খোলা হাওয়া-ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ভাষার মাসে বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক চর্চা আমাদের ভাবায়। শুদ্ধবাদীরা শঙ্কিত হন, বাংলা ভাষা তার রূপ হারিয়ে কোন শংকর ভাষায় রূপ নেয়, তা ভেবে। অন্যদিকে, শুদ্ধবাদীদের অবস্থানকে যাঁরা রক্ষণশীল এবং পরিবর্তন-বিরোধী বলে চিহ্নিত করেন, তাঁরা বলেন, এত ভাবাভাবির কী আছে, ভাষা চলবে ভাষার মতো, এর ব্যবহারে-প্রয়োগে পরিবর্তন আসবে ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রকাশের প্রয়োজনেই।


দুই পক্ষের ভাবনাতেই সত্য আছে—বাংলা ভাষা যে সত্যি সত্যি একটা মিশ্র ভাষা হয়ে যাচ্ছে, এবং এর নানা স্থানচ্যুতি ঘটছে, এ কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার শুদ্ধতার চিন্তায় ভাষার নিজস্ব বাঁক ফেরা, নতুন নতুন শব্দ ও পদ গ্রহণ এবং পুরোনো অনেক শব্দ ও পদ বর্জন এবং সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতির বৃহত্তর ডিসকোর্স বা আখ্যানের প্রকাশগুলো তুলে ধরতে এর নানা পালাবদলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়াতেও যুক্তি নেই।
ভাষা একটি নদীর মতো—নিজের গতিতে চলে, নিজের মতো একূল-ওকূল ভাঙে-গড়ে, বাঁক নেয়, তারপর গিয়ে পড়ে মানবের ভাষাসমগ্রের সমুদ্রে। যাঁরা শুদ্ধবাদীদের অবস্থানকে অনর্থক উদ্বিগ্নতার প্রকাশ হিসেবে দেখেন, তাঁরা ভাষাকে নদীর মতোই দেখেন। নদীতে বাঁধ দিয়ে তাকে শাসন করলে কী হয়, আর কেউ না হলেও, বাংলাদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে তা জানে। ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া অনেক নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে সেগুলোকে পঙ্গু করে ফেলেছে, এতে তো সন্দেহ নেই; কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরের অসংখ্য নদীকে, বুড়িগঙ্গাকে যেমন আমরাই কি দূষণে দূষণে ধ্বংস করে দিচ্ছি না? যাঁরা বুড়িগঙ্গাকে গত কুড়ি বছর দেখেননি, তাঁদের নদীটিতে একবার যেতে বলি। এবং গিয়ে যদি এর পানিতে আপনারা একটা হাত ডোবান, দেখবেন হাতের মাংস ঝরে শুধু কঙ্কালটুকু ওঠে আসবে। একটু হয়তো বাড়িয়ে বললাম—কিন্তু বুড়িগঙ্গার দূষণ-চিত্রটি এমনই ভয়াবহ যে একে দেখলে এখন নদীপ্রেমীদের কান্না পায়।
