সাদাকালো-ভাষার বিকৃতি রোধে আসুন ঐক্যবদ্ধ হই by আহমদ রফিক
বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র যে দেশ ও দশের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে সর্বদা সর্বক্ষেত্রে সচেতন নয়, কয়েক বছর ধরে নানা ঘটনায় তার প্রমাণ মেলে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত যুক্তিসংগত সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় বা অনুরূপ রচনা শাসনযন্ত্র সব সময় বড় একটা আমলে নেয় না।
আর সে জন্যই বোধ হয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক- এই ত্রিধারায় মাঝেমধ্যে জনস্বার্থের প্রয়োজনে দেশের উচ্চ আদালতকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শাসনযন্ত্রের ঘুম ভাঙাতেই যেন এই জাতীয় উদ্যোগ। বলতে হয় স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ।
শহর-গ্রামে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত নির্মম ও অন্যায় ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে একদা রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালতের একজন শ্রদ্ধেয় বিচারপতি। তবু ফতোয়াবাজি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। নদীদূষণ এবং নদীতে অবৈধ স্থাপনা অপসারণেও তেমন নির্দেশনা দেখা গেছে। এ জাতীয় সচেতনতার সর্বশেষ উদাহরণ দুই দিন আগে উচ্চ আদালতের জারি করা একটি নির্দেশনা। প্রশংসনীয় এই উদ্যোগের জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের ধন্যবাদ জানাই।
দৈনিক সংবাদপত্রের খবরে (১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১২) প্রকাশ, বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার উদ্দেশ্যে হাইকোর্টের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বেতার ও দূরদর্শনে (টেলিভিশনে) বাংলা ভাষাকে ব্যঙ্গ করে বা বিকৃত উচ্চারণে প্রচার করা যাবে না। আমাদের এক সহযোগীর লেখা উপসম্পাদকীয় উপলক্ষে এই নির্দেশনা জারি। মাননীয় বিচারপতিদ্বয় এ এইচ শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বিষয়টির শুনানি শেষে স্বপ্রণোদিত হয়ে পূর্বোক্ত নির্দেশ জারি করেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিস্তারিত দিকনির্দেশনাও তাতে রয়েছে।
এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার মান-মর্যাদা রক্ষা প্রসঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ, বিশেষ করে জাতির শিক্ষিত সদস্যদের। বহু মনীষীর অবদানে সমৃদ্ধ বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে : "আজ এই ভাষার ওপর অত্যাচার চলছে। আমাদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এটা রোধ করতে হবে। বাংলা আজ কেবল বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার ভাষা নয়, এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ভাষা, যে ভাষার জন্য রফিক-জব্বার শহীদ হয়েছেন। সেই ভাষা দিবস আজ 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃত।"
