ব্রিটেন কি বেরিয়ে আসবে?- ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যত- বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া হল্যান্ড থেকে
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন লিয়োনার্দ স্পেন্সার চার্চিল সংক্ষেপে
উইন্সটন চার্চিল ১৯৫৩ সালের ১১ মে হাউস অব কমন্সে অভিন্ন ইউরোপ প্রসঙ্গে
বলেছিলেন, “ডব ধৎব রিঃয ঊঁৎড়ঢ়ব নঁঃ হড়ঃ ড়ভ রঃ;
বি ধৎব ষরহশবফ নঁঃ হড়ঃ
পড়সঢ়ৎড়সরংবফ. ডব ধৎব ধংংড়পরধঃবফ নঁঃ হড়ঃ ধনংড়ৎনবফ. ওভ ইৎরঃধরহ সঁংঃ পযড়ড়ংব
নবঃবিবহ ঊঁৎড়ঢ়ব ধহফ ঃযব ড়ঢ়বহ ংবধ, ংযব সঁংঃ ধষধিুং পযড়ড়ংব ঃযব ড়ঢ়বহ ংবধ.”
(ইউরোপের সাথে আমরা আছি, কিন্তু এর মধ্যে নয়; আমরা জড়িত কিন্তু এর মাঝে
মিশে যাইনি। ইউরোপ এবং উন্মুক্ত সমুদ্র এই দুয়ের একটিকে যদি ব্রিটেনের বেছে
নিতে হয়, তবে তার সব সময় উন্মুক্ত সমুদ্রকে বেছে নেয়া উচিত)। সাহিত্যে
১৯৫৩ সালে নোবেল বিজয়ী এই অতি জনপ্রিয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের পথ
ধরে চলতি সপ্তাহে বর্তমান ব্রিটিশ রক্ষণশীল দলীয় প্রধানমন্ত্রী ডেভিড
ক্যামেরন ঘোষণা দিলেন, ‘আমরা ইউরোপে থাকব, না এর থেকে বেরিয়ে আসব এখন সময়
এসেছে সিদ্ধান্ত নেবার এবং ব্রিটিশ জনগণ এ সিদ্ধান্ত দেবে রেফারেন্ডামের
মাধ্যমে।’ তার এই ঘোষণা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার
সৃষ্টি করেছে। নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াই বেশি কেননা এই ঘোষণা এসেছে এমন একটি
সময় যখন শক্তিধর জার্মানীসহ অন্যান্য অনেক সদস্য রাষ্ট্র মনে করে, ‘এক ও
অভিন্ন ইউরোপ’ ছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর গত্যন্তর নেই। বেলজিয়ামের সাবেক
প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান ইউরোপীয় পার্লামেন্টারিয়ান, ফেরহোফস্টাড
ক্যামেরনের এই ঘোষণাকে ‘আগুন নিয়ে খেলার’ সাথে তুলনা করেছেন।ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম শক্তিশালী সদস্য হলেও এর থেকে এক ধরনের বাইরে। বাইরে এই অর্থে, ব্রিটেন এখন চালু করেছে নিজস্ব মুদ্রা- পাউন্ড। আন্তর্জাতিক বাজারে পাউন্ডের মজবুত অবস্থানের কারণে ব্রিটেন তার পাউন্ডকে ‘ইউরো’র সাথে মিশে যেতে দেয়নি। তাদের এই অবস্থানের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি থাকলেও ইউনিয়নভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাতে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না। অন্যদিকে ব্রিটেনের রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল, পাশাপাশি বড় একটি জনগোষ্ঠী মনে করে, ব্রাসেলস অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি যা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য শুভ নয়। তারা মনে করেন, ইউনিয়নের অপ্রয়োজনীয় আর্থিক বোঝা তাদের কাঁধে চেপে বসেছে এবং সাধারণ জনগণ এর মাশুল দিচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের মে মাসে আগামী ব্রিটেন পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং এই নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কারণে যে ক্যামেরনের এই ঘোষণা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা ইতোমধ্যে বিএনপি অর্থাৎ ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির ‘এন্টি ইউরোপ’ অবস্থানের কারণে কনজারভেটিভ পার্টির অনেক ভোটারকে তাদের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং এই সমর্থন দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর এই ভোট ব্যাংকটিকে নিজের দলের দিকে ফিরিয়ে আনতে কনজারভেটিভ দলীয় সরকার প্রধান ডেভিড ক্যামেরনের এই ঘোষণা বলে অনেকে মনে করেন। ফ্রান্সের ইউরোপীয় এফেয়ার্স মন্ত্রী এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচনে ব্যবহারের উদ্দেশে ইউরোপ প্রসঙ্গ টেনে আনা খুবই বিরক্তিকর।