ভাষাকে নদীর সঙ্গে আমরা তুলনা করি; কিন্তু আমাদের এই ভাষানদীকে আমরা যে দূষিত করছি প্রতিদিন, তা নিয়ে কি ভাবি? একটি দূষিত নদী যখন সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, সমুদ্রও তো বিপদগ্রস্ত হয়, তাহলে বাংলা ভাষার দূষিত নদী মানব ভাষাসমগ্রের সমুদ্রে পড়ে কী অবদান রাখছে তার স্রোত আর চরিত্র গঠনে, কে জানে। এই দূষিত নদীকে সেই ভাষা সমগ্রসমুদ্র খুব সমীহের চোখে দেখবে, তা বলা যাবে না। তবে সান্ত্বনা—যদি তাকে সান্ত্বনা হিসেবে নেন বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক রূপবদলের প্রবল সমর্থকেরা—হলো এই যে এ রকম দূষণে পড়েছে এই উপমহাদেশের অন্য কটি ভাষাও।
বাংলা ভাষা এখন প্রতিদিনের চর্চায় কী দাঁড়িয়েছে, তার কিছু উদাহরণ, ওই ভাষার মাসের শুরুতে নানা মাধ্যম ও জায়গায় আমার শোনার অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরছি। এই উদাহরণগুলো শুদ্ধবাদ ও যা হবে-তা-হবে বাদের মধ্যে বিতর্কটা আরেকবার হয়তো মনে করিয়ে দেবে। কিন্তু এভাবেই যদি বাংলা ভাষা এগোয়, নদীর মতো অবধারিতভাবে, তা হলে বাংলা ভাষার আরেকটা নাম আমাদের তৈরি করে নিতে হবে। এর নাম আমরা বাংহিংলিশ বা এ রকম কিছু দিতে পারে, যেহেতু বাংহিংলিশে বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দির একটা চমৎকার সহঅবস্থান রয়েছে। এতে সুবিধা হবে, শুধু ফেব্রুয়ারি মাসটা এলে আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবব, বাকি নয় মাস বাংহিংলিশের সেবায় নিয়োজিত থাকব।
তবে অধিক আলোচনার আগে তিনটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক
১. ঢাকার স্টক মার্কেট-বিপর্যয় এখন অনেকের কাছে উদ্বেগের কারণ। এ রকম এক উদ্বিগ্ন স্টক-মার্কেট বিশেষজ্ঞ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বললেন ‘স্টক মার্কেট ক্রাইসিসের রিজনগুলো ইনভেস্টিগেট করতে হবে। যেসব বিগ এ্যাক্টর ও প্লেয়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে রোল প্লে করছে, যাদের নাম ইব্রাহিম সাহেব তাঁর রিপোর্টে রিভিল করেছেন, তাদের প্রপার পানিশমেন্ট দিতে হবে।’
২. কলাভবনে আমার কক্ষের বাইরের বারান্দায় দাঁড়ানো কিছু ছেলেমেয়ে খুব গণ্ডগোল করছিল। আমি বেরিয়ে তাদের কারণ জিজ্ঞেস করলে একটি মেয়ে বলল, ‘স্যার, আমাদের টিসার হঠাৎ ক্লাস পসপোন করে দিছে। সে তো একটা নোটিশ দিলে পারত।’
আমি আর ভয়ে শিক্ষকের নাম জিজ্ঞেস করলাম না। আমার থেকে বয়সে বড় শিক্ষকও অনেক আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে!
৩. একটি এফএম রেডিও থেকে এক আরজের আপ্লুত আহ্বান শোনা গেল এক দুপুরে, ‘ফ্রেন্ডসরা, এই অফার কিন্তু ভ্যালিড টিল ফর্টিনথ। সো মনে রেখো। লাইক ইটস আ ফাটাফাটি ইভেন্ট। সো সেন্ড করো...’
