বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৮৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মো. বজলুল গণি পাটোয়ারী, বীর প্রতীক মুহূর্তে কেটে গেল তাঁর অনভ্যস্ততা মো. বজলুল গণি পাটোয়ারীর জীবনের প্রথম প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ছিল কামালপুরের যুদ্ধ। সে দিন তিনি তাঁর অস্ত্র চালাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তাঁর মাথার ওপর দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ একটি গুলি লাগে তাঁর পেছনে থাকা এক সহযোদ্ধার বুকে।


তাঁর চোখের সামনে মাটিতে ঢলে পড়েন ওই সহযোদ্ধা। এ দৃশ্য দেখে ভয় পেলেন না। বরং দীর্ঘদিন অস্ত্র না চালানোর অনভ্যস্ততা তাঁর কেটে গেল। মনে জেদও চাপল। তারপর বিরামহীনভাবে অস্ত্র চালাতে থাকলেন।
বজলুল গণি পাটোয়ারী এরপর যুদ্ধ করেন অনেক স্থানে। তাঁর জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ ছিল ১৪ ডিসেম্বর এমসি কলেজে। সেদিন তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দলের সামনে হঠাৎ এসে থামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আর্টিলারি গান ও দুটি জিপের কনভয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সহযোদ্ধাদের বলেন গোলাবর্ষণ করতে। মর্টারের গোলায় জিপে আগুন ধরে যায়। হকচকিত পাকিস্তানি সেনারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এ সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। তারপর সেখানে শুরু হয় তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে সীমান্ত এলাকা থেকে অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধারা ১৩ ডিসেম্বর রাতে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজসংলগ্ন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থানের মুখোমুখি হন। মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের ৫০০ গজ দূরে টিলার ওপর। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ডি’ (ডেলটা) কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন মো. বজলুল গণি পাটোয়ারী। তাঁদের কাছাকাছি ছিল লেফটেন্যান্ট হাফিজউদ্দীন আহমদের (বীর বিক্রম, পরে মেজর) নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বি’ (ব্রাভো) কোম্পানি।
পাকিস্তানি সেনারা সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি চিন্তা করেনি। কারণ, তখন খাদিমনগরে যুদ্ধ চলছিল। সেই প্রতিরক্ষা অবস্থানের ভেতর দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এত তাড়াতাড়ি সিলেট শহরে প্রবেশ করবেন, তা তারা কল্পনাও করেনি। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক, হেলমেট ও অস্ত্রশস্ত্রও ছিল দেখতে পাকিস্তানি সেনাদের মতোই। এতে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ দলেরই বলে ধারণা করেছিল। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা চিৎকার করে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা জবাব না দিয়ে নীরবে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে অবস্থান নিতে থাকেন। সকালে মো. বজলুল গণি পাটোয়ারীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের সামনের রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি গান ও দুটি জিপের কনভয় থামে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা ওই কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালান।
মো. বজলুল গণি পাটোয়ারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান)। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। জুলাই মাসের শেষদিকে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘ডি’ কোম্পানির অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মো. বজলুল গণি পাটোয়ারীকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৮।
মো. বজলুল গণি পাটোয়ারীর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনগাঁও গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকার মহাখালী ডিওএইচএসে। তাঁর বাবার নাম আবদুর রহিম পাটোয়ারী, মা আফিয়া খাতুন। স্ত্রী লায়লা পারভীন। তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে।
মো. বজলুল গণি পাটোয়ারী বলেন, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে তৎকালীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধের জন্য বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে। এতে এখন কারা কোন কারণে খেতাব পেয়েছেন বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।
সূত্র: মো. বজলুল গণি পাটোয়ারীর সাক্ষাৎকার; নিয়েছেন আবু সাঈদ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস। ছবি নাশিদ মুস্তারি।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.