এ উপলক্ষে আরো যা কিছু বলা হয়েছে, তার মর্মার্থ হচ্ছে- 'বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বের নানা দেশের ভাষা বিশেষজ্ঞ ভাষার প্রাচুর্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। এমন অনেক দৃষ্টান্ত উদ্ধার করে বলা হয়েছে, এ ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে।' সংগত কারণেই বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠেছে। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার একটি সংগঠন 'বিশ্ব বাংলা পরিষদ'-এর তরফ থেকে একই উদ্দেশ্যে জতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার একই বিষয়ে কাজ করছে বলে জানা যায়।
জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো প্রশ্ন উঠছে, গর্ব করার মতো এমন একটি মাতৃভাষার প্রতি তার ভাষিক সন্তানদের দিক থেকে অবহেলা ও অমর্যাদার মনোভাব প্রকাশ পাবে কেন? আমরা ভুলে যাইনি, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে জাতীয়তাবাদী চেতনার আত্মপ্রকাশ; এবং সেই সূত্রে একাত্তরের রণাঙ্গনে ভাষিক জাতিরাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদশের অভ্যুদয়।
সম্ভবত ওই অবহেলার কারণেই মাতৃভাষা যত্ন সহকারে শেখার, লেখার, এক কথায় আয়ত্ত করার প্রয়োজন বোধ করি না। চেষ্টা করি না শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে, শুদ্ধ বানানে লিখতে, নির্ভুল শব্দ ব্যবহারে পরিচ্ছন্ন ভাষারীতি গড়ে তুলতে। বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যবহারিক হীনম্মন্যতাও আমাদের নেহাত কম নয়। উন্নত বিশ্বের মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষাকে ভালোবেসে তাকে ঘষেমেজে সুশ্রী ও আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়। অথচ আমরা বাঙালি- সিংহভাগ বাঙালি বিপরীত পথ ধরে চলতে চাই।
মাতৃভাষার প্রতি আমাদের মমত্বহীন অবহেলা যে কতটা ব্যাপক, তার প্রমাণ মেলে রাস্তার দুপাশে বিজ্ঞাপন-সাইনবোড-বিলবোর্ডগুলোর দিকে নজর ফেরালে। সেখানে দেখা যাবে বিচিত্র বানানের শব্দাবলি, যা কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না। এক 'সরণি' শব্দেরই বানানে কত রকমফের (স্মরণী, শরনি, সরনী ইত্যাদি)। 'শ্রদ্ধাঞ্জলী'র কথা যদি বাদও দেই, তবু দেখি, বানানে বানানে ভুলের মিছিল; এবং তা টিভি চ্যানেলেও দেখা যায়।
বলা যায়, ভুল বানানের রাজত্বে গভীর অসুখ। শুধু তা-ই নয়, ভুল শব্দের ব্যবহারে, ভুল বাক্য গঠনে, এমনকি নৈরাজ্য একই শব্দের নানা রকম বানানে। অর্থাৎ, ভাষার রীতিনীতিগত প্রমিত রূপের ব্যবহার সর্বজনীন হয়ে উঠছে না। এ ক্ষেত্রে হ্রস্ব 'ই' ও দীর্ঘ 'ঈ' নিয়ে বিতর্ক কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। হ্রস্ব 'ই'র ঢালাও ব্যবহার নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যেও মতভেদ রয়ে গেছে। এর পুরো ফয়সালা এখনো হয়নি। ইংরেজি 'গ্রীক', 'লীগ' ইত্যাদি দীর্ঘ উচ্চারণের শব্দ বাংলায় হ্রস্ব 'ই'-কারে লেখার অনেকেই ঘোর বিরোধী। এর পেছনে যে যুক্তি দেখানো হয়, তা যথেষ্ট মজবুত নয়।
আর উচ্চারণ? সেই প্রসঙ্গ না তোলাই বোধ হয় ভালো। আঞ্চলিকতা থেকে নানা কারণে উচ্চারণ বিকৃতি ব্যাপক বললেও সব বলা হয় না। আর লেখার মধ্য দিয়ে উচ্চারণের অনাচার বুঝিয়ে বলা কঠিন। তথাকথিত 'বাঙাল' বা 'ঘটি'- দুই পক্ষেরই প্রবণতা দুই ধারায় ভুল উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেমন, ওপারে 'স'-'শ' নিয়ে বা 'ল'-'ন' নিয়ে, তেমনি এপারে তেমন প্রকাশ 'এ'-কার 'এ্যা'-কার নিয়ে বা 'র'-'ড়' নিয়ে।
