মুঠোফোনে পুরস্কারের টোপ by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ও পান্না বালা

কৃষক কলিম উদ্দিনের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আমোদপুর গ্রামে। গত বুধবার তাঁর মুঠোফোনে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, একটি মুঠোফোন কোম্পানির লটারি জিতেছেন তিনি। পুরস্কার হিসেবে ১৮ লাখ ৫২ হাজার টাকা ও পাঁচ ভরি ওজনের স্বর্ণপদক দেওয়া হবে। পুরস্কারের টাকা বাড়িতে হেলিকপ্টারে করে পাঠানো হবে।


এ জন্য সরকারি ভ্যাট (কর) ও হেলিকপ্টার ভাড়া দিতে হবে কলিমকে। দুই দিনের ব্যবধানে দুই কিস্তিতে ৮১ হাজার ৫০০ টাকা পাঠান কলিম। তারপর আবার ফোন। এবার দাবি ৬৪ হাজার টাকা। পাঠাতে হবে ফরিদপুরে। কলিমের মনে সন্দেহ জাগে। গত শুক্রবার তিনি প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়ে এসে ঘটনা খুলে বলেন। পরে কৌশলে ৫০০ টাকা পাঠিয়ে প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রতারককে আটক করা হয়।
এর আগে গত ডিসেম্বরে একই কায়দায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) পাঁচ লাখ ৭০ হাজার টাকা খুইয়েছেন। তবে ওই শিক্ষক এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি।
যেভাবে আটক: বুধ ও বৃহস্পতিবার যথাক্রমে সাড়ে ২৫ হাজার ও ৫৬ হাজার টাকা পাঠান কলিম। শুক্রবার তাঁকে ফরিদপুর কুরিয়ার সার্ভিসে টাকা পাঠাতে বলা হয়। ফরিদপুরে চুন্নু মুন্সী নামের এক ব্যক্তি ওই টাকা গ্রহণ করবেন। কথা অনুযায়ী কলিম বিকেলে টাকা পাঠান। ফরিদপুরে প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধি জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তাকে নিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের ওই শাখায় ওত পেতে থাকেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফরিদপুর এসবির এক কর্মকর্তা জানান, বিকেলে ফরিদপুর শহরে কুরিয়ার সার্ভিসের কাউন্টারে টাকা নিতে আসেন চুন্নু মুন্সী (২২)। তিনি কাউন্টারে এসে বলেন, ‘আমার টাকা এসেছে রাজশাহী থেকে।’ টাকার অঙ্ক, নাম ও মুঠোফোন নম্বর মিলে গেলে তাঁকে আটক করা হয়।
শুক্রবার রাত ১১টার দিকে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় কথা হয় চুন্নুর সঙ্গে। চাপের মুখে স্বীকার করেন মুঠোফোনে প্রতারক দল ‘ওয়েলকাম পার্টির’ সদস্য তিনি। তারপর বর্ণনা করেন মানুষের সঙ্গে প্রতারণার কাহিনি।
প্রতারণার কৌশল: চুন্নুর ভাষ্যমতে, তিনিসহ দলে পাঁচজন সদস্য আছেন। এর মধ্যে একজন নারী, তাঁর বাড়ি বরিশাল। চুন্নুসহ অন্যদের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে। চুন্নু জানান, সাধারণত লটারিতে টাকা, স্বর্ণ, মাইক্রোবাস, ফ্ল্যাটবাড়ির লোভ দেখিয়ে প্রতারণা করা হয়। ফোনে যোগাযোগের কাজটা ওই নারী সদস্য করেন। ফোনে বলা হয়, ‘ওয়েলকাম। “...” ফোন থেকে বলছি। আপনি একটি মাইক্রোবাস পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কারটি বুঝে নিতে আপনাকে ভ্যাটসহ কিছু খরচ করতে হবে...।’
চুন্নু বলেন, ‘তিন কিস্তির বেশি টাকা নেওয়া সম্ভব হয় না। এর মধ্যেই প্রতারিতরা বিষয়টি বুঝতে পেরে অন্যদের জানিয়ে দেন। তখন আমরা ওই পর্ব শেষ করে আবার নতুন শিকার খুঁজতে শুরু করি।’ তিনি বলেন, এক লাখ টাকা পেলে যিনি কাউন্টার থেকে টাকা তোলেন, তাঁকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকিটা দলের অন্যরা ভাগ করে নেন।
ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ধারণা ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর, কালামৃধা ও চন্দ্রা—এই তিন ইউনিয়নে এমন কয়েক হাজার প্রতারক আছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল শনিবার উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। সভায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে এসব প্রতারককে জেল-জরিমানা করার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রতারিত ব্যক্তির অভিজ্ঞতা: প্রতারণার শিকার রাজশাহীর কৃষক কলিম বাদী হয়ে গত শুক্রবার রাতে রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা করেছেন। ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, চুন্নুকে বোয়ালিয়া থানায় হস্তান্তর করা হবে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
কলিম জানান, গত বুধবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে একটি মুঠোফোন কোম্পানির কর্মকর্তা দাবি করে এক ব্যক্তি তাঁকে ফোন করেন। বলেন, তাঁদের কোম্পানির ৩০ লাখ সিম কার্ডের লটারি করে ১০ জন ভাগ্যবান গ্রাহক নির্বাচন করা হয়েছে। কলিম প্রথম হয়েছেন। পুরস্কারের টাকা পেতে হলে কুরিয়ার সার্ভিসে সরকারি ভ্যাটের ২৫ হাজার ৫০০ টাকা পাঠাতে হবে।
কথামতো কলিম বুধবারই ফরিদপুরে কুরিয়ার সার্ভিসের ওই শাখায় টাকা পাঠান। এরপর তাঁকে বলা হয়, হেলিকপ্টার ভাড়া লাগবে এক লাখ ৬৮ হাজার টাকা। ভাড়ার ১ ভাগ মুঠোফোন কোম্পানি, ১ ভাগ প্রধানমন্ত্রী পরিশোধ করবেন। বাকিটা অর্থাৎ ৫৬ হাজার টাকা তাঁকে দ্রুত পাঠিয়ে দিতে হবে। পরের দিন বৃহস্পতিবার সেই টাকাও একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ঢাকার কাকরাইল শাখার ঠিকানায় রবিন নামের একজনের কাছে পাঠান কলিম। শুক্রবার তাঁকে আবার বলা হয়, ৬৪ জেলার গ্রাহকদের মধ্যে লটারি হয়েছে। জেলাগুলোতে ঘুরে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। গাড়িতে গেলে সময় লাগবে। তিনি (যিনি ফোন করেছেন) হেলিকপ্টারে যাবেন। এ জন্য ৬৪ হাজার টাকা পাঠাতে হবে। এ কথা কাউকে না বলার জন্য কলিমকে সাবধান করে দেওয়া হয়। একের পর এক টাকা জোগাড় করতে পেরেশান কলিম শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়ে আসেন।

No comments

Powered by Blogger.