এই তিন উদাহরণ বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই, বরং স্টক মার্কেট বিশেষজ্ঞের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য তাঁর একটি অবস্থান গ্রহণের জন্য—তাঁর পরামর্শগুলোও মূল্যবান এবং তাঁর পর্যবেক্ষণ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বলে আমার মনে হয়েছে। আমার কক্ষের বাইরের বারান্দায় দাঁড়ানো মেয়েটির প্রতি আমার সহানুভূতি—হয়তো অনেক দূর থেকে এসে শুনেছে ক্লাস হবে না। এ জন্য সে উত্তেজিত হতেই পারে। এবং আরজে মেয়েটি নিশ্চয় তাকে যেমন বলা হয়েছে, তেমনটা করছে, সে বরং চেষ্টা করছে তার কথাগুলো প্রাণবন্ত করে উপস্থাপনা করতে। সমস্যাগুলো তাই ব্যক্তির থেকেও বেশি চর্চার। বাংলা ভাষায় ইংরেজির উদার অনুপ্রবেশ আজকের নয়, এবং শুধু ইংরেজি নয়, বাংলা ভাষা ১০ হাজারের মতো আরবি-ফার্সি শব্দও নিয়েছে। এ রকম শব্দ নেওয়ার চর্চা সব ভাষাতেই আছে। ইংরেজি নিয়েছে লাতিন, ফরাসি এমনকি হিন্দি-উর্দু থেকে, ফরাসি নিয়েছে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষা থেকে। এই গ্রহণপ্রক্রিয়া ভাষার হয়ে ওঠার একটি উপাদান। কিন্তু এই গ্রহণ এমন কোনো পর্যায়ে ভাষাকে নিয়ে যায় না, যেখানে ভাষার মৌল চরিত্রই বদলে যায় বা ভাষা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, মিশ্র ভাষায় রূপ নেয়। বাংলা ভাষায় এখন ‘কিন্তু’র জায়গায় ‘বাট’ এসে গেছে। ‘কাজেই’ না বলে আমরা বলি ‘সো’ এবং ‘যেমন’ না বলে বলি ‘লাইক’। বাংলা ভাষায় টেবিল-চেয়ার পুরোনো কর্জ; যেমন ফটোকপি, মোবাইল, মডেম, নতুন কর্জ, এগুলো নতুন নতুন পণ্য ও সেবা বিজ্ঞানের নানা উপাদান। প্রযুক্তি বা খাদ্যবস্তু ইত্যাদির ভিনদেশি নাম বা বর্ণনাসূচক। এগুলো আমরা তৈরি করিনি, কাজেই যে দেশে তৈরি হয়েছে, সে দেশে যে নামে ছিল, সে নামেই আমরা তাদের ডাকতে পারি। পিৎজাকে আমরা পিৎজা বলেই অভিহিত করব। বার্গারকে বার্গার। ফ্যাক্সকে আমরা আর কী বলব ফ্যাক্স ছাড়া? কিন্তু ফ্যাক্সযোগে আমরা যদি কোনো চিঠি পাঠাই, তাহলে সেই প্রক্রিয়া বর্ণনা করার জন্য বাংলায় যে যথেষ্ট শব্দ আছে, বাক্য বানানোর রীতি আছে, সেগুলো কেন ব্যবহার বা অনুসরণ করব না? কেন বলব ফ্যাক্সটা সেন্ট করো? বন্ধুরা না বলে ফ্রেন্ডস কেন বলব? বিপর্যয় না বলে ক্রাইসিস কেন বলব? কোন যুক্তিতে?
ভাষার শুদ্ধতা নিয়ে কেউ কথা বললে আজকাল অনেকে তাকে সন্দেহের চোখে, কোনো কোনো সময় করুণার চোখে দেখেন। তাঁদের ধারণা, লোকটি প্রতিক্রিয়াশীল, তারুণ্যবিরোধী, অনাধুনিক এবং হয়তো মধ্যযুগীয়। তাঁরা বলেন, লোকটি ‘আনস্মার্ট’। দুঃখের বিষয়, স্মার্টনেসের সংজ্ঞাটি তাঁরা ভুল জায়গায় প্রয়োগ করেন। চীনে দেখেছি, একটাও হংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে অনর্গল কথা বলছে লোকজন। এক ইংরেজি জানা চীনা তরুণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আসলেই