শব্দ ব্যবহারে ভুল-ভ্রান্তি অবশ্য ব্যাপক নয়। তবু ভুলকে তো আর মেনে নেওয়া যায় না। যেমন, 'প্রেক্ষিত' ও 'ফলশ্রুতি' শব্দ দুটোর ভুল অর্থে ব্যবহার এত ব্যাপক যে, নামি-দামি লেখকদের সিংহভাগ এই আক্রমণ থেকে মুক্ত নন। প্রেক্ষণ অর্থাৎ দর্শন বা দৃষ্টি থেকে প্রেক্ষিত, যার আভিধানিক অর্থ- দর্শন করা হয়েছে এমন, যা পরিপ্রেক্ষিত বা পটভূমি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তেমনি আরেকটি শব্দ 'ফলশ্রুতি', যা ফলাফল অর্থে ব্যবহৃত। অথচ শব্দটির মূল অর্থ পুণ্যকর্মের ফল বর্ণনা এবং তা শ্রবণ। অন্যদিকে, এন্তার ব্যবহার 'চিন্তা-চেতনা', 'মন-মানসিকতা'র মতো শব্দের বিভ্রান্তিকর ব্যবহার।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ভাষার বিকৃত ব্যবহার বাংলা ভাষার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেজন্য উচ্চ আদালতকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রতিকারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সময়োচিত ওই দূরদর্শী পদক্ষেপের জন্য আদালতকে আবারও অভিনন্দন জানাই। কারণ, এ ধরনের ভাষাবিষয়ক অনাচার দীর্ঘদিন ধরে চলছে, বিশেষ করে বেসরকারি বেতারে, কখনো কখনো টিভি চ্যানেলে। কিন্তু আমাদের শাসনযন্ত্রের টনক নড়েনি। নড়েনি প্রতিবাদী আলোচনা সত্ত্বেও। বেশ কিছুদিন হলো, এ বিষয়ে একাধিক লেখা ছাপা হয়েছিল কাগজে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চোখে পড়েনি। এবারও তাদের চোখে পড়েনি সহযোগী কলামিস্টের লেখা। কিন্তু নজরে আনানো হয়েছে উচ্চ আদালতের, তাই আদালত থেকে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে রুল জারি করা হয়েছে। এবার হয়তো টনক নড়বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
বিষয়টি এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যে, কলকাতার একটি নামি পত্রিকার পক্ষ থেকে ফোন এসেছে প্রতিক্রিয়া জানতে। হয়তো এর কারণ, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা-বাঙালিও ইংরেজি এবং হিন্দির আগ্রাসনের শিকার। মাস কয়েক আগে দেখেছি সেখানকার একটি গবেষণাধর্মী কাগজের প্রচ্ছদ শিরোনাম 'আক্রান্ত মাতৃভাষা : আসুন প্রতিরোধ করি'।
কিন্তু আমাদের দেশে পূর্বোক্ত ভাষা বিকৃতি এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, বলতে হয়, বিপন্ন বাংলা ভাষা। আসুন, এর বিকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। বাংলিশ নামের দোআঁশলা বাংলার অনাচার ও প্রচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতি রোধ গড়ে তুলি। কারণ, কয়েকটি বেসরকারি বেতারে বা কখনো টিভির অনুষ্ঠানে ইংরেজি-বাংলার, কখনো একটু হিন্দির চাটনি ঢেলে যে খিচুড়ি বাংলার প্রচলন শুরু হয়েছে, তা তরুণ প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলছে। এখানেই বিপদটা সবচেয়ে বেশি।
চমক তরুণ মনকে খুব টানে। তাই সেসব উদ্ভট বাক্যবন্ধ যতই ভাষিক শুদ্ধতার বিনাশ ঘটাক, তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। উলি্লখিত ওইসব বেতারভাষ্য বা বিনোদন অনুষ্ঠান তরুণ-তরুণীদের অপবাংলা শিখতে সাহায্য করছে। কে জানে, কোন দিন তারা ওই উদ্ভট মিশ্র ভাষায় লিখতে শুরু করবে। বিপদটা সেখানেও। তখন হয়তো শুনতে হবে, তরুণ তার তরুণী বান্ধবীকে পার্কের গাছগাছালির নির্জনতায় বসে আদুরে গলায় বলবে- 'একটা সং করতো, কিংবা কী যে সং প্লে করলে।' এমনি ধারার বাংলিশ ভাষায় 'সেন্ড করো', 'প্লে করো', 'ব্রেক নাও' শুনতে শুনতে মনে হতে পারে, এ কোথায় এলাম- বাংলা-বাঙালির দেশে, নাকি অন্য কোনো ভুতুড়ে দেশে? 'ব্রেক' শব্দের কর্কশতার পাশে 'বিরতি' যথেষ্ট নম্র ধ্বনির সুশ্রী শব্দ। তাহলে কেন বলব না, এবার একটু বিরতি নিচ্ছি।
