একুশ : সত্য উপলব্ধির সহায়ক হোক by লুৎফর রহমান রনো
বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে আমাদের আত্মপরিচয়ের ইতিহাসে সগর্বে সংযুক্ত হয়েছিল যে দিনটি উজ্জীবনের উৎস হিসেবে, তার নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। এই অমর একুশের অভিঘাতে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম। একুশের চেতনায় উদ্ভাসিত জাতি। বলা যায়, ভাষার হাত ধরে আমাদের পুনরুত্থান।
ভাষার জন্য কোনো জাতির রক্ত ঝরানোর ঘটনা বিরল। বাংলা ভাষা আমাদের জীবন ও আবেগের বাহনই শুধু নয়, অস্তিত্ব রক্ষার অস্ত্রও। অথচ এ ভাষা আজ আমাদের ভালোবাসার অভাবে বড় বিপন্ন। আজকাল বাংলা ভাষার প্রতি উপেক্ষা উপলব্ধি করলে বলতে হয়, ফেব্রুয়ারি মাসটি ভাষাপ্রীতির ছলে যেন বাণিজ্য আর উৎসব আমেজ উপভোগ করার নিমিত্তে নির্ধারিত হয়েছে।
মানুষের সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাস বলতে পারি ভাষা বিকাশের ইতিহাস। অথচ আমাদের পথচলা যেন পেছন দিকে। ভাষা সংকোচন ও মোচনের ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে কি না, দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। এখন এ দেশে অনেক বাঙালি রয়েছেন যাঁরা বাংলা কম জানেন বা জানেন না বলতে গৌরববোধ করেন। ধিক্কার! মানবসভ্যতার চিন্তার বা জ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য_এসবের সর্বযুগের দিকপালরা তাঁদের নিজেদের ভাষায় ভেবেছেন, লিখেছেন। চিন্তার রসদ আহরণ করেছেন প্রয়োজনে অন্য ভাষা থেকে। ফলে নিজের ভাষা হয়েছে ঋদ্ধ, চিন্তায়-শিল্পকলায় যে ভাষার ব্যাপ্তি বেড়েছে, সে ভাষার মানুষের মনে-মননে নিরবচ্ছিন্নভাবে জুগিয়েছে পুষ্টি। আর এই স্বতঃসিদ্ধ পন্থায় যেকোনো জাতির সমৃদ্ধি ঘটে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্পে-সাহিত্যে। যে যাই বলেন না কেন, আমরা পিছিয়ে পড়ে আছি জ্ঞানের অভাবে। জ্ঞানের অভাবেই, আমাদের যতটুকু আছে, তারও কোনো কার্যকারিতা নেই। অভিযোগ উঠছে, গণমাধ্যমে বাংলাভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে। বেসরকারি চ্যানেল, রেডিওতে মিথ্যে নয়। প্রিন্ট মিডিয়াতেও তাই। পত্র-পত্রিকার ভাষা সবার বোধগম্য হতে হবে, 'ব্যস্ত সাহিত্য' হলো পত্রিকার ভাষা ইত্যাদি একপেশে যুক্তি দিয়ে অশুদ্ধ ও নিম্নমানের লেখা চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। এতে ভাষার উৎকর্ষ সাধনের ও সৃজনশীলতার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা হয়ে পড়ছে ক্লিশে ও কেরানিগিরির মতো লেখার কাজ। বিকাশের পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে বাণিজ্যের প্রতাপে। ভাষার অস্তিত্ব, উৎকর্ষ নির্ভর করে নিরন্তর বিকাশমানতার ওপর। অস্তিত্বের শর্তই হলো উত্তরণের দিকে অবিরল যাত্রা। আজ আমাদের ভাষা মার খাচ্ছে, তার মানে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশের সম্ভাবনা স্তিমিত হয়ে এসেছে। একুশের বইমেলায় অপাঠ্য আবর্জনা জাতীয় 'সাহিত্য' নামের বইয়ে সয়লাব। এসব লেখক-প্রকাশকদের বর্জন করা উচিত। তরুণ-কিশোর পাঠকদের হাতে এসব বই তুলে দিলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।
চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরেছে জীবনযাপনের পথে যাবতীয় সংকট। আমাদের চিন্তার গভীরতা ও স্বাধীন চিন্তার চর্চার অভাবে ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা ঘোচেনি আজও। ইংরেজি-উর্দুতে কথা বলতে পারলে অনেকেই নিজেদের অভিজাত ও শিক্ষিত বলে ভাবতে অভ্যস্ত। এই গড্ডল প্রবাহের পরিণাম কী ভয়াবহ তা ভাবার ফুরসত বের করতে হবে চিন্তাবিদদের। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র কিংবা সমাজের সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার কোনো গরজ দেখা যায় না সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিভা বা প্রতিষ্ঠানের। অফিস-আদালত-ব্যবসা-বাণিজ্য সব দখল করছে ইংরেজি ভাষা। তার মানে, পরোক্ষভাবে বাংলাকে অবহেলা করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। জ্ঞানের কেন্দ্রে, ক্ষমতার কেন্দ্রে যখন যাঁরা থাকেন, ব্যস্ত থাকেন নিজ নিজ অবস্থান রক্ষা অথবা অবস্থার উত্তরণ ঘটানোর নিরলস নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায়। আর এই সুযোগে বা বলা যায়, প্রতিরোধহীন সীমান্ত দিয়ে বিশ্বায়নের সেরা সৃষ্টি ভাষা-সংস্কৃতি বিনাশের যে ব্যাকরণ, তা সরাসরি আমাদের ওপর আঘাত করছে। প্রতি মুহূর্তে এই অবাঞ্ছিত হামলার শিকারে পরিণত হচ্ছে আমাদের আগামীকালের দেশের সেবক যারা হবে তারাই। বেড়ে উঠছে মেরুদণ্ডহীন প্রজন্মরূপে। তখন আর শহীদ মিনার, স্মৃতিস্তম্ভ বা আমাদের জাতীয় প্রতীকস্বরূপ ভাস্কর্য শিল্প ভাঙার জন্য রাতের আঁধারে মৌলবাদীদের আঘাত করার দরকার হবে না। এমনিতেই ওসব মূল্যহীন হয়ে পড়বে। মন-মস্তিষ্ক থেকে মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্য ঝরে পড়ে গেলে কিছুই আর বেঁচে থাকবে না। অবশ্য এ জাতির তখন মাটি ছুঁতে হবে না। আগামী প্রজন্ম শুধু আকাশে আকাশে বিচরণ করবে, নেটে নেটে, ক্যাবলে-চ্যানেলে। অর্থাৎ আকাশ-সংস্কৃতির ধারক-বাহকরূপে বাঙালির মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে সফটওয়্যার কম্পানি ও বিশ্বায়নের রূপকার বিশ্ব-আধিপত্যবাদীদের কাছে। তা ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে হয়।
লেখক : সাংবাদিকমানুষের সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাস বলতে পারি ভাষা বিকাশের ইতিহাস। অথচ আমাদের পথচলা যেন পেছন দিকে। ভাষা সংকোচন ও মোচনের ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে কি না, দ্বন্দ্বে পড়তে হয়। এখন এ দেশে অনেক বাঙালি রয়েছেন যাঁরা বাংলা কম জানেন বা জানেন না বলতে গৌরববোধ করেন। ধিক্কার! মানবসভ্যতার চিন্তার বা জ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য_এসবের সর্বযুগের দিকপালরা তাঁদের নিজেদের ভাষায় ভেবেছেন, লিখেছেন। চিন্তার রসদ আহরণ করেছেন প্রয়োজনে অন্য ভাষা থেকে। ফলে নিজের ভাষা হয়েছে ঋদ্ধ, চিন্তায়-শিল্পকলায় যে ভাষার ব্যাপ্তি বেড়েছে, সে ভাষার মানুষের মনে-মননে নিরবচ্ছিন্নভাবে জুগিয়েছে পুষ্টি। আর এই স্বতঃসিদ্ধ পন্থায় যেকোনো জাতির সমৃদ্ধি ঘটে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্পে-সাহিত্যে। যে যাই বলেন না কেন, আমরা পিছিয়ে পড়ে আছি জ্ঞানের অভাবে। জ্ঞানের অভাবেই, আমাদের যতটুকু আছে, তারও কোনো কার্যকারিতা নেই। অভিযোগ উঠছে, গণমাধ্যমে বাংলাভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে। বেসরকারি চ্যানেল, রেডিওতে