কি সে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছে না, নাকি ইংরেজি শব্দ চীনা উচ্চারণে ইংরেজিত্ব হারিয়েছে। সে হেসে বলেছিল, চীনা ভাষা এতই সমৃদ্ধ যে কদাচিৎ বিদেশি ভাষার আমদানি প্রয়োজন হয়। তথ্যপ্রযুক্তির নতুন নতুন শব্দ-পদকে তারা চেষ্টা করে চৈনিক প্রতিশব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে। তরুণটির ভাষ্য অনুযায়ী এ রকম নতুন শব্দের চীনা প্রতিশব্দ যারা তৈরি করে এবং ব্যবাহার করে তাদেরকে সবাই সমীহের চোখে দেখে। অর্থাৎ তারাই স্মার্ট। এ রকম স্মার্ট হওয়ার জন্য কি না কে জানে, ইংরেজি বিভাগে আমাদের এক চীনা ছাত্রী যখন বাংলা বলে, চেষ্টা করে সুন্দর বাংলায় বলতে। যতটা সম্ভব বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে।
বাংলা বিকৃতির যে তিনটি উদাহরণ আমি দিয়েছে, সেগুলোর দিকে তাকালে আমরা সহজেই বুঝতে পারব, এগুলো টেবিল-মোবাইল-পিৎজার মতো সহজ এবং অবধারিত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ নয়, বরং অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত পরিবর্তনের কিছু নমুনা। এই পরিবর্তন বাংলার কাঠামোকেই দুর্বল করছে, ক্ষতিগ্রস্ত করছে এর চরিত্রকে, এর স্বাভাবিক প্রকাশকে। এ গ্রহণ অনেকটা যেন বশ্যতা স্বীকারের মতো, নিজের দুর্বলতা এবং অক্ষমতা থেকে যার উৎপত্তি এবং এর মূলে রয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা, আমাদের পরিবারগুলোর উদাসীনতা, পড়ার সংস্কৃতির পিছু হটা ও দৃশ্য মাধ্যমের প্রাবল্য এবং টেলিভিশনের বিস্তার। এ এক এমন সংকট যা থেকে পরিত্রাণ না পেলে বাংলা ভাষা একসময় ওই বাংহিংলিশ ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
তিনটি উদাহরণের প্রথমটিতে যেসব ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন বিশেষজ্ঞ, তার প্রতিটির সুন্দর এবং প্রচলিত বাংলা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার না করতে করতে তিনি হয়তো ভুলে গেছেন। অথবা ইংরেজি শব্দগুলো তৈরি হয়েই থাকে, জিবের ডগায় অজান্তে চলে আসে বাংলা শব্দগুলোকে ঠেলেঠুলে। বিশেষজ্ঞ অন্য যেসব বিশেষজ্ঞ বা অ-বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁরাও এ রকম ইংরেজিশাসিত বাংলায় কথা বলেন, ফলে এই ভাষাটিই তার মুখের ভাষা হয়ে গেছে। তরুণেরা যেমন একে অন্যের দেখে ইংরেজি শব্দনির্ভর এবং অদ্ভুত উচ্চারণের বাংলা বলে, তেমনি বয়স্করাও ইংরেজির সাহায্য নেন। হয়তো অনেকে এই চটজলদি পাঁচমিশালি ভাষাকে স্মার্ট বিবেচনা করেন, কে জানে।
দ্বিতীয় উদাহরণে বিরক্ত মেয়েটি যে শিক্ষক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলতে পারত—এ রকম তুমিসুলভ বর্ণনা দিল, করেছেন বা বলতে পারতেন না বলে, তাতেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য এবং পরিবারগুলো অমনোযোগিতার একটা ছবি ভেসে ওঠে। আমি প্রচুর তরুণকে দেখেছি আপনি বা সম্মানসূচক সম্বোধনটা করতেই শেখেনি। আমার এক সহকর্মী জানালেন, ভর্তিচ্ছু এক ছাত্র কক্ষে ঢুকে তাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘মামা ডিনের অফিসটা কুনহানে?’ গণতন্ত্রের এই মহান যুগে আমরা হয়তো আপনি-তুমির প্রভেদটা ভুলে গেছি।