স্বাধীন বাংলাভাষিক জাতিরাষ্ট্রে মাতৃভাষা আজ সত্যিই বিপন্ন। সংবিধানে ঘোষিত 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা' আজ উচ্চ শিক্ষা ও উচ্চ আদালতে ব্যবহারিক মাধ্যম হিসেবে পরিত্যক্ত। এতে সংবিধান লঙ্ঘনের দায় তৈরি হয় কি না, তা আইন বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষায় এ ব্যবস্থার কারণে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা যে উচ্চ শিক্ষার সিঁড়িতে হোঁচট খেতে খেতে ওপরে ওঠার সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তেমনি ওই একই কারণে উচ্চ আদালতে সুবিচারপ্রার্থী স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ যে অচেনা ভাষার কারণে নিজের সমস্যা নিজে বুঝতে পারছে না, এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। তাই মানতে হয়, তাঁরা তখন তাদের ইংরেজি শিক্ষিত আইনজীবীর কাছে নানাভাবে জিম্মি হয়ে পড়েন। এসব সমস্যা বিবেচনায়ও আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের শাসনযন্ত্র সংবিধানের ভাষিক ঘোষণা মেনে চলবে।
তবে পুনরাবৃত্তি হলেও আবার বলি, ভাষার বিকৃত ব্যবহার, বিকৃত উচ্চারণ ইত্যাদি বিষয় ওপরে উলি্লখিত শ্রেণীবিশেষের বঞ্চনার চেয়েও এক অর্থে অধিকতর বিপজ্জনক। বিপজ্জনক গোটা বাংলাভাষী জাতির জন্য। তাই বেতার বা টিভির অনুষ্ঠান পরিচালকদের বলি : অনেক হয়েছে, এখন ব্রেক নেওয়া থেকে বিরত হয়ে বিরতি নিন।
আর মাতৃভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আসুন, উচ্চ আদালতের দিকনির্দেশনা সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ হই। জ্ঞান চর্চার আধুনিকতা বোধ কিন্তু ভাষিক শুদ্ধতার বিরুদ্ধে নয়। এবং তাতে সোচ্চার হওয়া অতীত দিনের শাস্ত্রকারদের গোঁড়ামিতুল্য রক্ষণশীলতা প্রকাশ পায় না।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, বরীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি
শহর-গ্রামে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত নির্মম ও অন্যায় ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে একদা রায় দিয়েছিলেন উচ্চ আদালতের একজন শ্রদ্ধেয় বিচারপতি। তবু ফতোয়াবাজি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। নদীদূষণ এবং নদীতে অবৈধ স্থাপনা অপসারণেও তেমন নির্দেশনা দেখা গেছে। এ জাতীয় সচেতনতার সর্বশেষ উদাহরণ দুই দিন আগে উচ্চ আদালতের জারি করা একটি নির্দেশনা। প্রশংসনীয় এই উদ্যোগের জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের ধন্যবাদ জানাই।
দৈনিক সংবাদপত্রের খবরে (১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১২) প্রকাশ, বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার উদ্দেশ্যে হাইকোর্টের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বেতার ও দূরদর্শনে (টেলিভিশনে) বাংলা ভাষাকে ব্যঙ্গ করে বা বিকৃত উচ্চারণে প্রচার করা যাবে না। আমাদের এক সহযোগীর লেখা উপসম্পাদকীয় উপলক্ষে এই নির্দেশনা জারি। মাননীয় বিচারপতিদ্বয় এ এইচ শামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বিষয়টির শুনানি শেষে স্বপ্রণোদিত হয়ে পূর্বোক্ত নির্দেশ জারি করেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিস্তারিত দিকনির্দেশনাও তাতে রয়েছে।
এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার মান-মর্যাদা রক্ষা প্রসঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ, বিশেষ করে জাতির শিক্ষিত সদস্যদের। বহু মনীষীর অবদানে সমৃদ্ধ বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে : "আজ এই ভাষার ওপর অত্যাচার চলছে। আমাদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এটা রোধ করতে হবে। বাংলা আজ কেবল বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার ভাষা নয়, এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ভাষা, যে ভাষার জন্য রফিক-জব্বার শহীদ হয়েছেন। সেই ভাষা দিবস আজ 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃত।"
এ উপলক্ষে আরো যা কিছু বলা হয়েছে, তার মর্মার্থ হচ্ছে- 'বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বের নানা দেশের ভাষা বিশেষজ্ঞ ভাষার প্রাচুর্য নিয়ে গবেষণা করেছেন। এমন অনেক দৃষ্টান্ত উদ্ধার করে বলা হয়েছে, এ ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে।' সংগত কারণেই বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠেছে। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার একটি সংগঠন 'বিশ্ব বাংলা পরিষদ'-এর তরফ থেকে একই উদ্দেশ্যে জতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার একই বিষয়ে কাজ করছে বলে জানা যায়।
জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, এখনো প্রশ্ন উঠছে, গর্ব করার মতো এমন একটি মাতৃভাষার প্রতি তার ভাষিক সন্তানদের দিক থেকে অবহেলা ও অমর্যাদার মনোভাব প্রকাশ পাবে কেন? আমরা ভুলে যাইনি, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে জাতীয়তাবাদী চেতনার আত্মপ্রকাশ; এবং সেই সূত্রে একাত্তরের রণাঙ্গনে ভাষিক জাতিরাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদশের অভ্যুদয়।
সম্ভবত ওই অবহেলার কারণেই মাতৃভাষা যত্ন সহকারে শেখার, লেখার, এক কথায় আয়ত্ত করার প্রয়োজন বোধ করি না। চেষ্টা করি না শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে, শুদ্ধ বানানে লিখতে, নির্ভুল শব্দ ব্যবহারে পরিচ্ছন্ন ভাষারীতি গড়ে তুলতে। বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যবহারিক হীনম্মন্যতাও আমাদের নেহাত কম নয়। উন্নত বিশ্বের মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষাকে ভালোবেসে তাকে ঘষেমেজে সুশ্রী ও আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়। অথচ আমরা বাঙালি- সিংহভাগ বাঙালি বিপরীত পথ ধরে চলতে চাই।
মাতৃভাষার প্রতি আমাদের মমত্বহীন অবহেলা যে কতটা ব্যাপক, তার প্রমাণ মেলে রাস্তার দুপাশে বিজ্ঞাপন-সাইনবোড-বিলবোর্ডগুলোর দিকে নজর ফেরালে। সেখানে দেখা যাবে বিচিত্র বানানের শব্দাবলি, যা কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না। এক 'সরণি' শব্দেরই বানানে কত রকমফের (স্মরণী, শরনি, সরনী ইত্যাদি)। 'শ্রদ্ধাঞ্জলী'র কথা যদি বাদও দেই, তবু দেখি, বানানে বানানে ভুলের মিছিল; এবং তা টিভি চ্যানেলেও দেখা যায়।
