চীন-মার্কিন সম্পর্ক কোন্ পথে
এক বছরের কিছু বেশি আগে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হবে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। একই সময় চীনও এই অঞ্চলে নিজের শক্তিকে উত্তরোত্তর জাহির করছিল।
এ অবস্থায় এশীয় দেশগুলো মার্কিন নীতির ভরকেন্দ্রের পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছিল এই ভেবে, এটা চীনের ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য বিধান করবে। গত বছর দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত ভূখ- নিয়ে চীন এবং আশিয়ানের কতিপয় দেশের মধ্যে উত্তেজনার সঞ্চার হয়। এশিয়ার দেশগুলো চীনের দ্রুত সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন বোধ করে। আবার জাপানের দক্ষিণপন্থী ঝোঁকের প্রকাশ গোটা অঞ্চলজুড়ে শঙ্কার ছায়া ফেলে।এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল দৃষ্টি এখন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ওপর পড়ায় চীনের কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের মধ্যে শঙ্কার সৃষ্টি হয়। তারা ধারণা করে, এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন চীনকে ঠেকানোর পুরনো কৌশল অনুসরণ করছে। মার্কিন ঘোষণার আজ এক বছরেরও বেশি সময় পার হবার পর দুটো সত্য উত্তরোত্তর পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। তাহলো এক. যুক্তরাষ্ট্র চীনের কথিত শান্তিপূর্ণ উত্থানকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং দুই. চীনও আমেরিকার ‘ভরকেন্দ্র’ পরিবর্তনকে তাকে প্রতিরোধ করার প্রয়াস হিসেবে দেখে। সোজা কথায় এক দেশের নিরাপত্তা শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টার কারণে অন্য দেশ মনে করছে যে, এতে তার নিরাপত্তা খর্ব হচ্ছে। এই অবস্থায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা ত্বরান্বিত হয় এবং সরাসরি সংঘাত বেধে যায়।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রাহাম এলিসন এটাকে ‘থুসিডাইডের ফাঁদের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডের নামে এই নামটি দেয়া হয়েছে। নবজাগ্রত শক্তি শাসক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করলে যে বিপদ সৃষ্টি হয় এই ফাঁদ বলতে সেই বিপদকে বুঝায়। ১৫০০ সাল থেকে শুরু করে এ ধরনের ১৫টির মধ্যে ১১টির ক্ষেত্রে যুদ্ধ হয়েছে।
এই বিপদ কাটিয়ে উঠার উপায় হিসেবে তিন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ তিনটি সমাধান বাতলেছেন। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্তৃত্ব চীনকে ছেড়ে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্কোচনের এই সময়ে এমন প্রস্তাব তত্ত্বগতভাবে চমৎকার শোনালেও সত্যিই যদি সেটা ঘটে তাহলে এ অঞ্চলে যে মহাগোলযোগ বেধে যাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিহত করতে বা ঠেকিয়ে রাখতে পারে। তবে দুই দেশের একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা এমন যে, এটা করতে যাওয়া মানে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার নামান্তর হবে।
তৃতীয় বিকল্প হলো যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে পারে। ‘দি চায়না চয়েস’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধ ‘হোয়াই আমেরিকা শুড শেয়ার পাওয়ার’-এ অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক হিউজ হোয়াইট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উচিত ক্ষমতা বা শক্তির একটা ঐকতান হওয়া যা এশিয়ায় নিজ নিজ প্রভাব বলয় নির্ধারণ করবে। অবশ্য তার এই বিশ্লেষণের মধ্যে সমস্যাও আছে। ভিয়েতনাম চীনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সহস্র বছর ধরে সংগ্রাম করেছে। সেই ভিয়েতনাম চীনের বলয়ে ইন্দো-চীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে কিভাবে গ্রহণ করবে সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই ওঠে। তাছাড়া এশীয় দেশগুলোকেও তাদের দিক থেকে চীন ও আমেরিকা এই দুয়ের একটিকে বেছে নিতে হবে। এমন এক সিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই ক্ষতিকর বিবেচিত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই চীনের সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে গেছে যার প্রমাণ হলো উদীয়মান পূর্ব এশিয়া শীর্ষক বৈঠক। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, আশিয়ান দেশ এবং আরও ৬টি দেশ আছে। চীনকে আঞ্চলিক ব্যবস্থায় মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, চীন কি এমন ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট। জবাব হলো ‘না’। গত সেপ্টেম্বব মাসে ‘দি স্ট্রেইট টাইমস’ পত্রিকায় চীনের জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজর জেনারেল ঝু চেংগু স্বীকার করেন, ‘চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার মনমানসিকতা ধারণ করে আছে। তাই যদি না হবে তাহলে চীন কেন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান হুমকি হিসেবে দেখে আর যুক্তরাষ্ট্রই বা কেন এশিয়ায় এত বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করছে?’
চলমান ডেস্ক
No comments