তৃতীয় উদাহরণে আরজে মেয়েটি এক সম্প্রতি প্রবর্তিত চর্চার পুনরাবৃত্ত করছে এবং করতে করতে এটিকে খিচুড়িপনার দিকে একধাপ এগিয়ে নিচ্ছে। এফএম রেডিও একটি মাত্র ব্যতিক্রম বাদে, এখন একটি সম্মিলিত ‘স্মার্ট’ সংস্কৃতি চালু করেছে, যেখানে ইংরেজি শব্দ—তা রাস্তার হোক, অভদ্রজনোচিত হোক—যত ইচ্ছা লাগাতে হবে বাংলাকে উচ্চারণ করতে হবে ইংরেজির মতো করে। আর এমন একটা ভাব দেখাতে হবে যে বাংলা ভাষাটা এ রকম উচ্চারণ করলেই তরুণেরা উন্নত প্রযুক্তির যোগাযোগের এই যুগে প্রবেশ করবে। ওই রোগ কলকাতার এফএম রেডিওগুলোকে পেয়ে বসেছে। শুরুতে কাঠমান্ডুর এফএম রেডিও কেন্দ্রগুলোকে ভুগিয়েছিল যদিও এখন সেগুলো অনেকটাই এ রোগ কাটিয়ে উঠেছে।
এফএম রেডিও পণ্য সংস্কৃতির বাহক ও প্রচারক এবং এদের উদ্দিষ্ট সেই তরুণসমাজ যারা এখনই পণ্য সংস্কৃতির শিকার না হলেও শিকার হওয়ার রাস্তায় আছে। এফএম সংস্কৃতির উদ্দেশ্য হচ্ছে এই সমাজকে তার ভাষা ভুলিয়ে দিয়ে এমন একটি শূন্যতা সৃষ্টি করা যেখানে পণ্যের চমক প্রতিফলিত হবে ভাষার চমক বা স্মার্টনেসে এবং সে ভাষাটি যে নিজের করে নেবে। এফএম সংস্কৃতির বাইরে যে স্মার্টনেস দেখাচ্ছে তা এর পণ্য বিক্রির প্রয়োজনে। আজ আমরা এই সংস্কৃতি লুফে নিচ্ছি, বাংলাকে বিকৃত করছি এবং বলছি এতে দোষের কী? এটা তো তরুণদেরই ভাষা।
বাংলা ভাষায় যে বিকৃতি এখন চলছে তা এই ভাষাকে পরাধীন ও নির্জীব করবে এবং ভেতরের সৃষ্টিকল্পনা তিরোহিত করবে। ভাষা যখন তার সৌন্দর্য এবং কাঠামোর গতিশীলতা হারায় অন্য ভাষার অভিধান (রাস্তার ভাষার অভিধানসহ) ছাড়া এক পা চলতে পারে না এবং চললেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এই ভাষায় কি দর্শনের গূঢ় চিন্তাগুলো প্রকাশ করা যায়? না আমাদের সমাজ নিরীক্ষা বা বিজ্ঞানের বিষয়গুলো?
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এই মার খাওয়া ভাষা তো মুখের ভাষা, এ তো লিখিত নয়, তাহলে এত ভাবনা কেন? এর উত্তরে বলা যায়, যে জাতির মুখের ভাষা এখন মার খাওয়া, শংকর শ্রেণীর, সে জাতির লেখার ভাষাও দুর্বল হয়ে পড়ে, কারণ এর ব্যবহারকারীদের চিন্তাও তখন অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে। এর নমুনা তো ইতিমধ্যেই দেখছি।
ভাষা একটি জাতির প্রাণ—এর অনেক রূপ আছে: আঞ্চলিক, প্রমিত, প্রতিদিনের ব্যবহারের। কিন্তু এর একটা রূপ যদি হয় একেবারে জগাখিচুড়ি, মিশ্র, বিকৃত, মার খাওয়া এবং তরুণদের যদি ব্যাপকহারে তা গ্রহণ করতে হয় তখন একটা উদ্বেগ তৈরি হয় বটে।
ব্যাপারটা স্মার্ট না হলেও।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.