বলেই চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু সাধারণের কাছে তিনি 'স্বর্গের রানী'। দেবী বা রানী যে যা-ই বলুক, এসথারকে নিয়ে রচিত গল্পটি যেমন বিচিত্র তেমনটি আকর্ষণীয়ও।
সভ্যতার শুরুর দিকে নানা ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা ছিল। এসথার বেদনা নিয়ে সে বিশৃঙ্খলা অনুভব করতেন। মানুষের জন্য তিনি অনেক কিছু করতে চাইতেন। সব ভেবে ভেতরে ভেতরে দারুণ অস্থির হয়ে উঠলেন এক সময়। রানীর মুকুট মাথায় দেওয়ার পরও সেই অস্থিরতা কমল না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ঈশ্বর বা তার প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করবেন। এসথারের বাবা ইনকির সঙ্গে স্বর্গের অনেকেরই ভাব ছিল। ইনকি জানতেনও, কীভাবে স্বর্গ থেকে ক্ষমতা আর ঐশ্বরিক শক্তি পৃথিবীতে নিয়ে আসা যায়। প্রাচীন সেই কবিতায় এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে, 'ইনান্না, ভালোবাসার দেবী পৃথিবীর মুকুট তুলে নিজের মাথায় বসালেন। তারপর আপেল গাছে হেলান দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, তড়িডুর সাথে দেখা করবেন...।'
শেষ পর্যন্ত এসথার তার বাবা ইনকির মাধ্যমেই স্বর্গের আইন ও ঐশ্বরিক ক্ষমতা পাওয়ার চেষ্টা করলেন। তখন স্বর্গের আইন ও ঐশ্বরিক ক্ষমতার শক্তির আধারকে 'মি' বলা হতো। 'মি' সহজে পাওয়া যাবে না_ এটা বুঝে এসথার ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করলেন। এরপর এসথার পবিত্র প্রার্থনালয়ে গেলেন। সেখানে ইনকি তাকে স্বর্গের টেবিলে বসে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। এসথার তো এটাই চাইছিলেন। স্বাভাবিকভাবে চাইলে হয়তো বাবা কখনই তাকে 'মি' দেবেন না। তাই নেশা জাতীয় স্বর্গীয় পানীয় খাইয়ে 'মি' আদায় করা ছিল তার লক্ষ্য। এসথার ভান করলেন তিনি পানীয় খাচ্ছেন। এদিকে তার অনুরোধে ইনকা সে পানীয়ের পাত্র একের পর এক খালি করতে থাকলেন। নেশায় বিভ্রান্ত হয়ে ইনকি খাবার টেবিলে বসেই এসথারকে একের পর এক স্বর্গীয় ক্ষমতা দিতে শুরু করলেন। পুরাণে আছে, এভাবে কৌশলে ইনকার মাধ্যমে এসথার প্রায় ১০০টি শক্তি সংগ্রহ করতে সম্ভব হলেন। এর মধ্যে ছিল রাজকীয় সিংহাসন, ভালোবাসার কৌশল, শক্তি নিয়ন্ত্রণ,বিচারিক জ্ঞান ইত্যাদি। এসব সংগ্রহ করে এসথার দ্রুত স্বর্গ ত্যাগ করেন। নেশা কেটে যাওয়ার পর ইনকা হতভম্ব হয়ে দেখলেন, তার বেশিরভাগ ক্ষমতাই উধাও হয়ে গেছে! ভৃত্য ইশিমাতের কাছে ইনকা ঘটনার বিস্তারিত জেনে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তিনি আদেশ করলেন, এসথারের কাছ থেকে সব ফিরিয়ে আনতে। ইশিমাত পৃথিবীতে গিয়ে অনেক অনুরোধ করেও 'মি' ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে এসথারকে রাজি করাতে পারলেন না। অবশেষে ইনকি ক্রুদ্ধ হয়ে ছয়টি ভয়ঙ্কর অপদেবতাকে পাঠিয়ে দিলেন তাকে শায়েস্তা করতে। এদিকে এসথারও কম যান না। তখন তার অনেক ক্ষমতা। তিনি নিনশুবুর নামে এক বিশ্বস্ত সেবককে আদেশ দিলেন ব্যবস্থা গ্রহণের। নিনশুবুর নিজের হাত দিয়ে বাতাস ফালি ফালি করে এক বিচিত্র অবস্থা তৈরি করেন। এর ফলে অপদেবতারা স্বর্গে ফিরে যেতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এসথার অনুভব করেন, স্বর্গীয় ক্ষমতা মানুষের হাতে না থাকাই ভালো। পরে তিনি নিজে স্বর্গে গিয়ে পবিত্র মন্দিরে 'মি' ফিরিয়ে দেন। এই মহান রানীর স্মৃতির উদ্দেশে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭৫ অব্দে সম্রাট নেবুচাদ নেজার ব্যাবিলনে এসথার গেট নির্মাণ করেন, যা আজও অক্ষত আছে।
আমির খসরু সেলিম

No comments

Powered by Blogger.