তবে কেবল যে রাজনৈতিক ফায়দার লক্ষ্যে এই ঘোষণা তাও নয়। আগেই উল্লেখ করেছি, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ঘিরে এর কতিপয় সদস্য রাষ্ট্রের মাঝে রয়েছে অসন্তোষ। ব্রিটেন এমন কী হল্যান্ড মনে করে, ব্রাসেলসের (ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত) হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ফলে সদস্য রাষ্ট্রের ট্যাক্সসহ অনেক অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ব্রাসেলস ‘অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষত’ হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে তারা মনে করে, সদস্য রাষ্ট্রগুলো আর্থিক লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। তাছাড়া ঢালাওভাবে পূর্ব ইউরোপের বেশক’টি রাষ্ট্রকে ইউনিয়নের সদস্য করায় তাদের উন্নয়নে কড়ি গুনতে হচ্ছে ব্রিটেন, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়ামসহ ইউনিয়নের অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলোকে। সম্প্রতি গ্রিসের অর্থনৈতিক ধস, পর্তুগাল, স্পেনের অর্থনৈতিক মেরুদ- সাজা করতে গিয়ে ইউনিয়নকে মোটা অঙ্কের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে হয়েছে। অন্যদিকে, গত কয়েক বছর হু হু করে পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রকে ইউনিয়নভুক্ত করা হয়েছে যাদের, ইউরো-এসকেপার্টিস্টদের মতে, ইউনিয়নের সদস্য হবার মতো যোগ্যতা ছিল না। ফলে ওই সব দেশের বোঝাও অন্যদের বহন করতে হচ্ছে।
এদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ‘ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা’ ইস্যুতে রেফারেন্ডামের ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করেছেন ফরাসী প্রধানমন্ত্রী লরেন্ট ফ্যাবিয়স। ক্যামেরনের এই ঘোষণার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তুমি ক্লাবে (ফুটবল) যোগ দিলে, কিন্তু একবার ভেতরে ঢুকে তুমি তো বলতে পার না, তুমি রাগবী খেলবে।’ এরপর তিনি ফরাসী প্রেসিডেন্ট ওঁলাদে কর্তৃক ট্যাক্স বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য তুলে ধরেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ওঁলাদের হাই ট্যাক্স সরকার থেকে মুক্তির লক্ষ্য দেশ ছাড়া ফরাসী ব্যবসায়ীদের জন্য ব্রিটেন লাল কার্পেট পেতে দেবে।’ ওই কথার সূত্র ধরে ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কিছুদিন আগে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে আমি বলেছি, গ্রেট ব্রিটেন যদি ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসে তাহলে আমরা তোমাদের জন্য লাল কার্পেট বিছিয়ে দেব।’ এক ইউরোপের কট্টর সমর্থক জার্মানী স্বাভাবিক কারণে ক্যামেরনের এই ঘোষণার সন্তুষ্ট নয়। এই প্রসঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এই দেশটির অর্থমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক মন্তব্য, ‘জার্মানী চায় ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকুক। কিন্তু বার্লিন কোন একটি দেশকে তার নিজস্ব সুবিধার জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়ার লক্ষ্যে কোন দরাদরিতে যেতে রাজি নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইউরোর ভবিষ্যতের জন্য ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ও মনিটারি ইউনিয়নের বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এর অর্থ, কম নয়, আমরা চাই আরও আত্তীকরণ।’ সব সিদ্ধান্ত ব্রাসেলসে এবং ব্রাসেলস দ্বারা নেয়া হবে, ক্যামেরনের এমন বক্তব্যের সাথে তিনি একমত প্রকাশ করে বলেন, ‘তাই বলে কেবল চেরি ফল আহরণ একমাত্র অপশন হতে পারে না।’ এর মাধ্যমে তিনি এই বুঝাতে চাইছেন যে, কেবল ফল খেলেই হবে না, কষ্টও করতে হবে, অর্থাৎ অপরের বোঝাও বইতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা গ্লোবালাইজেশনের এই আর্থিক সঙ্কটময় মুহূর্তে একটি অভিন্ন ভাগ্য ভাগাভাগি করছি। ইউরোপীয়ান হিসেবে আমরা সবাই একই নৌকার অভিযাত্রী।’ আয়রন লেডি হিসাবে ইতিমধ্যে পরিচিত জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মেরকেল আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘ব্রিটেনের অভিলাষ নিয়ে আমি ব্যাপক আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। কিন্তু কেবল নিজের সুবিধার জন্য ব্রিটেন কোন সংস্কার দাবি করতে পারবে না। যে কোন ‘ডিলের’ জন্য ‘ফেরার কম্প্রোমাইজ’ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।’
ডেভিড ক্যামেরনের বক্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল্যান্ডের। হল্যান্ডে দীর্ঘদিন ধরে ‘এন্টি ইউরোপ’ হাওয়া বইছে। যেভাবে ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অনেক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে চলেছে তাতে এরা মোটেও সন্তুষ্ট নয়। এদের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শ্বেতহস্তী। এর ব্যয় অত্যাধিক বেশি। এর অর্থের খরচাপাতির কোন নজরদারি নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আর তাই ক্ষমতাসীন লিবারেল দলের জনৈক নেতা বলেন, ‘ক্যামেরনের বক্তৃতাকে আমি বেশ পজিটিভ হিসেবে দেখি। আমরা এমন একটি ইউরোপ চাই যার সীমারেখা থাকবে মূল কাজের মধ্যে।’ তবে তিনি এও বলেন, ‘ব্রিটেন তার একার জন্য যদি কোন বিশেষ সুবিধা চায়, সেটি সমর্থনযোগ্য নয়।‘ ডি-৬৬-এর নেতা আলেক্সজেন্ডার পেকহোল্ড বলেন, ‘২০১৬-১৭ সালে আবার রেফারেন্ডাম কেন? সামনের বছর ইউরোপীয়ান নির্বাচন। তখনই জনগণ তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন।’ ডাচ চরম ডানপন্থী ও বিদেশী খেদাও আন্দোলনের হোতা খেরট গ্লির্ডাস ডেভিড ক্যামেরনের রেফারেন্ডাম দেয়ার ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়ে হল্যান্ডকেও ‘ইউরো’ ও ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান। ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ডাচ নাগরিকদের ও রেফারেন্ডামের অধিকার রয়েছে।’ ক্যামেরনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে অবশ্য এই প্রসঙ্গে এখনও কোন বক্তব্য রাখেননি। ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টে অস্ট্রীয় সদস্য ওথমার কারাসের মতে, “আমরা বরাবর গ্রেট ব্রিটেনকে ‘বাড়তি সসেজ’ (বিশেষ সুবিধা) দিতে পারি না। তাদের মতো সবাই যদি নিজস্ব সুবিধা আদায় করতে থাকে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক সময় ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।” অস্ট্রীয় এই নেতার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়। কেননা এক ইউরোপ চান না এমন ইউরোপীয়র সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইউনিয়নের অতিরিক্ত খবরদারির বিপক্ষে তারা তাদের মতামত জানিয়ে আসছে। পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তিতে অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলোকে বাড়তি মাশুল গুনতে হচ্ছে, যার ফল পড়ছে সাধারণ জনগণের ওপর। তাই সময় থাকতে ইউনিয়নকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাতে ব্রিটেনের মতো শক্তিশালী দেশ ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে না পড়ে এবং অন্যরা তার পথ অনুসরণ না করে।
No comments