গোলটেবিল বৈঠক-কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে দরকার খোলামেলা আলাপ

কিশোর-কিশোরীদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে উত্তর জানার সুযোগ সীমিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের কাছে পৌঁছাতে হবে সঠিক তথ্য। গতকাল সোমবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য: অভিভাবকদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ মত দেন।


বক্তারা বলেন, কিশোর-কিশোরীদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না বলে তারা বিপদে পড়ে, অনেক সময় জীবনের ঝুঁকিও দেখা দেয়। খোলামেলা পরিবেশে তাদের পর্যাপ্ত তথ্য দিলে তা তাদের জীবনে মঙ্গল বয়ে আনে, ভবিষ্যতে তারা একেকজন শিক্ষিত বাবা-মা হতে পারবে।
প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বক্তারা বলেন, সন্তানের কোন বয়সে, কোন তথ্য কতটুকু দেবেন, কীভাবে দেবেন ইত্যাদি বিষয়ে অভিভাবকদের শিক্ষিত করা জরুরি। আবার প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, একই সঙ্গে বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ কাজ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বিত উদ্যোগ থাকতে হবে। গণমাধ্যমকেও এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্ল্যান বাংলাদেশ ও কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির সহযোগিতায় এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এম এম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়ে বিভিন্ন প্রকল্প আছে। অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরাও কাজ করছেন, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। তিনি বলেন, সব অভিভাবক এ বিষয়ে সব তথ্য জানেন, তা-ও নয়। সরকারের সচিব পর্যায়ের একজন নারী কর্মকর্তার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষিত এই অভিভাবকও প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক বই ছেলের টেবিলে গোপনে রেখে আসার কথা জানান। অর্থাৎ শিক্ষিত অভিভাবকেরাই এ বিষয়ে কথা বলতে বিব্রত বোধ করেন। এ ক্ষেত্রে স্বল্পশিক্ষিত গ্রামীণ অভিভাবকদের অবস্থা তো আরও শোচনীয়।
গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক তথ্যগুলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে উপস্থাপন করার ওপর গুরুত্ব দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মনোবিজ্ঞানী মেহতাব খানম ‘প্যারেন্টিং’ (সন্তান লালন-পালন) বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান না থাকায় দেশের বেশির ভাগ অভিভাবক সন্তানকে ভুলভাবে বড় করছেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অভিভাবকেরা ভাবেন, ও তো আমার সন্তান, আমি যা বলব তা-ই হবে। তাঁর মতে, অভিভাবকদের প্যারেন্টিং বিষয়ে শিক্ষিত করতে না পারলে সব চেষ্টাই বিফলে যাবে।
মেহতাব খানম ছেলে ও মেয়েদের জন্য গার্হস্থ্যশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, সঠিকভাবে তা পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করেন।
মূল বক্তব্যে প্ল্যান বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক তাহমিনা মির্জা বলেন, ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী দেশের প্রায় চার কোটি কিশোর-কিশোরীর ৪৭ ভাগই বিবাহিত। অর্থাৎ তাদের জীবনে প্রজনন-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। সন্তানের মাও হয়ে যাচ্ছে। তার পরও তাদের কাছে সঠিক তথ্যটি পৌঁছাচ্ছে না। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, অভিভাবকেরা যেসব সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন, সেসব সন্তান কম ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করে। যৌন সম্পর্কে দেরিতে জড়ায়।
বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির (এফপিএবি) সাবেক মহাপরিচালক জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক অভিভাবক ভাবেন, সন্তানকে তথ্য জানালে তারা তাদের জীবনে তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এই আশঙ্কা থেকে যৌনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদেরকে খণ্ডিত তথ্য দেওয়া হয়; যা আরও বেশি ক্ষতি ডেকে আনে। তিনি সরকারের স্বাস্থ্য অবকাঠামোগুলোকে কিশোর-কিশোরীবান্ধব করার সুপারিশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন নবী নিজের কিশোর বয়সের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি যখন স্কুলে পড়ি, তখন শিক্ষক ক্লাসে আসতেন। প্রজননতন্ত্র নিয়ে যে অধ্যায়টি ছিল, তা নিজে আস্তে আস্তে পড়তেন। তারপর মুখ দিয়ে এসব কথা বের হবে না বলে বাড়িতে পড়ে নিতে বলতেন। বর্তমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্রও একই। সময় অনেক পার হলেও মনমানসিকতার পরিবর্তন হয়নি।’
প্ল্যান বাংলাদেশের দেশীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক সেলিনা আমিন বলেন, কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে চুপ করে বসে থাকার আর সময় নেই। বর্তমানে অভিভাবকেরা সন্তানের টেবিলে গোপনে প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক বই রেখে আসছেন, বইয়ের এ-সংক্রান্ত পাতাটা ছিঁড়ে ফেলছেন না, এটিও সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি ধাপ।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন অধিকার আদায়ে বাল্যবিবাহ, যৌন নির্যাতন, পাচার, পারিবারিক নির্যাতন, কাউন্সেলিং বা পরামর্শসেবাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ সার্ভিস) ও লাইন ডিরেক্টর মোহাম্মদ শরীফ বলেন, মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ কিশোরী মাতৃত্ব। তাই সরকারের স্বাভাবিক প্রসব কার্যক্রমের আওতায় কিশোরী মায়েদের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক কর্মসূচির ব্যবস্থাপক ইশরাত জাহান গণমাধ্যমও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি অনেকটা এড়িয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রথম আলোকে সবার আগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যবিষয়ক ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার রাবেয়া খাতুন অভিভাবকদের জন্য একটি গাইড বা নীতিমালা তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন। পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্যও তিনি আহ্বান জানান।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের প্রজননস্বাস্থ্য-বিষয়ক গবেষক কামরুন নাহার বলেন, বর্তমানের কিশোর-কিশোরীরা ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য পাচ্ছে। তবে অভিভাবকসহ সবাইকে দেশীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কথা মাথায় রেখে এ বয়সীদের কাছে বিভিন্ন তথ্য পৌঁছাতে হবে।
পপুলেশন কাউন্সিলের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার লায়লা রহমান বলেন, অভিভাবকেরা কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ও তথ্য পান না বলেই তাঁরা কথা বলতে পারেন না।
প্ল্যান বাংলাদেশের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ইফতেখার হাসান খান বলেন, কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন তথ্য জানানোর জন্য সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে হটলাইন তৈরি, বিয়ে ও জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে কিশোর-কিশোরীদের সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
এইচআইভি/এইডস অ্যান্ড এসটিডি অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের টিম লিডার সৈয়দা সেলিনা পারভীন বলেন, ১৯৯৪ সালে কায়রোর জনসংখ্যা সম্মেলনে কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করে সরকার। অর্থাৎ প্রায় ১৭ বছর ধরে কাজ হচ্ছে। কিন্তু কাজগুলো প্রকল্পভিত্তিক হওয়ায় তা টেকসই হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতের মূলধারায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কাজও সরকারকেই করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.