বলা যায়, ভুল বানানের রাজত্বে গভীর অসুখ। শুধু তা-ই নয়, ভুল শব্দের ব্যবহারে, ভুল বাক্য গঠনে, এমনকি নৈরাজ্য একই শব্দের নানা রকম বানানে। অর্থাৎ, ভাষার রীতিনীতিগত প্রমিত রূপের ব্যবহার সর্বজনীন হয়ে উঠছে না। এ ক্ষেত্রে হ্রস্ব 'ই' ও দীর্ঘ 'ঈ' নিয়ে বিতর্ক কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। হ্রস্ব 'ই'র ঢালাও ব্যবহার নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যেও মতভেদ রয়ে গেছে। এর পুরো ফয়সালা এখনো হয়নি। ইংরেজি 'গ্রীক', 'লীগ' ইত্যাদি দীর্ঘ উচ্চারণের শব্দ বাংলায় হ্রস্ব 'ই'-কারে লেখার অনেকেই ঘোর বিরোধী। এর পেছনে যে যুক্তি দেখানো হয়, তা যথেষ্ট মজবুত নয়।
আর উচ্চারণ? সেই প্রসঙ্গ না তোলাই বোধ হয় ভালো। আঞ্চলিকতা থেকে নানা কারণে উচ্চারণ বিকৃতি ব্যাপক বললেও সব বলা হয় না। আর লেখার মধ্য দিয়ে উচ্চারণের অনাচার বুঝিয়ে বলা কঠিন। তথাকথিত 'বাঙাল' বা 'ঘটি'- দুই পক্ষেরই প্রবণতা দুই ধারায় ভুল উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যেমন, ওপারে 'স'-'শ' নিয়ে বা 'ল'-'ন' নিয়ে, তেমনি এপারে তেমন প্রকাশ 'এ'-কার 'এ্যা'-কার নিয়ে বা 'র'-'ড়' নিয়ে।
শব্দ ব্যবহারে ভুল-ভ্রান্তি অবশ্য ব্যাপক নয়। তবু ভুলকে তো আর মেনে নেওয়া যায় না। যেমন, 'প্রেক্ষিত' ও 'ফলশ্রুতি' শব্দ দুটোর ভুল অর্থে ব্যবহার এত ব্যাপক যে, নামি-দামি লেখকদের সিংহভাগ এই আক্রমণ থেকে মুক্ত নন। প্রেক্ষণ অর্থাৎ দর্শন বা দৃষ্টি থেকে প্রেক্ষিত, যার আভিধানিক অর্থ- দর্শন করা হয়েছে এমন, যা পরিপ্রেক্ষিত বা পটভূমি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তেমনি আরেকটি শব্দ 'ফলশ্রুতি', যা ফলাফল অর্থে ব্যবহৃত। অথচ শব্দটির মূল অর্থ পুণ্যকর্মের ফল বর্ণনা এবং তা শ্রবণ। অন্যদিকে, এন্তার ব্যবহার 'চিন্তা-চেতনা', 'মন-মানসিকতা'র মতো শব্দের বিভ্রান্তিকর ব্যবহার।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ভাষার বিকৃত ব্যবহার বাংলা ভাষার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেজন্য উচ্চ আদালতকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রতিকারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সময়োচিত ওই দূরদর্শী পদক্ষেপের জন্য আদালতকে আবারও অভিনন্দন জানাই। কারণ, এ ধরনের ভাষাবিষয়ক অনাচার দীর্ঘদিন ধরে চলছে, বিশেষ করে বেসরকারি বেতারে, কখনো কখনো টিভি চ্যানেলে। কিন্তু আমাদের শাসনযন্ত্রের টনক নড়েনি। নড়েনি প্রতিবাদী আলোচনা সত্ত্বেও। বেশ কিছুদিন হলো, এ বিষয়ে একাধিক লেখা ছাপা হয়েছিল কাগজে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চোখে পড়েনি। এবারও তাদের চোখে পড়েনি সহযোগী কলামিস্টের লেখা। কিন্তু নজরে আনানো হয়েছে উচ্চ আদালতের, তাই আদালত থেকে বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে রুল জারি করা হয়েছে। এবার হয়তো টনক নড়বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
বিষয়টি এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যে, কলকাতার একটি নামি পত্রিকার পক্ষ থেকে ফোন এসেছে প্রতিক্রিয়া জানতে। হয়তো এর কারণ, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা-বাঙালিও ইংরেজি এবং হিন্দির আগ্রাসনের শিকার। মাস কয়েক আগে দেখেছি সেখানকার একটি গবেষণাধর্মী কাগজের প্রচ্ছদ শিরোনাম 'আক্রান্ত মাতৃভাষা : আসুন প্রতিরোধ করি'।