মিথ্যে নয়। প্রিন্ট মিডিয়াতেও তাই। পত্র-পত্রিকার ভাষা সবার বোধগম্য হতে হবে, 'ব্যস্ত সাহিত্য' হলো পত্রিকার ভাষা ইত্যাদি একপেশে যুক্তি দিয়ে অশুদ্ধ ও নিম্নমানের লেখা চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। এতে ভাষার উৎকর্ষ সাধনের ও সৃজনশীলতার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা হয়ে পড়ছে ক্লিশে ও কেরানিগিরির মতো লেখার কাজ। বিকাশের পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে বাণিজ্যের প্রতাপে। ভাষার অস্তিত্ব, উৎকর্ষ নির্ভর করে নিরন্তর বিকাশমানতার ওপর। অস্তিত্বের শর্তই হলো উত্তরণের দিকে অবিরল যাত্রা। আজ আমাদের ভাষা মার খাচ্ছে, তার মানে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশের সম্ভাবনা স্তিমিত হয়ে এসেছে। একুশের বইমেলায় অপাঠ্য আবর্জনা জাতীয় 'সাহিত্য' নামের বইয়ে সয়লাব। এসব লেখক-প্রকাশকদের বর্জন করা উচিত। তরুণ-কিশোর পাঠকদের হাতে এসব বই তুলে দিলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।
চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরেছে জীবনযাপনের পথে যাবতীয় সংকট। আমাদের চিন্তার গভীরতা ও স্বাধীন চিন্তার চর্চার অভাবে ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা ঘোচেনি আজও। ইংরেজি-উর্দুতে কথা বলতে পারলে অনেকেই নিজেদের অভিজাত ও শিক্ষিত বলে ভাবতে অভ্যস্ত। এই গড্ডল প্রবাহের পরিণাম কী ভয়াবহ তা ভাবার ফুরসত বের করতে হবে চিন্তাবিদদের। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র কিংবা সমাজের সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার কোনো গরজ দেখা যায় না সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিভা বা প্রতিষ্ঠানের। অফিস-আদালত-ব্যবসা-বাণিজ্য সব দখল করছে ইংরেজি ভাষা। তার মানে, পরোক্ষভাবে বাংলাকে অবহেলা করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। জ্ঞানের কেন্দ্রে, ক্ষমতার কেন্দ্রে যখন যাঁরা থাকেন, ব্যস্ত থাকেন নিজ নিজ অবস্থান রক্ষা অথবা অবস্থার উত্তরণ ঘটানোর নিরলস নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায়। আর এই সুযোগে বা বলা যায়, প্রতিরোধহীন সীমান্ত দিয়ে বিশ্বায়নের সেরা সৃষ্টি ভাষা-সংস্কৃতি বিনাশের যে ব্যাকরণ, তা সরাসরি আমাদের ওপর আঘাত করছে। প্রতি মুহূর্তে এই অবাঞ্ছিত হামলার শিকারে পরিণত হচ্ছে আমাদের আগামীকালের দেশের সেবক যারা হবে তারাই। বেড়ে উঠছে মেরুদণ্ডহীন প্রজন্মরূপে। তখন আর শহীদ মিনার, স্মৃতিস্তম্ভ বা আমাদের জাতীয় প্রতীকস্বরূপ ভাস্কর্য শিল্প ভাঙার জন্য রাতের আঁধারে মৌলবাদীদের আঘাত করার দরকার হবে না। এমনিতেই ওসব মূল্যহীন হয়ে পড়বে। মন-মস্তিষ্ক থেকে মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, আমাদের সাহিত্যিক ঐতিহ্য ঝরে পড়ে গেলে কিছুই আর বেঁচে থাকবে না। অবশ্য এ জাতির তখন মাটি ছুঁতে হবে না। আগামী প্রজন্ম শুধু আকাশে আকাশে বিচরণ করবে, নেটে নেটে, ক্যাবলে-চ্যানেলে। অর্থাৎ আকাশ-সংস্কৃতির ধারক-বাহকরূপে বাঙালির মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে সফটওয়্যার কম্পানি ও বিশ্বায়নের রূপকার বিশ্ব-আধিপত্যবাদীদের কাছে। তা ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে হয়।
No comments