কিন্তু আমাদের দেশে পূর্বোক্ত ভাষা বিকৃতি এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, বলতে হয়, বিপন্ন বাংলা ভাষা। আসুন, এর বিকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। বাংলিশ নামের দোআঁশলা বাংলার অনাচার ও প্রচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতি রোধ গড়ে তুলি। কারণ, কয়েকটি বেসরকারি বেতারে বা কখনো টিভির অনুষ্ঠানে ইংরেজি-বাংলার, কখনো একটু হিন্দির চাটনি ঢেলে যে খিচুড়ি বাংলার প্রচলন শুরু হয়েছে, তা তরুণ প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলছে। এখানেই বিপদটা সবচেয়ে বেশি।
চমক তরুণ মনকে খুব টানে। তাই সেসব উদ্ভট বাক্যবন্ধ যতই ভাষিক শুদ্ধতার বিনাশ ঘটাক, তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। উলি্লখিত ওইসব বেতারভাষ্য বা বিনোদন অনুষ্ঠান তরুণ-তরুণীদের অপবাংলা শিখতে সাহায্য করছে। কে জানে, কোন দিন তারা ওই উদ্ভট মিশ্র ভাষায় লিখতে শুরু করবে। বিপদটা সেখানেও। তখন হয়তো শুনতে হবে, তরুণ তার তরুণী বান্ধবীকে পার্কের গাছগাছালির নির্জনতায় বসে আদুরে গলায় বলবে- 'একটা সং করতো, কিংবা কী যে সং প্লে করলে।' এমনি ধারার বাংলিশ ভাষায় 'সেন্ড করো', 'প্লে করো', 'ব্রেক নাও' শুনতে শুনতে মনে হতে পারে, এ কোথায় এলাম- বাংলা-বাঙালির দেশে, নাকি অন্য কোনো ভুতুড়ে দেশে? 'ব্রেক' শব্দের কর্কশতার পাশে 'বিরতি' যথেষ্ট নম্র ধ্বনির সুশ্রী শব্দ। তাহলে কেন বলব না, এবার একটু বিরতি নিচ্ছি।
স্বাধীন বাংলাভাষিক জাতিরাষ্ট্রে মাতৃভাষা আজ সত্যিই বিপন্ন। সংবিধানে ঘোষিত 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা' আজ উচ্চ শিক্ষা ও উচ্চ আদালতে ব্যবহারিক মাধ্যম হিসেবে পরিত্যক্ত। এতে সংবিধান লঙ্ঘনের দায় তৈরি হয় কি না, তা আইন বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষায় এ ব্যবস্থার কারণে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা যে উচ্চ শিক্ষার সিঁড়িতে হোঁচট খেতে খেতে ওপরে ওঠার সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তেমনি ওই একই কারণে উচ্চ আদালতে সুবিচারপ্রার্থী স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ যে অচেনা ভাষার কারণে নিজের সমস্যা নিজে বুঝতে পারছে না, এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। তাই মানতে হয়, তাঁরা তখন তাদের ইংরেজি শিক্ষিত আইনজীবীর কাছে নানাভাবে জিম্মি হয়ে পড়েন। এসব সমস্যা বিবেচনায়ও আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের শাসনযন্ত্র সংবিধানের ভাষিক ঘোষণা মেনে চলবে।
তবে পুনরাবৃত্তি হলেও আবার বলি, ভাষার বিকৃত ব্যবহার, বিকৃত উচ্চারণ ইত্যাদি বিষয় ওপরে উলি্লখিত শ্রেণীবিশেষের বঞ্চনার চেয়েও এক অর্থে অধিকতর বিপজ্জনক। বিপজ্জনক গোটা বাংলাভাষী জাতির জন্য। তাই বেতার বা টিভির অনুষ্ঠান পরিচালকদের বলি : অনেক হয়েছে, এখন ব্রেক নেওয়া থেকে বিরত হয়ে বিরতি নিন।
আর মাতৃভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আসুন, উচ্চ আদালতের দিকনির্দেশনা সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ হই। জ্ঞান চর্চার আধুনিকতা বোধ কিন্তু ভাষিক শুদ্ধতার বিরুদ্ধে নয়। এবং তাতে সোচ্চার হওয়া অতীত দিনের শাস্ত্রকারদের গোঁড়ামিতুল্য রক্ষণশীলতা প্রকাশ পায় না।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, বরীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি
No comments